‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মতো ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ও বোধ করি আমাদের সময়ের বহুল উচ্চারিত শব্দ-যুগল, তবে সমাজ-সংসারে এটি ঠিক ততটাই অচর্চিত বিষয়! প্রতিদিনের বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে, টেলিভিশন টক শোতে আমরা হর-হামেশাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলছি-লিখছি-শুনছি। কিন্তু আমাদের জাতিগত জীবনে এর প্রভাব নেই বললেই চলে।
এর কারণ সম্ভবত এই যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের বিষয়টি আমাদের মগজের ভেতরে প্রকটভাবে বিরাজমান। সুতরাং সব আলোচনার পরও বাংলাদেশ আমাদের কাছে ‘মুসলমানের দেশ’ হিসেবেই ধরা দেয়।
অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র সাইনবোর্ডের বৈধতা প্রদানের নিমিত্ত মাত্র। সুতরাং গোটা বাংলাদেশের জনসংখ্যা মূলত মেজরিটি-মাইনরিটিতে বিভক্ত। এই বিভক্তির বিরুদ্ধে আমরা যতই গালভরা কথা বলি না কেন– নির্মোহ সত্য হচ্ছে, আমাদের প্রতিটি কাজে এই বিভক্তির ছাপ স্পষ্ট।
এ দেশে লেখকরা লেখার সময় ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; প্রকাশকরা ছাপার আগে ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; গণমাধ্যম তাদের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার সময় ভাবে, এটা মুসলমানের দেশ; রাজনৈতিক নেতারা বক্তৃতা দেওয়ার আগে ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; সরকার সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর আগেও ভাবে, এটা মুসলমানেরই দেশ। এমনকি ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মাবলম্বীরা, আমাদের সমাজব্যবস্থায় যাঁরা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে পরিচিত; তাঁরাও এই ভেবেই জীবনযাপন করেন যে, বাংলাদেশটা আদতে মুসলমানেরই দেশ।
অতএব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে জয়ধ্বজা আমরা ওড়াই, ওটা আসলে লোক-দেখানো বিষয়– সত্যি বলতে আমরা ‘মেজরিটি সম্প্রীতি’র বন্দনা করি। সে কারণেই ঈদের জামায়াতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাহারা দিলে আমরা বেশ গদগদ হই এবং দিনশেষে মন্দির প্রাঙ্গণে কোরবানির পশুর বর্জ্য ফেলে প্রমাণ করি– ঈদ-উল-আযহা মেজরিটির উৎসব; সুতরাং ও রকম একটু-আধটু হতেই পারে!
আর এই যে আমরা ঈদের জামায়াত পাহারা দেওয়ার খবরটি গলা ফাটিয়ে প্রচার করছি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মোড়কে জড়াচ্ছি; তারাও জানি, মেজরিটি মুসলমানের দেশে থাকতে গেলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, “একটা কিছু করতে হবে তো।” তা-ই হচ্ছে। জনসংখ্যার কিনারে পড়ে থাকা কয়েক শতাংশ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ ক্রমাগত চেষ্টা করছেন মেজরিটির সঙ্গে মিশে যেতে। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, উৎসব তাঁদের দরজায় কড়া নাড়ে উপাসনালয় ভাঙার শব্দে! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আর তার মেজরিটি জনসংখ্যা তাঁদের বুঝিয়ে দেয়– তুমি সংখ্যালঘু।
এসবের পর আবার যখন আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সিজন্যাল কথাগুলো আওড়াই তখন নিজেকেই নিজের কাছে উপহাসের পাত্র মনে হয়।
রাষ্ট্রের সংকট চিহ্নিতকরণ তুলনামূলক সহজ। কিন্তু ব্যক্তির মনোজগতের সংকট? সংবিধান বলছে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু জনগণের মনোজগৎ তো মেজরিটি-মাইনরিটির গভীর অসুখে আক্রান্ত। আর সেই অসুখ না সারিয়ে রাষ্ট্র তার জীবাণু আরও বাড়িয়ে চলছে! কারণ, রাষ্ট্রের কর্তা-ব্যক্তিরা জানেন, মেজরিটিই তাদের ক্ষমতায় রাখে। দুর্গাপূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা আর বড়দিনে কিছু মুখস্থ বুলি আওড়াতে হয়। এরপর যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন!
বছরের ৩৬৫ দিনের বাকি সময় কেবল মেজরিটির ধর্মকে রক্ষা কর। ফেসবুকে কেউ কিছু লিখলে, কোনো প্রশ্ন করলে ৫৭ ধারা দিয়ে কপাত করে ধরে ফেল। কিন্তু এই যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে উঠল কিছু অসভ্য বক্তব্যের স্ক্রীনশট– এ বিষয়ে ‘স্পিকটি নট’। ৫৭ ধারা এখন ‘ন্যাপ’ নিচ্ছে, তাকে বিরক্ত করো না। কারণ রাষ্ট্র জানে, কদিন পর দুর্গাপূজা, ষষ্ঠী থেকে নবমী অবধি কিছু মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুর হবে! (প্রতি বছরই হয়, এসব এখন গা-সওয়া), তারপর বিজয়া দশমীর দিনে দু-চারটে ভালো কথা বলে দিলেই হবে। আমাদের গণমাধ্যম প্রচার করবে– খুব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাজনা বাজানো হল। আদতে লবডঙ্কা!
যাঁরা লেখেন তাঁরাও জানেন, মেজরিটি ও তার রাষ্ট্র গোটা ব্যাপারটাকেই একটা সহানুভূতি হিসেবে দেখে। এই যে অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে আমাদের যাত্রা; এর শুরু কোথায়? অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘রাষ্ট্র ও সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন:
ধর্মনিরপেক্ষ অর্থটাই শাসক শ্রেণির কাছে পরিষ্কার ছিল না। এমনকি তাঁদের কাছেও নয়, যাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাঁরা ইহলৌকিকতা বোঝাননি। বোঝাননি এই প্রয়োজনটা যে, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে ফেলতে হবে পরস্পর থেকে, বরঞ্চ উল্টো বুঝিয়েছেন সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং পারলে আরও বেশি করে ধর্মচর্চা।
খুব মন দিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে, সব ধর্মের সমান অধিকারের বিষয়টিই আমাদের বর্তমান সময়ের রাজনীতি ও সমাজনীতির মূল টেক্সট। এবং আরও ভাবলে পরিষ্কার হবে যে, এই টেক্সট কত দুর্বল ও ফাঁপা। পৃথিবীতে একেক দেশে একেক ধর্ম নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে আসছে। যে দেশে যে ধর্মের অনুসারী বেশি, সে দেশে সেই ধর্ম তত শক্তিশালী। তারা তাদের নিজস্ব মত চাপিয়ে দিচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর। কেবল মেজরিটি হওয়ার জোরে তারা নিজেদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে যাচ্ছে। এভাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ধর্ম ব্যক্তির জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে নামছে রাজনীতির খেলার মাঠে। কখনও সে খেলছে, কখনও হচ্ছে খেলার সামগ্রী।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী কেবল ধর্মকে ব্যবহার করে ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যা আর নারী নির্যাতনকে এখনও বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম এই ধর্মীয় ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই। সুতরাং বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের বিবাদের বাইরে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েছিল। কাগজে-কলমে সে পথে পা-ও বাড়িয়েছিল।
বাহাত্তরের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়,
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে।
এই বিধান কেবল লিখিতই রয়ে গেল। সব ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রবণতা পরিলক্ষিত হল স্বাধীনতার কয়েক বছরেই। পাকিস্তান আমলে চলতে হত এক ধর্ম নিয়ে। ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার’– এই টেক্সটের ওপর ভর করে নবগঠিত বাংলাদেশ চলতে শুরু করল ‘চার ধর্ম’ নিয়ে। কিন্তু তখনও কেউ ভাবলেন না আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা, তাঁদের ধর্মের কথা। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি সব দলিল-দস্তাবেজে তাঁরা ‘অন্যান্য’ হয়েই রইলেন।
রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বিযুক্ত হল না, যদিও তার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ ইতিহাসের কাছে চড়া মূল্য দিয়ে। ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক
‘ভোরের কাগজ’ এ ‘বিজয় দিবস: একটি সাফল্যজনক পশ্চাদপসরণের কাহিনী’ শিরোনামের কলামে শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী জানিয়েছিলেন, কিভাবে গণভবনে সুভাষ বসু, সূর্যসেনসহ আরও অনেকের ছবি সরিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছিল নবাব সলিমুল্লাহ, সৈয়দ আমীর আলী, ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ আরও অনেক ‘মুসলমান’ প্রথিতযশা ব্যক্তির ছবি।
আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধেয় নেতা মোহাম্মদ হানিফের (তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট) বরাত দিয়ে গাফফার চৌধুরী জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রীর ইচ্ছে নয় ছবিগুলো থাকুক। একই প্রবন্ধে গাফফার চৌধুরী জানিয়েছেন ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির ক্যালেন্ডার থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি বাদ দেওয়ার কথা।
সুতরাং যুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা গেলেও আমাদের মনোজগতে থাকা পাকিস্তানি ভাবাদর্শের নষ্ট পুঁজ বের করতে পারিনি আমরা! ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘাড়ে চেপে রইল ধর্ম। আর পঁচাত্তরের পর তার পূর্ণ ব্যবহার করলেন জিয়াউর রহমান আর এরশাদের মতো সামরিক শাসকরা।
‘অধিকার’ যে আদায় করার বিষয় সেই আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশে মুসলমানরা এগিয়ে গেল মেজরিটির লাঠিতে ভর দিয়ে, আর বাকিরা হয়ে রইল মাইনরিটি।
কারণ রাষ্ট্রকাঠামো, দেশের বুদ্ধিজীবী মহল, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত– সবই হয়ে উঠল মেজরিটির কথক। কোথাও অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো ইতিহাস নেই, কোনো উৎসব নেই– সবই মেজরিটি মুসলমানের জন্য। আর এই ‘যাবতীয় ইতরামির ভেতরে’ আমাদের একটি প্রজন্ম বড় হয়েছে, যাদের অভিধানে ‘মানুষ’ বলে কোনো শব্দ নেই! যারা মানুষের অধিকার বলতে সম্প্রদায়ের অধিকার বোঝে, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ বলতে বোঝে ‘মেজরিটি সম্প্রীতি’।
এই অন্ধকার ফুঁড়ে যে প্রজন্ম বের হবে, তারাই বাংলাদেশের সত্যিকারের আলোকিত প্রজন্ম। তাঁদের খেরোখাতাতেই লেখা থাকবে আমরা কতটা মেকি, অভিনয়-সর্বস্ব এবং সবকিছু মেনে নেওয়া ধূর্ত!
০২ আশ্বিন ১৪২৪
লেখাটি উল্লিখিত তারিখে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো। বিডিনিউজে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন।