‘মহানগর’: দেশভাগের প্রচ্ছন্ন পাঠ
“A women’s place is in the home”— সত্যজিৎ রায়ের মহানগর (১৯৬৩) চলচ্চিত্রে সুব্রত মজুমদারের [অভিনয়: অনিল চট্টোপাধ্যায়] এই সংলাপ বরাবরই সত্যজিৎ আলোচনায় তৎকালীন প্রেক্ষাপটের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা হিশেবে আলোচিত হয়েছে। এই আলোচনার যৌক্তিকতাও আছে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের কোলকাতার পটভূমিতে নির্মিত এই ছবিতে দেশভাগের যে প্রচ্ছন্ন পাঠ— তার ইঙ্গিতও বহন করে ছবিটির শুরুর দিকেই সুব্রত মজুমদারের এই সংলাপ। এই ছবির দর্শক মাত্রেই জানেন, ছবিটি দেশভাগের প্রেক্ষিতে নির্মাণ করেননি সত্যজিৎ রায় কিন্তু দেশভাগের যে প্রভাব তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতায় বিরাজমান ছিলো— সত্যজিৎ তাকে পাশ কাটিয়েও যাননি। যদিও দেশভাগের চলচ্চিত্র নির্মাতা হিশেবে ঋত্বিক ঘটক যতোটা আলোচিত হন, সত্যজিৎ ততোটা হন না, হবার কথাও নয়; কিন্তু আমার বিচারে তাঁর মহানগর চলচ্চিত্রটি দেশভাগের একটি প্রচ্ছন্ন বয়ান বহন করে চলেছে। পঞ্চাশের দশকে কোলকাতার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির যে চিত্র সত্যজিৎ উপলব্ধি করেছিলেন, তাকে তিনি নথিভুক্ত করেছিলেন উদ্বাস্তু বয়ানে। আর এ কারণেই মহানগর চলচ্চিত্রের আরতি [অভিনয়: মাধবী মুখোপাধ্যায়] আপাতদৃষ্টিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চৌকাঠ ডিঙিয়ে আসা নারী চরিত্র হলেও সম-সাময়িক বাঙলা চলচ্চিত্রের নারী চরিত্র নীতার [মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), ঋত্বিক ঘটক; অভিনয়: সুপ্রিয়া চৌধুরী] সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায়— এই ডিঙিয়ে আসা বা এই পুরুষতান্ত্রিকতা আদতে উদ্বাস্তু জীবনের শ্রেণিচিত্র। পার্থক্য এটুকুই যে, ঋত্বিক ঘটক নীতার ট্র্যাজিডিকে দেখেছিলেন রাজনৈতিক আতশকাঁচে আর সত্যজিৎ আরতির আশ্রয় ও আশাবাদকে দেখেছিলেন আর্থ-সামাজিকতার চোখ দিয়ে। দুটো চরিত্রই উদ্বাস্তু এবং পঞ্চাশের দশকের উদ্বাস্তু জীবনের শ্রেণি-সংগ্রামে আক্রান্ত।
এখন এই উদ্বাস্তু জীবনের শ্রেণি-সংগ্রাম কি দেশভাগের সম্প্রসারিত পাঠ নয়? ‘বাঙলা চলচ্চিত্রে দেশভাগ’ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গেলে বোঝা যায়— আমাদের চলচ্চিত্রে দেশভাগ এসেছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধি হিশেবে। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা (১৯৬৫) চলচ্চিত্রের সীতাই [অভিনয়: মাধবী মুখোপাধ্যায়] একমাত্র, বেশ্যালয়ে যার মৃতচক্ষু কেবল ঈশ্বরকেই নয়, আমাদেরও অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো উদ্বাস্তু জীবনের ব্রাত্য শ্রেণির মঞ্চে। কী আশ্চর্য! সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটক— দুজনেই তবে মাধবী মুখোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিলেন দেশভাগের শ্রেণি-চেতনা বহনের!
দুই
দেশভাগের মতো নির্মম আখ্যানের যে বিস্তারিত বিবরণ আমরা পাই, তার অধিকাংশই মধ্যবিত্তের স্মৃতি, ট্রমা বা বেদনার্ত হাহাকার থেকে। সেখানে অন্ত্যজ শ্রেণির দ্বন্দ্ব বা সংঘাত প্রায়ই অনুপস্থিত। এমনকি সাহিত্যেও। অধীর বিশ্বাসের দেশভাগের স্মৃতি (২০১০) ও আল্লার জমিতে পা (২০১২) আর মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আত্মজীবনী ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন (২০১২) প্রথমবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— উদ্বাস্তু জীবনেরও একটি ব্রাত্য সংস্করণ আছে, যা বহুকাল ধরেই আমাদের সাহিত্যে অচ্ছুৎ ছিলো। ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখার কারণে চলচ্চিত্র অবশ্য সেদিক দিয়ে এগিয়েই ছিলো। কিন্তু ওই একটিই। প্রথম এবং শেষ।
উদ্বাস্তু জীবনের এই মধ্যবিত্তি সংস্করণ তাহলে কী? আমার মনে হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরটিই হলো গোটা মহানগর চলচ্চিত্রের অন্তঃস্রোত। আরতির শ্বশুর প্রিয়গোপাল মজুমদার [অভিনয়: হরেন চট্টোপাধ্যায়] যে মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে পুত্রবধূর চাকুরি করতে যাবার বিষয়ে অক্ষম বাধা হয়ে দাঁড়ান এবং পুত্রবধূর প্রথম মাসের বেতনের টাকা ফিরিয়ে দেন; সেই মূল্যবোধ ফিকে হয়ে যায় যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত প্রাক্তন ছাত্রদের বাড়ি গিয়ে সাহায্য নিয়ে আসেন। উদ্বাস্তু জীবনের এই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ যখন সক্ষমতা আর অক্ষমতার মাপকাঠিতে নির্ণীত হয়— তখন সেখানে প্রবঞ্চনার প্রসঙ্গটি আসে। সত্যজিতের মহানগর উদ্বাস্তু জীবনের এই মধ্যবিত্তি প্রবঞ্চনাকে গোটা আখ্যানে জারি রাখে। ফলে আরতির দাপ্তরিক কর্মগুণ বা সংসার-ঘনিষ্ঠতা যেমন তাঁর জীবন সংগ্রামের বা পারিবারিক শান্তি বজায় রাখার প্রমাণপত্র; তেমনি ধনী বন্ধুর স্বামীর সঙ্গে চা খেতে খেতে নিজের স্বামীর পেশা ও উপার্জন সম্বন্ধে মিথ্যে বলা সেই মধ্যবিত্তি প্রবঞ্চনার অংশ— এমনকি আরতির ব্যাগে লুকিয়ে রাখা লিপস্টিক ও তার ব্যবহারও। তবে এই প্রবঞ্চনাও যুক্তি রহিত নয়— সত্যজিৎ রায় এই বক্তব্য পরিস্কার করেছেন দৃশ্যে, যখন প্রিয়গোপালের চোখে আলো ফেলে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র চোখ পরীক্ষা করে। সংলাপে ‘গুরুদক্ষিণা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়— কেননা, সত্যজিৎ রায় শেষ পর্যন্ত উদ্বাস্তু জীবনের মধ্যবিত্তি ভদ্র মানসিকতাকে ভেঙে পড়তে দেননি। হয়তো এ কারণেই দিনশেষে ছবিটি আরতি-সুব্রতর জীবন সংগ্রামের ছবি হয়ে ওঠে।
তিন
আরতির স্বামী সুব্রত মজুমদার ও অফিসের কর্তা হিমাংশু মুখোপাধ্যায় [অভিনয়: হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়] দুজনেই উদ্বাস্তু। একজনের আদি বাড়ি পাবনা, অন্যজনের সিরাজগঞ্জ— কিন্তু দেশভাগ উত্তর কোলকাতায় একজন চাকরি হারানো ট্রামযাত্রী, অন্যজন অস্টিন হাঁকানো ব্যবসায়ি। একই কাঠামোর এই উপরতলা নিচতলার সংযোগ বিন্দু হলো আরতি ও তার মূল্যবোধ। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই সংযোগ বিন্দু কি আরেকটু স্থির হতে পারতো? হিমাংশু মুখোপাধ্যায় তো বারবার বলেছেন— “আপনি বড্ডো ইম্পালসিভ”— বস্তুত তাঁর এই বক্তব্য আরতিকে উদ্দেশ্য করে নয়; বরং আরতি যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে— তাকে উদ্দেশ্য করে বারবার এই সংলাপ আদতে রায় মশাই-ই নিক্ষেপ করেছেন। আমার এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হলো সিনেমার একেবারে শুরুতে ওঠা টাইটেল কার্ড। সত্যজিতের চলচ্চিত্রে শিল্প-নির্দেশনা বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। দৃশ্য ধারণও। ফলে বৈদ্যুতিক তার ধরে এগিয়ে যাওয়া ট্রামের দৃশ্যের সঙ্গে মহানগর চলচ্চিত্রের কলা-কুশলীদের পরিচয় জানানো আর মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ-স্ফূরণ ঘটতে থাকা— এ সম্ভবত তৎকালীন রাজনৈতিক পরিকাঠামোর দৃশ্যায়ন। পঞ্চাশের দশকের একটি গোটা কোলকাতা উদ্বাস্তু রাজনীতি, কলোনি জীবন আর চিন-ভারত যুদ্ধের (১৯৬২) পটভূমিতে জ্বলছে। আর এ কথাতে পাঠক নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না যে— ঋত্বিকের ছবিতে রাজনীতি যতোটা মেলোড্রামাটিক, সত্যজিতের ছবিতে ততোটাই মেটাফোরিক। মহানগর চলচ্চিত্রের একেবারে শুরু থেকে শেষ— সেই মেটাফোরের আদলেই দেশভাগ বারবার এসেছে। এসেছে মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-প্রবঞ্চণা আর মূল্যবোধের অকালবোধন।
সংযোজন: ইউটিউবে মহানগর চলচ্চিত্রটি দেখতে চাইলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন