ওগো ঢাকা: সুন্দরীতমা

‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’— কেমন ছিলো এই ঢাকা যখন রুদ্র লিখছেন আত্মরতির ঊর্ণায় আঁকা কবিতার এই ছাড়পত্রহীন খশড়াটি? কতোই বা বয়স ছিলো এই শহরের? পিচ ঢালা রাস্তা আর ল্যাম্পপোস্টের শাদা জ্বলজ্বলে বাতির শরীর ছুঁয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটি মানুষ এই শহরকে চেনেন যার যার মতো। এসব চেনা জানার কোনো লিখিত সংস্করণ নেই। এইসব চোখে দেখা প্রতিদিনকার ঢাকা শহরকে না পাওয়া যায় গুগল ম্যাপে, না অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কোনো বইয়ে। এই দেখে নেয়া, দেখার একঘেঁয়ে অভিজ্ঞতাটুকু নিয়ে ঘরে ফেরা— এসবই হৃদয়ের সঙ্গে পাথরের, নগরের সঙ্গে নাগরিকের অলিখিত সংলাপ। বর্ষার জলাবদ্ধতা, দুঃসহ ট্রাফিক জ্যাম, বৈধ-অবৈধ বিলবোর্ড, ফ্লাইওভারের প্রয়োজনীয়তা, মেট্রোরেলে উড়ে আসা উন্নয়ন ইত্যাদি সবই যখন তুলে নিয়েছে খবরের কাগজের রাজধানী পাতা; তখনও শাহাবাগ মোড়ের ট্রাফিক পুলিশের গোলাপ কেনার বাসনার মতো গোপন কিছু রয়ে গেছে নাগরিকদের কাছে একান্ত গোপনে। অন্তত এই বিচারে ঢাকার ইতিহাসকে এখনও বলার আছে— ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’। এখনও আবিষ্কার করা বাকি আছে রিকশা চালকের চোখের পিচুটির শব্দার্থ থেকে রাষ্ট্রপতির গাড়ি চালকের নিয়মবদ্ধ বাক্য রচনা অবধি। মানুষরহিত ইতিহাসের অব্যাহত চর্চাকে তাই জাদুঘরের ভল্টে তুলে রাখা হোক, সেখান থেকে বরং ফিরিয়ে আনা হোক জীবনের ঠাস-বুনোট। তা দিয়েই একদিন রচিত হবে ঢাকা শহরের মিথলজি থেকে মেলোড্রামা।

ঢাকেশ্বরী মন্দির (১৯০৪)

‘পুরোনো’ শব্দটির নতুন জন্ম হয়েছে, সন্দেহ নেই। আমাদের কৈশোরে আমরা ‘পুরোনো দিনের গান’, ‘পুরোনো দিনের ছায়াছবি’ পর্যন্ত শুনেছি। এখন মোবাইল পুরোনো হয়, প্রেমিকা পুরোনো হয়, অ্যানড্রয়েড আইওএস ভার্সনের মতো মা-বাবা-পরিবারও পুরোনো হয়। এই কদিন আগেই দেখলাম এক খবরের কাগজের একটি ফিচারের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘আজকের দিনের মা’— ভাবটা এমন যে, মা হলেন কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম; ফিচারটির লেখক তা আপডেটের যাবতীয় ফর্মুলা শিখিয়ে দিচ্ছেন। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে— বাঙালি কষে চড় দিলেও তাতে খানিক আদর রাখে। ওটা আমাদের কার্টেসি। তাই তো হুটহাট ‘পুরোনো’ হয়ে যাওয়া সব কিছু আমরা ফেলে দেই না; বরং কিছু পুরোনো বিষয় তো বড্ডো যত্নে তোরঙ্গে তুলে রাখি। তা না হলে কি নতুন ঢাকার কড়কড়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টেও ‘পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী.. ..’ লেখা থাকতে পারে? কে বলে বাঙালি ভালেটা বোঝে না?

চিত্রকর্ম: লালবাগ কেল্লা; শিল্পী: জোহান জোফানি (১৭৮৭)

স্কুল জীবনে আমরা আবাহনী-মোহামেডান, শাবনূর-মৌসুমী, জেমস না আইয়ুব বাচ্চু— এসব নিয়ে বিস্তর ঝগড়া করেছি। কিন্তু নতুন ঢাকা আর পুরোনো ঢাকা নিয়ে আমাদের কখনও কোনো ঝগড়া হয়নি, কারণ প্রতিপক্ষ ছিলো না। আমাদের যে বন্ধুটি জিন্দাবাহার লেন থেকে রোজ স্কুলে আসতো, তারও বুক ভরা প্রত্যাশা ছিলো একদিন তাদের ধানমণ্ডিতে একটি ফ্ল্যাট হবে। গলায় ডিএসএলআর ক্যামেরা ঝুলিয়ে রূপলাল হাউসের ছবি তুলতে হলে আমরা পুরোনো ঢাকায় যাই, আমাদের সেলফি আর চেক-ইন অভ্যাসে আহসান মঞ্জিল এখনও ততোটা ব্যাকডেটেড হয়নি বলে আমরা পুরোনো ঢাকায় যাই, আল-রাজ্জাকের সেহেরি বা চকবাজারের ইফতারি হলে আমরা গাড়ি হাঁকিয়ে পুরোনো ঢাকায় যাই— ঘিঞ্জি গলি আর পার্কিং সুবিধা না থাকার জন্যে অভিশম্পাত করি। কিন্তু ইসলামপুরের নবাববাড়ির গেটের সাঁচি পানের সাইনবোর্ডবিহীন দোকানে বোসে থাকা সেই আশি পেরোনো বৃদ্ধের গল্পটা আমাদের শোনা হয় না। কতোবার টিপু সুলতান রোডের আবেদ অ্যান্ড কোম্পানির (আবেদ অ্যান্ড সন্স বেকারি) সামনে দিয়ে আমরা চলে আসি আমাদের নতুন ঢাকার ঝাঁ চকচকে জৌলুসে— কেবল জানা হলো না এখানেই মতিলাল নামের একজন বোসে আছেন ঝুলি ভরা অভিজ্ঞতা আর চোখ চকচক করা স্মৃতি নিয়ে। আমাদের ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্যাকেজে ডেকোরেটরের চল কোথায়? অথচ এই ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আবেদ অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবাব আহসান উল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১)। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে সর্ববারতীয় মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠার যে সম্মেলন, তার মূল দায়িত্বে ছিলো এই আবেদ অ্যান্ড কোম্পানি। মতিলাল বাবু এসব কথাই বলেন, অল্প অল্প করে; কারণ তিনি তো জানেন, আমাদের দৈনন্দিন ডেবিট-ক্রেডিটের হিশেবে এসব ইতিহাস বড্ডো খুচরো। মার্ক্স আমাদের ডায়ালেকটিকের ছাত্র হতে বলেছিলেন, আমরা ডুয়েলিটিতে সমর্পন করলাম। আমরা তো সেই প্রজন্ম— যাদের না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ কেবল পড়ে আছে খঞ্জ বর্তমান।

০৬ আষাঢ় ১৪২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *