আজ ১০ ডিসেম্বর।
একেবারে গুণে গুণে চল্লিশটি বছর আগে চলে যান। সময়কাল ১৯৭১ সাল। ১০ ডিসেম্বর। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাঙালি— একেবারে চেতনার অগ্নিগর্ভ মশাল জ্বালিয়ে বাঙালি তার স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনছে, জয় বাঙলা ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে দশদিক।
একাত্তর সাল বাঙালির নির্ভিক প্রেরণার উৎস; কথাটাকে আরও একটু খোলাসা করা দরকার। বাঙালির আত্ম-পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটি শুরু হয় অনেক আগে থেকেই, কিন্তু ১৯৪৮ সালে তা একটা প্রথম প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তারপর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ— এই ঐতিহাসিক ধাপগুলোর মাঝেও নির্মাণ-বিনির্মাণের একটি রসায়ন আছে। অর্থাৎ সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাঙালি একটি মিলিত শক্তিতে রূপ লাভ করে; যা সাতই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিলো। এখন সাতকোটি জনতা যদি ছবির একেকটি পিক্সেল হয়, তবে গোটা ছবিটাই বঙ্গবন্ধু। আর কেউ যদি প্রশ্ন করে সেই সাতকোটি জনতার বুকে এই নিবিড় উচ্চতা কারা প্রদান করেছিলো; তবে যাঁদের নাম আসবে, তাঁদের মাঝে শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন একজন।
শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁরই রচিত একটি গ্রন্থের মাধ্যমে। সেই গ্রন্থটিরও একটি ইতিহাস আসে। সোসাইটি ফর পাকিস্তান স্টাডিজ প্রকাশ করেছিলো গ্রন্থটি Day’s Decisive শিরোনামে। দেশ স্বাধীন হবার পর ওই বইটি Look into the Mirror শিরোনামে বের করে খোশরোজ কিতাব মহলের স্বত্বাধিকারী জনাব মহীউদ্দীন আহমদ। Day’s Decisive গ্রন্থটির একটি কপি এখনও আমাদের আর্কাইভে আছে; ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারিতে সে বইটি আমি পড়েছিলাম সেখানে বসেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার ছিলো বলে, বইটির আলোক প্রতিলিপি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাই সেদিনের নেয়া নোট থেকেই এখানে উদ্বৃতি দেয়া হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিপীড়ন-নির্যাতনের নানা তথ্য নানাদিকে ছড়িয়ে আছে; সেগুলো এক সাথে করার নানা চেষ্টাও করা হয়েছে; নানাবিধ চেষ্টা সফলও হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের মুখের সামনে বাঙলার শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সত্য ঘটনা ও দলিল-দস্তাবেজ উপস্থাপনের মাধ্যমে এমন একটি গ্রন্থ রচনার জন্য মেরুদণ্ড লাগে। শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন সেই ঐতিহাসিক সত্যের অকপট প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তাঁর সেই অসামান্য গ্রন্থটিতে। কলেজ জীবনে আমি নীরোদ সি চৌধুরীর ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের প্রেমে পড়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা সেই ইংরেজি গ্রন্থখানি আমায় যারপর নাই অনুপ্রাণিত করেছিলো। গ্রন্থ রচনার কৈফিয়ত হিসেবে তিনি লিখেছিলেন—
.. ..But the sacrifices made during the struggle were certainly not equal nor was the commitment made to the ideals of Pakistan by the provinces now comprising West Pakistan so whole hearted and total as it was in the case of Bengal. And possibly that is why, even an area where 97 percent population was Muslim joined Pakistan on the strength of only 50.8 percent of votes in favour of Pakistan, while Bengal with a 54 percent Muslim majority decided in favour of Pakistan by casting 98 percent of votes in its favour. These are facts which should be recorded with impartiality, faithfulness and truthfulness that they deserve…
গ্রন্থটি তিনি উত্সর্গ করেছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। পরবর্তীতে তিনি এই ভূমিকা লেখার স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন—
তরুণ বন্ধু ও আমার সাংবাদিক জীবনের এককালীন সহকর্মী জনাব সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর নতুন রেখা বই Day’s Decisive– এর ভূমিকা রচনার প্রস্তাব নিয়ে আসেন আমার কাছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ‘কে কাকে পরিচয় করার দায় নেবে, ভাই! সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার প্রখ্যাত নিউজ এডিটর হিসেবে আপনিই বরঞ্চ আমাকে লোকসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব নিতে পারেন। আর আমি কি না…।’ তিনি কিন্তু শুধুই হেসেছিলেন।
Day’s Decisive গ্রন্থটি ছোট কিন্তু তাৎপর্যে ও বিষয়বস্তুতে গভীর। আদি থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাসের এক নির্মোহ সংযোজন এই গ্রন্থটি। কিন্তু লেখার কায়দাটি এমনই নিটোল যে— পড়লে মনে হয় ছোটো ছোটো সংক্ষিপ্ত খণ্ড পড়ছি। পাকিস্তান অর্জনকল্পে বাঙালি মুসলিম যে ভয়াবহ ত্যাগ ও অসামান্য অবদান রেখেছে আর তার বিপরীতে তাকে যে নিগ্রহ ভোগ করতে হয়েছে— তার সংক্ষিপ্ত বয়ান এই গ্রন্থের মূল আকর। যে সমস্ত ঘটনা ও তথ্য প্রমাণের দলিল তিনি উপস্থাপন করেছেন এই গ্রন্থে— তা আজকের দিনে বসে পাঠ করলে বিস্মিত হতে হয়। কেননা, এই তথ্যগুলোর সিংহভাগই এখন আর আমরা পাই না। মজার বিষয় হলো— তাত্ত্বিক নানা দিকের বিবরণ তথ্য-প্রমাণাদিসহ উপস্থাপিত হয়েছে কিন্তু এর ভাষা এতোটাই প্রাঞ্জল যে— বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। স্বদেশপ্রেমের এক নিটোল উৎকল্পনা পাওয়া যায় গোটা লেখাতেই। লেখনীর ধরণ অনেকটাই প্রতিনিধিত্বকারীর মতো। বাঙলার লক্ষ-কোটি লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী হিশেবে লেখক লিখে গেছেন গ্রন্থটি। বুলগেরিয়ার লেখক অ্যান্টন ডলশেভের লেখা একটি বই পড়েছিলাম ঢাকা কলেজের লাইব্রেরিতে। দ্য টাই অব পার্টিং নামের বইটি উপন্যাস বলে লেখক ভীষণ সাবলীলভাবে উপস্থিত থাকতে পেরেছেন। কিন্তু Day’s Decisive বইটি গবেষণাভিত্তিক অথচ লেখক এতো প্রাণবন্তভাবে সেখানে উপস্থিত থেকেছেন— যা অকল্পনীয়। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম— বাঙলার ইতিহাসের এই তিন পুরুষকে এতোটা গ্রহণযোগ্যভাবে এর আগে কেউ চিত্রিত করতে পেরেছেন বলে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে পড়ে না। বিশেষ করে এই তিনজন সম্বন্ধে বইটিতে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন যে তথ্যাদি উল্লেখ করেছেন— তা দুষ্প্রাপ্য তো বটেই— আমার মনে হয়, এগুলো নিয়ে এখনও তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো— গ্রন্থের শেষে সংযোজিত পরিশিষ্টটি। আজকের দিনে যে মানুষ বই-ই পড়ে না, তাকে যদিও পরিশিষ্টের কথা বলে লাভ নেই— তবুও এটুকু নিজের জন্যই তুলে রাখা যে— পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে যারা কাজ করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই পরিশিষ্ট হীরকখণ্ডের মতোন।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শালিখা থানাধীন শরগুনা গ্রামের একটি পরিবারে। মাত্র তিন বছর বয়সেই পিতৃহারা হন। পরিবার পড়ে যায় অকুল পাথারে। এ সময় তাঁর বড়ো চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক এম.এ.বি.টি. পিতৃহারা ভাইপো-ভাইঝিদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। চাচার কাছে থাকাকালে সিরাজুদ্দীন হোসেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুল, যশোর জেলা স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন। তিনি স্কুল জীবনের শেষে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে আই.এ ভর্তি হন। আই.এ পাশ করে কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ পড়া শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। একই বছর ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ‘দৈনিক আজাদে’ সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং কালক্রমে আজাদের বার্তা-সম্পাদক পদে উন্নীত হন। সমসাময়িককালে তাঁর মতো এতো অল্প বয়সে বার্তা সম্পাদক হবার গৌরব কেউ অর্জন করেননি। অতএব আধুনিক গণমাধ্যম যতো যাই বলুক না কেনো— সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন সাংবাদিকতা জগতের এক বিরল প্রতিভা।
১৯৫৪ সালে আজাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। সে সময় তিনি কিছুদিন ঢাকাস্থ ইউ.এস.আই.এস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসেবে কাজ করেন। এক বছর পর তিনি ইত্তেফাকের বার্তা-সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। সুদীর্ঘকাল তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭০ সালে তিনি ইত্তেফাকের কার্যকরী (বর্তমানে কার্যনির্বাহি) সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরই ফাঁকে তিনি কিছুদিন ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্সের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকতার উন্মেষে ও উত্কর্ষ বিধানে তিনি অবস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। সংবাদ রচনায় তাঁর অনবদ্য লেখনীর গল্প শোনার এবং তার কিছু কিছু পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের গণমাধ্যমগুলোর মাঝে অন্যতম ছিলো দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক সংবাদ। বলাই বাহুল্য, সে সময় এই দুইটি গণমাধ্যম আক্ষরিক অর্থেই গণমাধ্যমের আধুনিক ধারণাকে লালন করেছিলেন এবং তাদের বাস্তবায়নের পথে এই ধারণাকেই তারা কাজে লাগিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে বাঙালির আত্ম-পরিচয় নির্ধারণ এবং তার রাজনৈতিক বিকাশ জরুরি ছিলো। একদিকে ধর্মের তকমায় সাজানো হচ্ছিলো শয়তানের পাকিস্তানি দাবার ছক; অন্যদিকে প্রস্তুতি চলছিলো রাজনৈতিক চালের। এই দুইটি বিষয়— অর্থাৎ আত্ম-পরিচয় অন্বেষণে সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা সন্ধান এবং নিজস্ব জাতীয়তাবোধকে রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। প্রথম কাজটি দৈনিক সংবাদ করেছিলো জহুর হোসেন ও শহীদুল্লাহ কায়সারের নেতৃত্বে আর দ্বিতীয় কাজটি, অর্থাৎ রাজনৈতিক দৃশ্যায়নের বিন্যাস রচনা করেছিলো দৈনিক ইত্তেফাক— মানিক মিয়া ও সিরাজুদ্দীন হোসেনের নেতৃত্বে। ফলে যে সংবাদের শিরোনাম দৈনিক সংবাদ করেছিলো— ‘মৃত্যু দিয়েছে মিছিলের স্বর, জীবনের ঐশ্বর্য’— সেই একই সংবাদের শিরোনাম দৈনিক ইত্তেফাক করেছিলো— ‘বাঙালির ’পরে গুলি’। সংবাদের হেডিং-এ কবিতার স্ফূরণ আর ইত্তেফাকের হেডিং-এ ‘বাঙালি’ শব্দটির ব্যবহার মাত্রেই জাতির রাজনৈতিক স্থানটি নির্দিষ্ট হয়েছিলো। এই হচ্ছে সাংবাদিকতা, এর নাম গণমাধ্যম।
তত্কালীন ইত্তেফাকের সংবাদ শিরোনাম, বিবৃতি, উদ্বৃতি এমনকি ইনসেট পর্যন্ত ছিলো শ্রুতিগ্রাহ্য ও দৃষ্টিনন্দন। এই ‘দৃষ্টিনন্দন’ কিন্তু চর্মের চক্ষুর নয়, মরমের চক্ষুর। এর পেছনে ছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর স্বলিখিত সংবাদভাষ্য, বিবরণী বা রাজনৈতিক সংবাদ পরিক্রমার ভিতর দিয়েও অগ্নিসম লেখনী বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটতো। তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক প্রতিভা দ্বারা দৈনিক ইত্তেফাককে এমন একটি উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতার পর থেকে নানা কারণে নৈতিকতার স্খলন ঘটাতে ঘটাতে ন্যাক্কারজনক ক্রমাবনতির পরেও ইত্তেফাক এখনো দৃষ্টি সীমানায় আসে। পুরো ইত্তেফাক মানিক মিয়া এবং শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের আদর্শ থেকে কেবল সরেই আসেনি, তাঁদের আদর্শের পরিপন্থী কাজও শুরু করে দিয়েছে বহু আগে থেকেই।
১৯৬৬ সালে আইয়ুব দুঃশাসনের সময় ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন তিনি কিছুদিন সংবাদ প্রতিষ্ঠান পি.পি.আই-এর ব্যুরো চীফ নিযুক্ত হন। পরে ১৯৬৯ সালে পুনরায় ইত্তেফাক প্রকাশিত হলে তিনি পি.পি.আই পরিত্যাগ করেন। ফিরে আসেন ইত্তেফাকে।
ষাটের দশকে সিরাজুদ্দীন হোসেন এক অসাধারণ কাজ করেন। ছেলেধরা বিষয়ে তিনি পুলিশের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। সে সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু অপহৃত হচ্ছিলো। দৈনিক ইত্তেফাকে সম্পর্কিত খবরও ছাপা হচ্ছে নিয়মিত। পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কবাণী ছাপা হচ্ছে। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারী দলের কারসাজির ফলেই যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে— সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু পুলিশের আইজি এক সংবাদ সম্মেলন করে মন্তব্য করলেন, শিশু অপহরণের এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর পিছনে কোনো সংঘবদ্ধ সংগঠিত দল নেই। আইজির সংবাদ সম্মেলনের কথাও ছাপা হলো ইত্তেফাকে৷
সিরাজুদ্দীন হোসেন পুলিশের এই মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলে শিশু অপহরণের এক বিরাট কাহিনী উদ্ঘাটিত হয়। তত্কালীন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ভালুকা— এই তিন থানার বিরাট সীমান্ত অঞ্চল ছিলো গোচারণ ভূমি। লম্বা লম্বা ঘাস মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যেতো। ফলে বাইরে থেকে বোঝা যেতো না, সেখানে কারা আছে। গোচারণ ভূমির মাঝে মাঝে ছিলো চালাঘর। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারীরা ছোটো ছোটো ছেলেদের চুরি করে এই গোচারণভূমিতে নিয়ে আসতো। লোক-চক্ষুর অন্তরালে শিশুদের দেয়া হতো অসামাজিক কাজের প্রশিক্ষণ। কোনো কোনো শিশুর হাত-পা কেটে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষার কাজে লাগানো হতো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই অপকর্ম করে যেতো তারা। শিশু অপহরণকারীদের এই স্বর্গরাজ্য আবিষ্কৃত হলো সিরাজুদ্দীন হোসেনের উদ্যোগে। সত্তরেরও বেশি শিশুকে উদ্ধার করা হলো। আইপিআই (ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট)-এর ক্রোড়পত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেন ও উদ্ধারকৃত শিশুদের নিয়ে ছাপা হলো প্রতিবেদন। এ জন্য তিনি ম্যাগসেসে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
অবরুদ্ধ নগরীতে বসে মুক্তিযোদ্ধা পুত্রকে লেখা শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের শেষ চিঠি
১১ অক্টোবর, ১৯৭১
স্নেহের শামীম,
কারো কোন বিপদে এখন আর এক পয়সার সাহায্যও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য।
সারাজীবন পরিশ্রম করে আজ বলতে গেলে একেবারে নূতন করে সংসার যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে। কোন অপঘাতে যদি মৃত্যু হয়, জানি না কোন অকুল পাথারে সকলকে ভাসিয়ে রেখে যাব। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সংসার জীবনে এমনি করে পিছনে ফিরে যেতে হবে। এ বয়সে নূতন করে দুঃখ কষ্টের মধ্যে যাওয়ার মত মনের বল আর অবশেষ নেই। যা হোক, তোমাকে আশীর্বাদ করি, জীবনের সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে সামনে এগিয়ে যাও। আমার বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্কে যে কথা লিখেছ, ওতে আমি বিস্মিত হইনি, কারণ, আমি অনেকের বন্ধু হলেও কেউ আমার বন্ধু ছিলো না। কারণ এ সংসারে সকলেই স্বার্থের দাস, জীবনের মহত্বের গুণাবলী ক’জনের আছে। আমার জীবনে অপরিচিত জন ছিল যাঁরা বিপদে-আপদে তাঁরাই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, পরিচিত কোন বন্ধুজন নয়।
শুনে খুশী হলাম, তুমি মানিকের স্নেহাস্পর্শে আছ। ওদের ক’জনকে আমি বরাবর স্নেহের নয়, শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছি। ওকে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।
ইতি
আব্বা
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সাহসী কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাকের বর্তমান উপদেষ্টা সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিলনের অশ্রু আখেরে লেখা যার নাম স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধটিতে।
সিরাজ ভাই, রেজা ভাই আমি সহ ক’জন আটকা পড়ে আছি ‘ইত্তেফাক’ অফিসে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ আর মানুষ-জন্তুর উল্লাস ধ্বনি। উত্কণ্ঠিত চিত্তে আমরা প্রতীক্ষা করছি পরিণতির। সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই গিয়ে দাঁড়ালেন বিধ্বস্ত ‘ইত্তেফাক’ এর টেম্পোরারি শেডের জানালার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো এক ঝাঁক গুলি। কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেন তাঁরা। কিন্তু বাঁচলো না আমাদের সঙ্গে থাকা অন্য দু’জন। জীবন-মৃত্যুর জুয়া খেলার ভেতর দিয়ে সারাদিন অতিবাহিত করার পর অপরাহ্নে প্রজ্জলিত ইত্তেফাক থেকে জীবন বাজি রেখে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দেয়াল টপকে আমরা আত্মরক্ষা করলাম পাশের বাড়িতে পৌঁছে। .. ..তার পরবর্তী ন’মাস আমি ছিলাম সিরাজ ভাইয়ের নিকট সান্নিধ্য। স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। টিক্কা ঠাকুরগাঁয়ে নামতে সাহস পায়নি এ সংবাদ পাঠ করে তিনি আনন্দে নেচে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই তো শুরু’। এর কয়দিন পরেই ইত্তেফাকের পাতায় ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ রাজনৈতিক পর্যালোচনাটি লেখেন। এ রাজনৈতিক সমীক্ষাটি পাঠ করে অনেকে আশ্চর্য হয়েছিলেন। সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এত বড় সাহস কার’। আর এই সমীক্ষা প্রকাশিত হবার পর অজ্ঞাত পরিচয় সূত্রের এক চিঠিতে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের দালালদের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে।’ মনে পড়ে, এই চিঠিটা যখন সিরাজ ভাই আমাকে দেখান আমি তাঁকে বলেছিলাম, আর না চলুন আমরা তাড়াতাড়ি গুটাই। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘এত ভয় করলে চলবে কেন, দেখ না যার জন্য অপেক্ষা করছি সে এল বলে।
সিরাজ কে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে?— বঙ্গবন্ধু
গতকাল শনিবার লণ্ডন হইতে ঢাকায় বঙ্গভবনে টেলিফোনে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির গণসংযোগ অফিসার ও দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক রিপোর্টার সৈয়দ শাহজাহানকে জিজ্ঞেস করেন: “সিরাজ কে কি সত্যিই ওরা মেরে ফেলেছে?” উত্তরে বলা হয়: “হ্যাঁ”। বঙ্গবন্ধু বলেন: “আহা”। উল্লেখযোগ্য যে বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যেই দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক (সাবেক বার্তা-সম্পাদক) জনাব সিরাজুদ্দীন হোসেন পাক সামরিক জান্তার পক্ষপুষ্ট আলবদর কর্তৃক নিহত হবার সংবাদ শ্রবণ করিয়াছেন। দৈনিক ইত্তেফাক: ৯.১.১৯৭২
সিরাজুদ্দীন হোসেনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন—
যাঁহারা ইতিহাস রচনার যোগ্যতা রাখেন, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁহাদের অন্যতম। সিরাজের রক্তসিক্ত মাটিতে আমরা সোনার ফসল ফলাইব। শহীদ সিরাজ অর্থ উপার্জনকে বড় করিয়ে দেখেন নাই, বরং সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণের সেবা করিয়াছেন। একনিষ্ঠ দেশসেবক সিরাজুদ্দীন হোসেন যে ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছেন, জাতি সেই পথ অনুসরণ করিয়া ভবিষ্যতের দিকে আগাইয়া যাইবে। সেদিনের বহু নিম্নমানের সাংবাদিক ট্রাস্ট পরিচালিত কাগজে কাজ করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়াছেন, কিন্তু আদর্শবাদী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন তাহা করেন নাই।
কিন্তু হায়— সিরাজুদ্দীন হোসেনের মৃত্যুর সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদকেও। তাঁরও মূল্যায়ন হয়নি। এ জাতি কি মূল্যায়নে সত্যিই কৃপণ?
১৯৭১ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার পাঁচ নম্বর চামেলীবাগের বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় আল-বদররা। তারপর আর কোনো খোঁজ মেলেনি তাঁর। ১৭ ডিসেম্বর সিরাজুদ্দীন হোসেনের পরিবার জানতে পারে রায়েরবাজার বধ্যভূমির কথা। সেখানে তাঁরা খোঁজ করতে যান; কিন্তু সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ। কিন্তু সেই আল-বদরের বংশধরেরা এখনো জীবিত। এখনো এই পশুরা নানাভাবে একাত্তরের নানা ইতিহাসকে বিকৃতি করার অপচেষ্টায় রত। এইসব অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেবার যুদ্ধে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন আমাদের অনুপ্রেরণা।
মাঝে মাঝে বুকের ঘরে মোমবাতি জ্বলে। প্রসন্ন অতীত এসে জমা হয় শিয়রের কাছে। প্রাণময় রোদ কখনো কখনো ছুঁয়ে যায় আমাদের করতল। তখন নতুন করে পড়ে নিতে হয় নিজস্ব পরিচয়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের শিরোনামটি ঠিক করে দেবেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন; ইনসেট সিলেকশনটাও শিখিয়ে দেবেন আমাদের; আর আমরা, যারা বিজয়ের চল্লিশ বছর উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি— তারা সেই ইতিহাসের আলোতে নিয়ত স্নাত হবো। মিডাসের মতোই সিরাজুদ্দীন হোসেন নিয়ে যাবেন আমাদের ইতিহাসের স্বর্ণালেখ্য কিংবদন্তীতে।