২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে নির্মমভাবে নিহত হন বিজ্ঞান লেখক, প্রকৌশলী এবং মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম অভিজিৎ রায়। মৌলবাদীদের চাপাতির নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আরেকজন বিজ্ঞান লেখক– অভিজিৎ রায়ের জীবনসঙ্গী বন্যা আহমেদ। এরপর বছর জুড়ে চলে একের পর ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ও মুক্তচিন্তকদের হত্যা।
বইমেলা প্রাঙ্গণে, জনবহুল টিএসসি এলাকায় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনে গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বারবার আলোচিত হতে থাকে– মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে কতটা অনুপযোগী হয়ে উঠছে বাঙলাদেশ– তা নিয়ে।
এই শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বাঙলাদেশে। কেবল গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সহযোদ্ধা, লেখক, প্রকাশক বা ব্লগাররাই নন; গত কয়েক বছরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিদেশি নাগরিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ, সুফী সাধক, বাউল, এমনকি ইসলাম ধর্মের অন্যান্য তরিকা অবলম্বনকারীরাও। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর বিভিন্ন উগ্র ধর্মবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের দায় স্বীকার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বক্তব্যের ভাষা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারি, কতটা মধ্যযুগীয় বর্বর চিন্তাধারায় তাড়িত হলে তারা সমাজে ভিন্নমত ও বহু মতের অবস্থান নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম’ ও ‘রাষ্ট্রধর্মের’ মতো সংকীর্ণ চিন্তার আফিমে বুঁদ হয়ে অনেকেই– এমনকি রাষ্ট্রও অনেকাংশে– এই উগ্র ধর্মান্ধদের পালে হাওয়া দিচ্ছে। ফলে বিষাক্ত বীজ এখন বিষবৃক্ষে পরিণত হতে চলেছে।
যারা প্রকৃত অর্থেই ধর্মপ্রাণ, বিশ্বাসী, ধর্মীয় শাস্ত্রানুমোদিত জীবন যাপন করে থাকেন, তারাও কিন্তু রেহাই পাচ্ছেন না উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষাক্ত ছোবল থেকে। অর্থাৎ আস্তিক বা নাস্তিক প্রসঙ্গের চেয়েও এখানে মুখ্য হল রাজনীতি, যা আবর্তিত হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের নির্দিষ্ট মতাবলম্বী গোষ্ঠী দ্বারা। তারা কাপুরুষের মতো গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে, বিদেশি অর্থায়নে জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে মানুষ কতল করার ফতোয়া দিচ্ছে; সর্বোপরি এসবের মধ্য দিয়ে তারা সমাজে এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে তাদের চিন্তার বাইরে আর কোনো চিন্তার অস্তিত্ব না থাকে।
এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ধর্মীয় চরিত্র খুব নড়বড়ে ও সুবিধাবাদী এবং ধর্ম-দর্শন পাঠ ও চর্চার প্রমাণসাপেক্ষ কোনো তত্ত্বগত কাজও এদের নেই। সুতরাং ধর্ম সম্বন্ধে অপব্যাখ্যা, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা ও হত্যার হুমকি প্রদান করে এই জামায়াত-হেফাজত-আনসারুল্লাহ-হিজবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি-সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ধর্ম ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
বানর যেমন কলা দেখে নাচে, রাষ্ট্রও তেমনি এই ধর্ম দেখে লাফাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের আপসকামী ‘লেজ’ ক্রমশই দৃশ্যমান হচ্ছে। এ পর্যায়ে সবচেয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল যারা সত্যিকার অর্থেই ধর্মপ্রাণ মানুষ, তাদের। কারণ যে ধর্মের প্রতি আস্থা নিয়ে তারা সারাটি জীবন পার করছেন, সেই ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষ হত্যার ‘উপায়’ হিসেবে।
একের পর এক সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, হত্যা-অন্যায়-জুলুম বৈধ করা হচ্ছে ‘রাষ্ট্রধর্মের’ বিধান হিসেবে। ইসলামের এত বড় অবমাননার পরও বাংলাদেশের তথাকথিত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মুসলমানরা এর প্রতিবাদ করছে না কেন? কারণ তারা ধর্ম-দর্শনের অমিয় বাণী দ্বারা ঋদ্ধ নয়; তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত পেট্রোডলারনির্ভর মওদুদীবাদী ইসলামের ভাইরাসে আক্রান্ত!
বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠী আজও বুঝতে পারছেন না, উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর এসব ইসলামজীবী জামায়াত-হেফাজত-আনসারুল্লাহ-হিজবুত তাহরীরর সন্ত্রাসীরা ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যেমন আইএস করেছে সিরিয়ায়, আল-কায়েদা করেছিল আফগানিস্তানে।
অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটির কথা বারবার মনে পড়ছে। ধর্মান্ধতায় ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের ‘এক্সরে প্লেট’ তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এর এক বছর পর তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বইটিও এখন আর বইমেলাতে নেই। অর্থাৎ মৌলবাদের গভীর অসুখে আক্রান্ত বাংলাদেশের চিকিৎসা আপাতত বন্ধ; ক্ষত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
দুই
অভিজিৎ রায়ের যে বইটি প্রথম পড়েছিলাম, তার নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ । মুক্তমনা থেকে বইটির পিডিএফ নামিয়ে পড়েছিলাম। তখনও সম্ভবত এটি বই আকারে বের হয়নি। মুক্তমনা ওয়েবসাইটে তখন পিডিএফ আকারে নানা ধরনের নিবন্ধ প্রকাশিত হত। সময়টা ২০০৪ সালের শেষের দিক। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ হয় বইমেলায় (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪)। সে বছরই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অনেকগুলো লেখা ছিল মুক্তচিন্তার প্রসার, মৌলবাদীদের আষ্ফালন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে। সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত উল্লিখিত বইটিতে একের পর এক উন্মোচিত হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের নানা ধারণা ও দর্শন। বইটির বিষয়বস্তু নানা জায়গায় কঠিন হলেও, অভিজিৎ রায়ের উপস্থাপনাটি ছিল প্রায় সবার জন্য বোধগম্য।
মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক হওয়ার কারণে অভিজিৎ রায়ের অনেক বইই প্রকাশের আগেই পড়া হত। লেখক ফরিদ আহমেদের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বইটি ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি পড়লে বোঝা যায়, কী অসামান্য পরিশ্রম লেখকদ্বয়কে করতে হয়েছে। কারণ প্রাণের উৎপত্তি-তত্ত্ব ও রসায়ন-সংক্রান্ত নানাবিধ আলোচনা এখানে এসেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল বৈজ্ঞানিক নানা শব্দের ব্যবহৃত বাংলা পরিভাষা, যার মধ্যে কয়েকটি লেখকগণের মৌলিক ব্যবহার। সে সময় বাংলা ব্লগে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ও তার বিস্তারিত আলোচনা ভাবাই যেত না। আজও ভাবা যায় না।
বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা অভিজিৎ রায়ের আরেকটি বই ‘সমকামিতা’ । ২০১০ সালে বইটি প্রকাশ করেছিল শুদ্ধস্বর। আমার জানা মতে, বিজ্ঞান ও সমাজ-মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামিতার ওপর এটিই সম্ভবত বাংলায় লেখা প্রথম বই। এ বইটিতে অভিজিৎ রায় যেভাবে একটি ধারণাকে ভেঙেছেন, প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে তার বিচার করেছেন, তা পাঠকের সামনে চিন্তার একটি জগৎ প্রতিষ্ঠা করে।
২০১১ সালে লেখক রায়হান আবীরকে (২০১৪ সালে ক্যান-ফিকো পুরস্কারপ্রাপ্ত) সঙ্গে নিয়ে অভিজিৎ রায় লেখেন ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি। দর্শনগত ধারণা প্রশ্নের পাথরে যাচাই করে পুরো বইটি এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। যারা বইটি পড়েছে, তারা নিঃসন্দেহে চমৎকৃত হবে বইটির বিষয়বস্তু এগিয়ে নেওয়ার অভিনব পদ্ধতি লক্ষ্য করে।
২০১২ সালের বইমেলার শেষদিকে বের হয় তাঁর আরেকটি বই ‘ভালবাসা কারে কয়’ । এখানেও তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক চোখ সজাগ, তিনি নির্মোহ যৌক্তিক চোখে বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করেছেন ভালোবাসার অপার্থিব বিস্ময়কে।
অভিজিৎ রায়ের সর্বশেষ বই প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে, একেবারেই ভিন্ন একটি বিষয়ে। ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটিতে আমরা যে অভিজিৎ রায়কে পাই, তিনি ঘড়ির বয়স্ক কারিগরের মতোই খুঁজে বের করেন রবীন্দ্রনাথের হৃদয়জ অলিগলি, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে। বলা ভালো, ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলায় বহুল পঠিত দুটো বই– শঙ্খ ঘোষের ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৭৩) এবং কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ (১৯৮৫)– বিবেচনায় নিয়েও অভিজিৎ রায়কে তাঁর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে রাখা যায়। রবীন্দ্রনাথকে নয়; ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে প্রসঙ্গ কাঠামোতে রেখেই অভিজিৎ রায় এই অনন্য সম্পর্কের সমীকরণ খুঁজেছেন।
তিন
যুক্তিবাদী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচারিক অগ্রগতি নেই। দু বছরেও তদন্তের বিষয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য নেই। বইমেলা থেকে ফেরার পথে শত শত মানুষের সামনে নির্মমভাবে মৌলবাদীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করল। একুশের অবিনশ্বর চেতনা নিয়ে আয়োজিত বইমেলায় তার কোনো প্রতিবাদ নেই। বরং অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর বইমেলা আরও বেশি ‘ক্লিব’ হয়ে গেছে। গোটা একুশের গ্রন্থমেলায় কোথাও অভিজিৎ রায়ের বই নেই। তাঁর অসামান্য চিন্তা আর বিশ্লেষণ কোনো না কোনো প্রকাশনীর গুদামে আটকে রয়েছে। আমরা যেন বলতে পারলে বাঁচি, অভিজিৎ রায় আমাদের কেউ ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই।
কার্যত কথাটি এক অর্থে সত্য। আমাদের যাবতীয় মেরুদণ্ডহীনতা ও আপসকামী মনোবৃত্তি অভিজিৎ রায়কে ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। অভিজিৎ রায় জানতেন কী করে হাতুড়ি ঠুকে মানুষের মগজে জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভাঙতে হয়। তিনি যুক্তির আলোয় আমাদের মনের অন্ধকার দূর করার ব্রত নিয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি প্রাসঙ্গিক, বইমেলাতে তাঁর একটি বই না পাওয়া গেলেও তিনি প্রাসঙ্গিক।
অতএব, সবার অবগতির জন্য দুটো বাক্য জানানো যেতে পারে– এক. আমাদের বুকপকেটে অভিজিৎ রায়ের বুড়ো আঙুলের ছাপ অবিনশ্বর এবং দুই. অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও বাংলাদেশ আলোর দিকে হাঁটবেই।
অভিজিৎ রায় সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে তাঁর ওপর নির্মিত ওয়েবসাইটটি দেখুন
অভিজিৎ রায়ের বইগুলো পড়তে চাইলে এই লিঙ্কে গিয়ে বইগুলো পড়ুন।
১৪ ফাল্গুন ১৪২৩
লেখাটি উল্লিখিত তারিখে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো। বিডিনিউজে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।