মঞ্চে আলো জ্বলে উঠলে মিলনায়তনে নেমে আসে অন্ধকার। খানিকটা অশরীরী অন্ধকার। কিংবা এ অন্ধকারকে বলা যেতে পারে আমাদের চৈতন্যের মুদ্রাদোষ—যা সংক্রমিত হচ্ছে, গ্রাস করছে আমাদের সর্বস্বকে এবং শেষতক আছড়ে পড়ছে আমাদেরই গড়ে তোলা সমাজে-রাষ্ট্রে-প্রতিষ্ঠানে। সময়ের বিচারে কতোগুলো শব্দ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, অথচ সেই সব শব্দের শব ঘিরে আমাদের আয়োজন আজও অটুট। এবং এ আয়োজনও আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়; আমরা চাই আমাদেরই ছাঁচে গড়ে উঠুক বাকি সবাই। আমাদেরই ছাঁচে—মানে, যে ছাঁচটি কেবলই আমাদের। আমাদের বাক্যে-মর্মে-ছন্দে বানানো বাণীগুলো মানতে হবে সকলকে। সকলকেই। এই ‘আমাদের’ কথাটিও অবিভাজ্য নয়। হাজার হাজার দলে, গোষ্ঠীতে বিভক্ত এই ‘আমরা’। আর যারা এই সকল ‘আমরা’ ‘আমাদের’ বাইরে—তারা কেবলই ভাগশেষ। তাকে বাদ দিতে হবে।
স্কুল শিক্ষক বার্ট্রাম কেইটস এভাবেই বাদ পড়েন। তাকে বাদ দেয়া হয়। যেভাবে বাদ দেয়ার পাঁয়তারা হয় বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল কিংবা কলেজ শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে। মাংকি ট্রায়াল একটি সময়ের গল্প বলে চলে—যে সময়ে এখনও পেরিয়ে যেতে পারেনি মানুষ। যে সময়ের পাঁকে আটকা পড়ে দমবন্ধ পৃথিবী বারবার আর্তনাদ করে ওঠে—এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে। ফলে বাট্রার্ম কেইটস, যার জন্য আয়োজিত হয় মাংকি ট্রায়াল, তিনি কেবল একজন স্কুল শিক্ষক থাকেন না। কোপারনিকাস থেকে ব্রুনো, ডারউইন থেকে বিদ্যাসাগর, রাজীব হায়দার থেকে অভিজিৎ রায়—সকলেরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন তিনি। কালে কালে কতো মিথ্যেকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের শাস্ত্র, কতো সহস্র প্রথা আজও আমাদের মাথার ওপরে পাক খায় সর্বগ্রাসী ঘূর্ণির মতো—আমরা তা পারি না এড়াতে, আমাদের নিজেদেরই মুদ্রাদোষে। প্রকৃতির যে স্বাভাবিক ধারায় মানুষের বিবর্তন শুরু হয়েছে, সভ্যতা সে ইতিহাসের অংশীদার হলেও, তাকে স্বীকার করতে পারছে না। গালগপ্পের ঝুড়িতে ছেয়ে গেছে আমাদের চলার পথ।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টি কি কেবল বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের? নাকি তাদের আধিপত্যের। অন্তত মাংকি ট্রায়াল সৎভাবে সে প্রশ্নের উত্তরটি দিয়ে গেছে। ধর্ম-প্রথা-ব্যবস্থায় বিশ্বাস করার অধিকার যদি মানুষের থাকে, তবে অবিশ্বাস করার অধিকারও থাকতে হবে। আর যদি না থাকে—তবে কোনোটারই থাকবে না। এই যে সহজ সরল সত্য, তাকে জটিল করে তোলে কতোগুলো প্রশ্ন। আদালত যদি সত্যিই কেবল আইন দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে সে আইন কার স্বার্থে? তবে সে আদালতে ধর্মযাজকের ভূমিকা কি? এর উত্তর, এমনকি এ প্রশ্নটিও মাংকি ট্রায়াল ছুঁড়ে দেয়নি। কিন্তু নাটকটি দেখার পর আমরা যদি সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠা আইনের ইতিহাসটিও মনে করি—তবে বিস্মিত নয়, বিভ্রান্ত হই। যে আইনগুলো গড়ে উঠেছিল সম-সাময়িক প্রথা, রুচি ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, সময় পেরিয়ে গেলেও, সে আইনগুলো আজও রয়ে গেছে। কারণ, এগুলো গড়ে উঠেছিল ধর্মের বিধি-বিধানের সূত্র ধরে।
এই যে স্রষ্টার চেয়েও তারই নামের উপর গড়ে উঠা শাস্ত্র বড়ো হয়ে যায়, এটা কি একসময় স্রষ্টাকেই বৃত্তবন্দী করে না? মাংকি ট্রায়ালের কাঠগড়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ম্যাথিউ হ্যারিসন ব্র্যাডির বক্তব্য এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিশাল ভাবমূর্তির ধ্বসে পড়া সেই ইঙ্গিতই বহন করে বলে আমি অন্তত মনে করি। প্রসঙ্গত মনে পড়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার উপন্যাসটির কথা। কী অদ্ভুত আঁধার! তাকে কেটে বেরুনোর পথ তো দুরূহ বটেই, এমনকি যাদের হাত ধরে আঁধার নেমেছে, তারাও চাইলেই আঁধার নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। তাকে আমৃত্যু নির্বাসন জীবন কাটাতে হবে এই আঁধারের কেন্দ্রে।
সুতরাং, আবারও বলছি, প্রশ্নটি বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের নয়; তার আধিপত্যবাদের। বিশ্বাস যখন ব্যক্তিগত চৌহদ্দির নির্মলতা মাড়িয়ে রাষ্ট্র, সামাজ বা ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখনই বসে ট্রায়াল—সেটা বিবর্তনবাদ নিয়েও হতে পারে, পোষাকের স্বাধীনতা নিয়েও হতে পারে কিংবা জীবনযাপনের অভিরুচি নিয়েও হতে পারে। মাংকি ট্রায়ালে ম্যাথিউ হ্যারিসন ব্রাডির প্রসঙ্গে তারই প্রতিপক্ষ বার্ট্রাম কেইটসের আইনজীবী হেনরি ড্রামন্ড যখন মানুষের ধর্ম মানার অধিকারের পক্ষে সংলাপ দেন নাটকের একেবারে শেষদিকে, তখন দর্শকের করতালি বুঝিয়ে দেয়—সত্য মানুষ আসলে সত্যেরই পক্ষে—সেটা ফিলিস্তিনির মুক্তি-মিছিলেই হোক, সিরিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরেই হোক বা ইরানের অগ্নিগর্ভ রাজপথেই হোক।
জেরম লরেন্স ও রবার্ট এডউইন লি’র রচিত এবং মুক্তনীলের মঞ্চরূপ ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ মাংকি ট্রায়াল সেই সত্য মানুষের কণ্ঠস্বরটুকুই তুলে ধরে আমাদের সামনে। নাটকের কাঠামোতে বাতিঘরের ১৫তম প্রযোজনা মাংকি ট্রায়াল কতোখানি সফল, সেটা বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমি কেবল আমার যাপিত সময়ের সঙ্গে নাটকের অমলিন আখ্যান আর অভিনয়শিল্পীদের পরিশ্রমী প্রয়াসকে মিলিয়ে দেখেছি। সে অর্থে মাংকি ট্রায়াল আরও অনেকদিন, আরও অনেক মঞ্চে মঞ্চস্থ হওয়া প্রয়োজন। বাতিঘরের প্রয়োজনে নয়, নাটকের প্রয়োজনেও নয়—মানুষের প্রয়োজনে—যে মানুষের ঘরের মধ্যে আজ লক্ষ্মণরেখা, যে মানুষ বৃত্তবন্দী হয়ে কেবল ‘আমরা’ ‘ওরা’তেই আজ মত্ত।