গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে খেলাফত যুব মজলিশ ঢাকা মহানগরীর এক অনুষ্ঠানে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নামে স্থাপিত প্রতিকৃতি-ভাস্কর্য নিয়ে যে ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করেছে— তিনদিন পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী দলের নেতারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন— ধর্মভিত্তিক দলগুলো সরকারের আশকারায় এমন মন্তব্য করেছে। কিন্তু সরকারে কি এই জোটভুক্ত দলগুলো নেই? তাহলে কাদের বিরুদ্ধে তাঁরা অভিযোগ তুলছেন?
সাম্প্রদায়িক সংগঠন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের এই অপোগণ্ড নেতার ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য শুনে আমার কেবলই মনে পড়ছিলো ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শাসনামলের কথা। তখন পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়তো দেশের কোথাও না কোথাও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙা হচ্ছিলো। একবার জনকণ্ঠ পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিলো যে, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দলের এক নেতা বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙছে। তখন এইসব সন্ত্রাসের তীব্র প্রতিবাদ করতো আওয়ামী লীগ। জোট সরকারের নির্মম পুলিশী নির্যাতন উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নেমে বঙ্গবন্ধুকে অপমানের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু আজ, আওয়ামী লীগের মুখে কোনো রা নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, তারা যেনো ঘটনাটিকে আমলেই নিচ্ছেন না। গত কয়েক বছর ধরে মৌলবাদী অপশক্তিগুলোকে রাষ্ট্রীয় মদদে যে আশকারা দেয়া হয়েছে, এখন তারই ফল আমরা ভোগ করছি। বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাংচুরের কোনো ঘটনায় শাস্তি তো দূরের কথা, উল্টো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর সাফাই গাইতে শুনেছি সরকারের অনেক দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রী-এমপিকে। সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে রোমান যুগের ন্যায় বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে করা ভাস্কর্য সরানোর জন্য ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে গিয়ে তদবির করেছিলো মৌলবাদী দলগুলোর নেতারা। তখন প্রধানমন্ত্রীও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে ভাস্কর্য অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই ভাস্কর্য রক্ষা করতে রাজপথে প্রতিবাদ হয়েছে, প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশ হামলা করেছে, মামলা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে; কিন্তু ভাস্কর্য রক্ষা করা যায়নি। সেই আপোষের বুমেরাং এখন আওয়ামী লীগের দিকেই ফিরে এসেছে।
দুই
প্রায়ই খবরের কাগজে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, ‘বঙ্গবন্ধুকে কটুক্তি বা অপমানের অভিযোগে’ কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বা তার চাকুরি চলে গেছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসের একটি ঘটনা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে আমন্ত্রণপত্র করায় তাকে ‘বিকৃত’ অভিহিত বরিশালের ইএনও তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদুল্লাহ সাজু। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে ঘটনার সুরাহা হয়।
একজন ইউএনওকে অপদস্থ করার সময় আওয়ামী লীগের এই তথাকথিত নেতাদের উৎসাহের কমতি ছিলো না সেদিন। এটি তো কেবল একটি ঘটনার উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য ঘটনার কথা আমরা মনে করতে পারি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোথায় কে কী লিখছেন, তার সবিস্তারিত বিবরণসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর মামলা করতে পারে। তাদের ক্ষমতার দাপট তখন আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিশের এমন ধৃষ্টতা আর কটুক্তির বিষয়ে তারা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সাংগঠনিক প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগের আদর্শগত এই নড়বড়ে অবস্থাটি বুঝতে হলে ২০০৮ সালের পর থেকে তার সাংগঠনিক ব্যবস্থাটি বোঝা প্রয়োজন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বের একটি বিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেক তৃণমূলের নেতাদের ফেসবুক প্রোফাইল এবং পোস্টগুলো দেখলেই এই বিবর্তন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাঝে একটি অংশ তৈরি হয়েছে গত বারো বছরে, যারা কথা শুরু করেন ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ দিয়ে আর শেষ করেন ‘সাঈদীর মুক্তি চাই’ বলে। এই অংশই দিনে দিনে ক্ষমতাবান হয়েছে। তারা কোন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ বা ‘সহি আওয়ামী লীগ’ কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মৌলবাদীদের সঙ্গে মিলেমিশে আওয়ামী লীগ যে গত বারো বছরে তার ডিএনএ কোড পরিবর্তন করে ফেলছে, সে বিষয়ে তাদের ভ্রুক্ষেপ আছে কি?
আমরা কি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদেরই আজাহারীর ওয়াজে উপস্থিত থাকতে দেখিনি? পরিস্থিতির চাপে সেসব বিষয় হয়তো এখন তারা চেপে যাবেন কিন্তু মননে ও মগজে তো সেই মৌলবাদীত্বই ধারণ করে আছেন। যে মন্ত্রী এমপিরা আজাহারীর ওয়াজ উদ্বোধন করে এসেছিলেন, তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা তো রাজাকার সাঈদীর মুক্তি চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট লিখবেই।
২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট মো. ছায়েদুল হক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে যে অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন, তার জণ্র তাকে কোনো শাস্তি পেতে হয়েছিলো কি? উল্টো আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা তখন বলেছিলেন, ‘পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়’ (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ০৪ নভেম্বর ২০১৬)। গত নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগড়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছে জামায়াত-সখ্য আবু রেজা মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন নদভী। এরকম অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ দেয়া যাবে, যাতে কেবল লেখার আকারই বাড়বে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। তৃণমুল আওয়ামী লীগ এখন জামাত-বিএনপি-শিবির-ছাত্রদলের দখলে। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতাদের বিবৃতি শুনলেই মনে হয় জামায়াতের লেখা প্রেস রিলিজ পড়ছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক নেতাদের ফেসবুক পোস্ট দেখলেই মনে হয় কোনো সাম্প্রদায়িক দলের নেতার স্ট্যাটাস পড়ছি।
আর সম্ভবত এ কারণেই মামুনুল হকের মতো ইতরসম্বন্ধীয় ব্যক্তি প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের সাহস দেখালেও আওয়ামী লীগের কোনো তরফ থেকেই তার কোনো প্রতিবাদ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। এবার আর কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালতে রিটও করেন না, অর্থাৎ আওয়ামী মহলের আইনজীবীরাও চোখ বুজে আছেন। তাহলে আপনাদের ক্ষোভ অনুভূতি ক্রোধ এগুলো সবই সাজানো। মৌলবাদীদের প্রতি আপনাদের এমন নির্লজ্জ আপোশের কারণ কী? পর পর তিনবার ক্ষমতায় থেকেও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে আপনাদের মেরুদণ্ড জিম্মা রাখতে হচ্ছে?
তিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাই নন, তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক। তাঁর তর্জনীর মানচিত্রেই বাংলার মানুষ রচনা করেছিলো স্বাধীনতার ইশতেহার। আমরা তো প্রায়ই বলি, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পরস্পরের সমার্থক। কথাটি দর্শনগতভাবে যেমন সত্যি, প্রয়োগের দিক দিয়েও তাই। আজ মৌলবাদীদের আষ্ফালনে বাংলাদেশ পুড়ছে। তথাকথিত ধর্মানুভূতির ধুয়া তুলে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে মানুষ, ঘরবাড়ি, উপাসনালয়। বাংলাদেশের এই দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুও আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ যেমন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কোনো বিচার পাচ্ছে না, বঙ্গবন্ধুও এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমনের কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ যেমন আজ আওয়ামী লীগকে আর চিনতে পারে না, হয়তো বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই দলকে আজ আর চিনতে পারছেন না। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর গন্তব্য এক সুতোয় বাঁধা— সুদিনে কিংবা দুর্দিনে।