কেবল কয়েকটি মাত্র ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষকে বিচার করলে, সেটি ভুল হবে। এবং আরও ভুল হবে যদি কখনো, কোনো একদিন, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো ‘সীমাবদ্ধ’ কিংবা ‘সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়শক্তি’ নিয়েই মানুষ পৃথিবীর মহত্বম কর্মকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করেছে। বস্তুত ‘অসীম’ এবং ‘সুগভীর’ কয়েকটি প্রত্যয়ের কলোচ্ছ্বাসে মানুষ নিজেকে গড়ে তোলে, নিজেকে তৈরি করে পৃথিবীর জন্যে, সভ্যতার জন্যে।
তাই সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে চাইলে ধ্বংস করে দিতে হবে মানুষকে, যার সুনিপুণ সূচনা আমরা দেখেছি সৃষ্টি ও সভ্যতার শুরুতেই, তারপর ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয়েছে হাজার উপায়-প্রতি উপায়, যেগুলো দিয়ে জীবিত মানুষকেই রেখে দেয়া যায় চিরন্তন মৃত করে, মমি করে নয়, মৃত করে। এগুলো সুদক্ষ অমানবিক মহড়া আমরা দেখেছি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং আরও দেখেছি ঊনিশশো একাত্তর সালে— কীভাবে সভ্যতা-সুন্দরকে ধ্বংস করে দিতে হয়। তবে অমানবিকতার উৎকট দৃশ্য-প্রদর্শনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এগিয়ে ছিলো, তারা কেবল জেনোসাইডই করেনি, ধ্বংস করেছে পাঠাগার, বিশ্ববিদ্যালয়, ‘চিন্তা’র খড়া নামিয়ে দিতে, দর্শন আর শিল্পবোধ থেকে বাঙালিকে আজীবন বিচ্ছিন্ন করে দিতে তারা হত্যা করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, অবশ্য এদেশীয় কুলাঙ্গারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং শেষ পর্যন্ত, ‘যদি সামরিক যুদ্ধে হেরেই যায়’ এই ‘সেনাভাগাড় তত্ত্ব’ থেকেই তারা বিভৎস নারী নির্যাতন চালায়, সুকৌশলে জন্ম দেয় পাকি-বাঙালি সঙ্কর শিশু এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পন করলেও বাঙালির চেতনা ধ্বংসের নীল নকশায় শতকরা সত্তর ভাগ সফল পাকিস্তান। এর গাণিতিক পরিসংখ্যান হয়তো শ্রমসাধ্য গবেষণার বিষয়, কিন্তু বর্তমান বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় চোখ রাখলে এ সত্য অনুধাবন অসম্ভব কিছু নয়।
একটি সংবাদ এবং ন্যায়শাস্ত্রে লিখিত ধর্মানুভূতি
সংবাদটি সকলেই জেনেছেন। আদালত সংক্রান্ত সংবাদ— না জানার কিছু নেই। আদালত সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যেখানে কোনো রোম্যান্টিকতা নেই, থরোথরো কেঁপে ওঠার মতো শিহরণ নেই, তারপরও মানুষ তার খবর রাখে। সম্প্রতি আদালত ‘ধর্মানুভূতি’ সম্বন্ধে একটি নির্দেশনা দিয়েছে।
ঢাকা, মার্চ ২১ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠায় কয়েকটি ফেইসবুক পেইজ এবং একটি ওয়েবসাইট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একটি রিট আবেদনে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার বুধবার এই আদেশ দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব, তথ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে। আদালত একইসঙ্গে এই পেইজ ও ওয়েবসাইট সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করতে তদন্ত শুরুর নির্দেশও দিয়েছে। আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ নওশাদ জমির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই সব ফেইসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইটে হজরত মুহাম্মদ (স.) ও ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছে। ফেইসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি। পাঁচটি ফেইসবুক পেইজ এবং একটি ওয়েবসাইটের কথা তুলে ধরে বুধবার সকালে হাইকোর্টে রিট আবেদনটি করেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাতুল সারওয়ার এবং ঢাকা সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনোমিকসের অধ্যক্ষ এম নুরুল ইসলাম। প্রাথমিক শুনানি করে আদালত অন্তর্বতীকালীন এই আদেশ দেয়। পাশাপাশি আদালত একটি রুলও জারি করেছে। রুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক বা অন্য ইন্টারনেট সাইটে থাকা ওই সব ইউআরএল (ইউনিভার্সাল রিসোর্স লোকেটর), গ্রুপ বা পেইজ স্থায়ীভাবে বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
একইসঙ্গে অশালীন আধেয় আপলোড করায় এ সব সাইট/ওয়েব পেইজের হোতা/প্রতিষ্ঠাতা/হোস্টের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং একই ধরনের অশালীন ও জঘন্য আধেয় প্রদর্শনকারী সাইট/ওয়েব পেইজ বন্ধের ধারবাহিকতা কেন নিশ্চিত করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছে আদালত। তিন সপ্তাহের মধ্যে বিবাদিদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
‘ধর্মানুভূতি’ নিয়ে আদালতের সমন; অতএব আপনি শুনতে না চাইলেও আপনাকে শুনতে হবে। বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে ‘ধর্মানুভূতি’ এবং ‘ভাবমূর্তি’ দুইটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। কোনো সরকারের আমলে আমাদের ‘ধর্মানুভূতি’ বিপন্ন হয়, কোনো সরকারের আমলে আমাদের ‘ভাবমূর্তি’ বিপন্ন হয়। এবং সব সরকারের আমলেই বিপন্ন হয় আমাদের মতিষ্ক, আমাদের আত্ম-পরিচয়, বাঙালি হিশেবে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের মহাকাব্যিক আখ্যান, আমাদের সংসদ— লুই কানের অমোঘ সৃষ্টি, আমাদের জাতীয়তাবোধ, বঙ্গবন্ধু— আমাদের নেতা, জয় বাঙলা— আমাদের স্লোগান এবং আমরা, বাঙালিরা। বড়ো বিপন্ন বোধ করি চব্বিশ ঘণ্টা, সাত দিন, ত্রিশ দিন তিনশত পঁয়ষট্টি দিন.. ..এবং এইভাবে বিপন্ন বোধ করছি দীর্ঘ চল্লিশ বছর।
যদিও ‘ধর্মানুভূতি’ বিপন্ন হবার বিরুদ্ধে আজ একটি আদেশ দেয়া হয়েছে। এতে অনেকেই খুশি হয়েছেন, বিজয় মিছিলের খবর যদিও মেলেনি তারপরও কারও কারও কাছে এ যে এক বিজয়— তা বোঝা যায় প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু ঘটনাটিতে স্বস্তি পাইনি আমি, আর আমার টেবিল জুড়ে ধ্রুবতারার মতোন জ্বলতে থাকা একটি বই। বইটির নাম— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। আমরা দুজন মিলে বেশ বুঝেছি যে— এদেশে এখন সবাই অস্থির; এখানে নাস্তিকরা ভালো নেই, সংশয়বাদীরা ভালো নেই, আস্তিকরা ভালো নেই। সবাই অস্থির হয়ে আছে, কারণ সবাই চাই নাস্তিকতা, সংশয়বাদীতা কিংবা আস্তিকতার সনদ জাহির করতে। আস্তিকদের কাউকে দেখিনি ইমাম গাজ্জালীর দর্শন নিয়ে কোনো লেখা তৈরি করতে, গৌতম বুদ্ধের জীবনীর আলোকে একটি অসাধারণ না হোক, সাধারণ ছোটোগল্প লিখতে, ইসলামের শেষ নবী এবং দার্শনিক মোহাম্মদের বিদায় হজ্বের ভাষণের দার্শনিক আলোচনা কিংবা কোরআনের কাব্যিক মাধুর্য নিয়ে কোনো লেখা আমার চোখে পড়ে না, ব্লগে কিংবা ফেসবুকে। অন্যদিকে নাস্তিকদের হয়েছে ‘ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর’ অবস্থা। নাস্তিকতার ‘ফ্যাশন’ টেকাতে গিয়ে এদের পায়জামা ঠিক থাকে তো, চাদর ভূ-লুণ্ঠিত, আবার চাদর ঠিক তো পায়জামা ‘চিচিং ফাঁক’। আর সংশয়বাদীদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না, বস্তুত ‘মেরুদণ্ডহীন’ শব্দটির মানে ‘মেরুদণ্ড নাই’।
কিন্তু মূলত দুই সম্প্রদায়ের মানুষ (আস্তিক ও নাস্তিক) ধর্ম-দর্শন বা নাস্তিক্য-দর্শন দিয়ে সত্য উদঘাটনে যতোটা না চিন্তিত, তার চেয়েও বেশি চিন্তিত ‘ঘুম হইতে জাগিয়া যাহা পাইলাম, তাহা লইয়া’ ফেসবুকে বা ব্লগে একটা পোস্ট দেয়া। এতে সঙ্কট ঘনীভূত হয় দুইভাবে— এক, ধর্ম তার দর্শন সত্তা হারিয়ে মৌলবাদী রূপ ধারণ করে এবং দুই, নাস্তিক্যবাদ তার যুক্তি ও দর্শন-প্রসূত ভাবনার অক্ষাংশ থেকে সরে গিয়ে ‘নামকাওয়াস্তে নাম কামানোর’ ফ্যাশনে পরিণত হয়। দুটোই ভয়ঙ্কর, কারণ দুই ক্ষেত্রেই মুষড়ে পড়ে চিন্তার জোছনা, গভীর ভাবনার স্রোত ঘোলা জলে পাক খায়।
ফলে দুই দলই দিনে দিনে মৌলবাদের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের ওপরে বাঙলায় লেখা কিংবা অনূদিত একটি ভালো বই পাওয়া যায় না, কিন্তু মোহাম্মদকে বা ধর্মগুরুদের কটাক্ষ করে লেখার কোনো অবশেষ নেই। কিয়াস কিংবা তাসাওফ নিয়ে ‘আধুনিক প্রকাশনী’র মতো চতুর্থ শ্রেণির প্রকাশনী থেকে বের হওয়া ভুল বানান আর বাক্য-গঠনের বই ছাড়া আর কোনো বই তেমন চোখে পড়ে না (সাধারণদের জন্যে, গবেষকদের জন্যে অবশ্য ভালো ভালো বই পাওয়া যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে— কিন্তু সেগুলো সাধারণের বোধগম্য হয় না)। এই সঙ্কটে ফায়দা তুলছে আরেকটি গোষ্ঠী, যারা কোনোদিন ধর্মভীরু নয়, ধর্ম-লেবাসী আর ফ্যাশন সর্বস্ব নাস্তিকদের তারা পোষে কারণ তাতে ‘ধর্ম গেলো’ বলে জিকির তোলা যায়। এই ‘সুবিধাভোগী’ শ্রেণি রাষ্ট্র-সমাজ কিংবা ধর্ম-প্রতিষ্ঠানে পুঁজি তৈরি করে, এবং তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করে। এ সত্য বিষয়ে ইতিহাস চিহ্ন বহন করে।
আদালতের আদেশটি পড়া হলে দেখা যায়, সেখানে ‘ধর্মানুভূতির’ কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কেবল প্রথম দুই লাইনে। এরপরে যা বলা হলো— তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, আদালত ধর্ম বলতে কেবল ইসলাম ধর্মকেই বোঝে এবং সেই মর্মেই আদেশটি দেয়া হয়েছে। তাহলে ‘ধর্মানুভূতি’ শব্দটির ব্যবহার কেনো? ফেসবুক খুঁজলে দেখা যাবে— সেখানে অজস্র পেইজ রয়েছে যেগুলো ক্যাথলিক ধর্মানুসারীদের কটাক্ষ করছে, অনেকগুলোতেই দেখা যাবে হিন্দু দেব-দেবীদের নিয়ে উপহাস এমনকি যৌন-বিষয়ক গল্পেও তার ব্যবহার করা হচ্ছে— আদালত কী সে বিষয়ে কিছু বলবে না? যদি না বলে, তবে ধরেই নিতে হবে, আদালত কেবল একটি ধর্ম দিয়েই গোটা ‘ধর্মানুভূতির’ ধারণাকে বিচার করতে চাইছে, যেটা ‘ধর্ম’ শব্দটির মূল ভাবগত অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক, এমনকি বাংলাদেশ সৃষ্টির যে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ— তার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আদালত একচোখা আদেশ করেছে, এবং আদেশটি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
আমাদের মধ্যমেধার বৃদ্ধিজীবী ও সুশীতল সুশীল
উল্লিখিত সাংবাদিক ভাষ্যে আমি দুইজন ব্যক্তির নাম লক্ষ্য করেছি। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাতুল সারওয়ার এবং অন্যজন ঢাকা সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনোমিকসের অধ্যক্ষ এম নূরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের শিক্ষক আছেন— একদল আদর্শ ও চেতনাপন্থী— তাঁদের দেখলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, তাঁদের দীর্ঘ ছায়ার নিচে দাঁড়ালে নিজেকে অনেক বড়ো মনে হয়; অন্যদল নর্দমাপন্থী— এদের সারা শরীরে বিষ্ঠার উৎকট গন্ধ, এদের একবার দেখলে আমরা তিনদিন ভাত খেতে পারি না, রুচি হয় না বলে।
আমি ইংরেজি বিভাগের অনেক শিক্ষকের নাম শুনেছি— জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, খান সারওয়ার মুরশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কায়সার মোঃ হামিদুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফকরুল আলম প্রমুখ। কিন্তু এই বাতুল সারওয়ারের নাম আমি শুনিনি— এটা সম্ভবত আমারই অক্ষমতা, কারণ অকার্যকরদের নাম শোনার ধৈর্য আমার নেই।
এই আদেশটিকে যদি কফিনের শেষ পেরেক বলি— তবে তা এখন কেউ মানতে চাইবেন না— কিন্তু দেখবেন, যদি এখনই এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান তৈরি না করা যায়— তবে একদিন এমন আদেশও আদালত দিতে পারে যে, রাজাকার গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদসহ অনেকের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ উত্থাপনই ধর্মানুভূতিতে আঘাতের সামিল। সেদিন কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতে হবে, না হলে, আলতাফ মাহমুদ যেমন মাটি খুঁড়ে অস্ত্র রেখেছিলেন, সেভাবে বাড়ির সামনের মাটি খুঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের বই লুকিয়ে রাখতে হবে। আর যদি ভেবে থাকেন— পরের বার সচেতন হবেন, তো ভুল করবেন; কারণ, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’— কথাটা প্রবাদের বই থেকে নয়, আইএসআই– এর বর্বর-নির্লজ্জ ইতিহাস থেকে জেনে নেবেন।
বাঙলাদেশে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হতে পারতো। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় যেভাবে সারাদেশে ভুল মাপে ভিনদেশের পতাকা ওড়ানো হয়, সংবিধান অনুযায়ী তা বিধিসম্মত নয়। বাঙলাদেশ পাকিস্তানের খেলাতে যে রকম নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানের চাঁন-তারা মার্কা বেঈমান পতাকাটি গালে মুখে এঁকে কুলাঙ্গাররা উল্লাস করে— সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল। এই ঘটনাগুলোর সময় কোথায় ছিলো আদালত? কোথায় ছিলো ব্যারিস্টার মুহাম্মদ নওশাদ জমির?
বাতুল সারওয়ারের ক্যাম্পাসে যখন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে মৌলবাদীরা রক্তাক্ত করলো, তখন সে কোথায় ছিলো? রুমানা ম্যাডামের ব্যাক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে যখন ফেসবুকে, ব্লগে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেতাই উপস্থাপন হচ্ছিলো, জাফর ইকবাল স্যারের সন্তানকে নিয়ে যখন ‘মুখে যা আসে’ বলে যাচ্ছিলো বাতুলের বাতিলেরা— তখন কোথায় ছিলো এই ‘সুলভ সংস্করণের বুদ্ধিজীবী’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাদেরকে যখন পুলিশ হেনস্তা করলো, বাতুল সারওয়ার কি তখন বিভ্রান্ত মহাকবি এলিয়টের স্কচের গেলাসে ডুব দিয়েছিলো?
ফেসবুকে অন্তত একশ পেইজের নাম বলে দেয়া যাবে— যেগুলোর নামই নারীদের জন্যে অপমানজনক। প্রতি মুহূর্তে সেই পেইজগুলোর মাধ্যমে বাঙালি নারীর প্রতি অবজ্ঞা, অশালীনতা আর অশোভনতা প্রকাশ পায়। এগুলো একদিকে যেমন আমাদের সংস্কৃতির স্নিগ্ধ প্রদীপে অসুরের বাতাস দিচ্ছে, অন্যদিকে বাঙালি নারীকে উপস্থাপন করছে বিকৃতরূপে। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে— ওইসব পেইজের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে আরও কিছু পেইজের বক্তব্য, যারা ফটোশপে ছবি সম্পাদনা করে হাস্যকরভাবে স্রষ্টার মাহাত্ম্য বাড়াতে চায়। তার মানে দাঁড়াচ্ছে— যারা ইসলামকে উচ্চ করার নামে বুলি সর্বস্ব পেইজ খুলছে, তারাই আবার ইসলাম-পর্দা-শরীয়তের দোহাই দিয়ে বাঙালি নারীদের অপমানজনক ছবি প্রকাশ করছে এবং অশালীন মন্তব্যও করছে। এবার যদি সমীকরণের বামপক্ষ আর ডানপক্ষ মেলাই, তবে দেখা যাবে, গোটা সমীকরণটা আসলে একটি ধর্ম-কেন্দ্রীক উগ্র-জঙ্গীগোষ্ঠী, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বা তাদের ছাত্র-সংগঠন বা তাদের অন্তর্বাস সংগঠনগুলোর মূল বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য। হায় রে গণিত! বাতুল সারওয়ার সবই বুঝলো, গণিত বুঝলো না
আমাদের আদালত আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়। সে আশ্রয় প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েছে বহুবার। ‘বিব্রতবোধ’ সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ‘আইনজীবীদের হাতাহাতি’ পর্যন্ত আমরা দেখেছি, কষ্ট পেয়েছি এবং পুনর্বার আশায় বুক বেঁধেছি। কোনো ধর্মকেই খাটো করে দেখবার সংস্কৃতি বাঙলার কোনো কালেই ছিলো না, সেই মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত— কেউই তা করেননি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’— এই স্লোগানে আমরা যুদ্ধ করেছি অসাম্প্রদায়িক বাঙলাদেশ গড়বো বলে। কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার পর ধর্ম আর রাজনীতির সঙ্কর প্রচেষ্টায় বিপন্ন হয়েছে ‘ব্যক্তির ধর্ম’ এবং ‘রাষ্ট্রের সংবিধান’। ফলে দুটোই পড়েছে টানাটানির মধ্যে— মাঝখান থেকে বাদ পড়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। দর্শনভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চার মৃত্যু ঘটেছে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট আর চৌঠা নভেম্বরের পরে, আর একই সাথে ক্যান্টনমেন্টের ছাদনাতলায় গাঁট বেঁধেছে উর্দি আর মোল্লাটুপি। এরপর অন্ধকার। এবং অন্ধকার।
সেই অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসতে আসতে চল্লিশ বছরের তরুণী— এই বাঙলাদেশ— এখন দিকভ্রান্ত এবং তাকে প্রতিনিয়ত আরও দিকভ্রান্ত করে তোলা হচ্ছে। যদি এখনই প্রতিরোধ না করেন, যদি এখনও মনে করেন, সামনের আকাশটা নীল— তবে ভুল করছেন, ভুল ভাবছেন।
সময় গেলে তো আর সাধন হয় না।
০৮ চৈত্র ১৪১৮