জানি না, এখনও খবরটি জাতীয় গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কি না। দেশে নানা বিতর্ক চলছে, এসবের ফাঁকে এই খবর চাপা পড়ে গেলেও আশ্চর্য হব না। তবে নাগরিক হিসেবে, একজন ব্লগার হিসেবে নিজের কাছে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। ঠিক যেমন পারিনি এর আগে, যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গ্রেফতার করা হয়েছিল চারজন ব্লগারকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আবার।
এবারও সেই কালো আইন ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হল দুই ব্লগারকে। তাদের দুজনই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। ৩০ মার্চ তাদের গ্রেফতার করে চট্টগ্রামের চকবাজার থানার পুলিশ। এজাহারে থেকে জানা যায়, তাদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম রায়হান রাহী এবং অন্যজন উল্লাস দাস। এজাহারে দুজনেরই বয়স উল্লেখ করা হয়েছে আঠারো। চট্টগ্রামের ব্লগারদের ব্লগ ও ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, রায়হান রাহী এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ৩ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার একজন প্রার্থী তিনি।
যখন রায়হানের বন্ধুরা পরীক্ষার জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন রায়হানকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অগণতান্ত্রিক ৫৭ ধারার। আর তার পরিবারকে পোহাতে হচ্ছে আদালত ও থানা-হাজতের ঝক্কি-ঝামেলা। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য বোধকরি আর কোনো পরীক্ষার্থী বা আর কোনো পরিবারের হওয়ার কথা নয়।
রায়হান রাহী ‘ইস্টিশন’ ব্লগে ব্লগিং করতেন। তার ব্লগ ও ফেসবুক ঘেঁটে এমন কিছুই পাওয়া যায় না যে জন্য তাকে ৫৭ ধারায় আটক করতে হবে। তাঁর ফেসবুক ঘেঁটে যা কিছু পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একজন নিতান্তই টিনএজের প্রধান আকর্ষণ থাকে যেসব বিষয়ে সেগুলোই রাহীর ফেসবুক পোস্টের প্রধান উপজীব্য। যেমন, বেশিরভাগ পোস্ট হচ্ছে ক্রিকেট-সংক্রান্ত; তাতে আছে আনন্দ, ক্ষোভ ও আশাভঙ্গের কথা। আছে প্রেম ও নারীর প্রতি খুব সাধারণ আবেগ ও আকর্ষণের কথা। রাজনীতি-সচেতনতার চিহ্নও তিনি কিছু কিছু জায়গায় রেখেছেন বটে। কিন্তু কোথাও তিনি ধর্মকে আক্রমণ করেছেন, বিশেষত ইসলামকে, এমন পোস্ট নেই।
যদি কেউ খুব ভালোভাবে রাহীর নোট ও পোস্টগুলো খেয়াল করেন তাহলে তাকে এমনকি ‘নাস্তিক’ বলারও কোনো সুযোগ নেই। রাহীর লেখা ‘মেকী মানবতা তথা বিশ্বদূষণ’ শিরোনামের একটি নোট রয়েছে। এতে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদিদের নিপীড়ন নিয়ে খোলাখুলি পশ্চিমা বিশ্বকে আক্রমণ করা হয়েছে। ভুল বানানে লেখা এই নোটের মাঝের কিছু অংশ তুলে ধরছি–
মালালার একটি বুলেট যদি তালেবান দের বুদ্ধি বিবেক হিন
পশুতে পরিনত করে তাহলে ইহুদিদের এই অত্যাচার এর
কি উপাধি দেয়া যায়? নাকি এই নির্যাতন অপরিমেয়??? এ
কেমন বিশ্ব?বাবা তার মৃত সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, মা তার মৃত
সন্তান এর কাছে ক্ষমা চাইছে যে কেন তাকে জন্ম দিয়ে অকাল
মৃত্যু উপহার দিল! সন্তান তার বাবাকে হারিয়ে নির্বাক আর
সাংবাদিকদের বলছে, “the rocket may be above us,
but they have forgotten ALLAH above them.এই নোট পড়ে স্পষ্টভাবেই ধর্মে রাহীর প্রবল আস্থারই প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিমবিদ্বেষী তো তাকে বলাই যায় না, বরং ফিলিস্তিনের মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হচ্ছে তার প্রতি তার প্রবল সহানুভূতির প্রমাণ রয়েছে।
প্রশ্ন উঠে, তাহলে কেন আটক করা হল রাহীকে? আটকের ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে অবশ্য বোঝা যায় তাকে আটকের পেছনের কারণগুলো।
ইস্টিশনে প্রকাশিত রাহীর সহ-ব্লগারদের লেখা থেকে জানা যায়, আটকের দিন রাহী তার বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে যান এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনার জন্য। সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী। তারা রাহী ও তার বন্ধু উল্লাসের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। এরপর পুলিশ আসে এবং রাহী ও উল্লাসকে সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৫৭ ধারায় রাহীর নামে মামলা করেন চকবাজার থানার এসআই শিবেন বিশ্বাস।
ব্লগপোস্ট থেকে জানা যায়, থানায় আগে থেকেই রাহীর নামে ত্রিশ পৃষ্ঠার মতো নথিপত্র জমা দেওয়া ছিল। সেসব নথিপত্রে মূলত জামাত-শিবিরের ফেসবুক পেইজ (যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক সম্পর্কে নানা কটূক্তি করা হয়, যে পেইজটি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ) ‘বাঁশের কেল্লা’র বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ও স্বাধীনতাবিরোধী পোস্টে রাহীর তীব্র প্রতিবাদের অক্ষরমালা প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, রাহীকে গ্রেফতারের পর বিতর্কগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এর কী কারণ? স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কাজটা করা হয়েছে এই জন্য যে, যাতে প্রমাণ করা না যায় যে, ‘তথাকথিত’ নাস্তিক হওয়ার জন্য নয়, বরং জামায়াত-শিবিরের প্রোপাগাণ্ডার প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাহী আজ বিপদে পড়েছেন।
এছাড়াও সেখানে ছিল ফারাবী নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিকৃত-মস্তিষ্কের শিক্ষার্থীর (জামাত-শিবিরের আক্রমণে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকিদাতা) বিভিন্ন সাইকো-প্যাথেটিক বক্তব্যের বিরুদ্ধে রাহীর তীব্র ও শাণিত প্রতিবাদ।
রাহীর ফেসবুক প্রোফাইলটি আবার একটু ঘুরে আসা যাক। তাকে গ্রেফতারের পর তার টাইমলাইনে অন্যান্য নির্দোষ পোস্টের নিচে একাধিক প্রোফাইল থেকে গালিগালাজপূর্ণ কমেন্ট করা হয়েছে। এই প্রোফাইলগুলোর টাইমলাইন ঘুরে এলে স্পষ্টই বোঝা যায় এগুলোর মালিক জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা।
যেমন, ‘ডেস ওয়া’ (Des Wa) নামের একটি প্রোফাইলের মালিক রাহী ও উল্লাসের মৃত্যুদণ্ড দাবি করছে। দেখুন স্ক্রিন শট–
অদ্ভূত নামের এই প্রোফাইলটি (ডেস ওয়া) ঘুরে দেখা গেল, সেখানে নানা পোস্টে রবীন্দ্রনাথ, হিন্দু ধর্ম ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নামে অসংখ্য বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার। বোঝাই যায়, এটি জামায়াত-শিবিরের একটি প্রোপাগাণ্ডামূলক প্রোফাইল। ডেস ওয়া’র একটি পোস্টের স্ক্রিন শট দেখুন যেটিতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে এবং হিন্দু ধর্ম নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করা হয়েছে।
রাহী-উল্লাসের গ্রেফতারের পেছনে জামায়াত-শিবিরের ঘাপটি মেরে থাকা চরদের শত্রুতার বড় প্রমাণ হল জনৈক ‘নাজমুল হোসাইন ইরফান’ নামের এক প্রোফাইলধারীর টাইমলাইনের পোস্টে প্রকাশিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য। ইরফানের দুটি পোস্টের স্ক্রিনশট আমরা রেখে দিয়েছি যদিও সে এখন ওই দুটি পোস্ট মুছে ফেলেছে। দেখুন–
পরের শটটটি দেখা যাবে ঘটনার সময় উল্লাসকে নাকে খত দিতে বাধ্য করার ঘটনা নিয়ে ইরফানের ‘উল্লাস’–
পাঠক, দুটো স্ক্রিন শটে ইরফানের ভাষ্য পড়ে কী বুঝলেন? ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত কি মিলছে না? যে আক্রমণাত্মক ভাষায় সে লিখছে, সেটি লক্ষ করলেই বোঝা যায় এটি কোনো শিবিরকর্মীর ভাষা। সে যে দলটির কথা বলছে (অপরাজেয়) সেটিই-বা কাদের? এসব কি তলিয়ে দেখা হবে? ইরফানের স্বীকারোক্তি (ফেসবুক পোস্টে) অনুযায়ী, সে রাহী ও উল্লাসকে ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এবং ষড়যন্ত্র করে তারা কাজটা করেছে। এখন তাকে কি গ্রেফতার করা হবে?
বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এটাই যে, ইরফান ইতোমধ্যে পোস্ট দুটো সরিয়ে ফেলেছে। যদি স্বতঃস্ফুর্তভাবেই সে কাজটি করে থাকত, তাহলে সরানোর কী প্রয়োজন ছিল?
এই ইরফানই কিন্তু আবার লাইক দিচ্ছে এমন একটি ফেসবুক পেইজে যেটি হিন্দুধর্মের প্রতি বিদ্বেষে ঠাসা। পেইজটির নাম যেমন কুরুচিপূর্ণ, তেমন এটিতে রয়েছে ভয়াবহ হিন্দুবিদ্বেষের ছড়াছড়ি। দেখুন স্ক্রিন শট–
পাঠক, ফেসবুকে এমন অসংখ্য পেইজ ও ব্যক্তি-প্রোফাইল আছে যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী, তাদের সংস্কৃতি ও আচার ইত্যাদিতে আঘাত করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। কই, এসব পেইজের এডমিন বা মালিকদের পুলিশ ধরেছে কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার জন্য– এমনটি তো শোনা যায় না? আর রাহীর টাইমলাইনে এমন কিছু না থাকা সত্ত্বেও তাকে জেলখানায় যেতে হল?
পুরো ঘটনায় দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয়–
এক, রায়হান রাহী ও তার বন্ধু উল্লাস দাসকে প্রথমে শিবিরের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে বেধড়ক মারে।
দুই, পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে আক্রান্ত দুই ব্লগারকে আটক করে এবং তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করে।
তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াল? শিবিরের সন্ত্রাসীদের এতই দাপট যে, তারা সাধারণ নাগরিকের জীবননাশের অপতৎপরতা চালিয়েও পুলিশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে চলে; আর আটক ও মামলার শিকার হয় অসহায় দুই ব্লগার! যে ব্লগাররা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মানরক্ষার্থে নিরন্তর যুক্তির লড়াই করে গেলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার!
সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র তোমার পুলিশ প্রশাসন! কী বিচিত্র তোমার আইন!
দুই
মামলার এজাহারটি ভালো করে পাঠ করে স্পষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। পুলিশ বলছে, সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং সেখান থেকে দুই ব্লগারকে (পুলিশের ভাষায় অভিযোগ প্রমাণের আগেই তারা ‘আসামী’)! ‘উত্তেজিত জনতার কবল হইতে উদ্ধার করিয়া উপস্থিত জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি.. ..’– অর্থাৎ পুলিশ স্পটেই কাজ সেরেছেন।
পুলিশের ভাষায় ‘উত্তেজিত জনতা’ হল শিবিরের সন্ত্রাসীরা। তাদের মাঝখানে দুজন ব্লগারকে রেখে পুলিশ কি ব্লগারদের কোনো বক্তব্য শুনতে পেরেছিল? নাকি একতরফা শিবিরের সন্ত্রাসীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসে? যদি শেষ পর্যন্ত থানাতেই নিয়ে আসে, তবে কেন রায়হান রাহীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন স্পটে সকলের সামনে খোলা হল?
পুলিশ এ কাজ করতে পারে কেবল তখনই, যখন আসামীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকবে। কেবল মোবাইল ফোন খুলে দেখা পর্যন্তই শেষ নয়, সকলের সামনে রায়হান রাহীর ফেসবুকের ইনবক্সের মেসেজ পড়ে শোনানো হয়। সে মেসেজের উল্লেখও রয়েছে এজাহারে।
এখন প্রশ্ন হল, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নয়। উপরন্তু তারা সন্ত্রাসী যাদের হাতে নিরাপদ নয় রাহী, উল্লাসসহ মুক্তমনের ব্লগারগণ। সেই সন্ত্রাসীদের সামনে পুলিশ সদস্যরা কীভাবে একজন ব্যক্তির (পুলিশি ভাষায় আসামী) ব্যক্তিগত তথ্যের উন্মোচন ঘটায়? এটা কি পুলিশের আইন লঙ্ঘন নয়?
ইনবক্স একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর একান্ত ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম। ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস’-এর ‘প্রটেকটিং আদার পিপলস রাইটস’ অংশে সুস্পষ্টভাবে অন্য কোনো ব্যবহারকারীর তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সে নির্দেশনা অবমাননা করেছে; কারণ এজাহারেই উল্লেখ আছে– ‘… ইনবক্সের মন্তব্যগুলি উপস্থিত জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করিলে দেখা যায়…’।
এ পর্যায়ে এজাহারে ফারাবী সাফিউর রহমানের নাম আসে এজাহারে। এই ফারাবীই হল সেই সাইকো-প্যাথেটিক রোগী, যার কাজই হল ফেসবুকে বা ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল ও মুক্তমনের ব্লগারদের নানাবিধ হুমকি দেওয়া, এমনকি প্রকাশ্যে তাদের প্রাণনাশের ঘোষণাদান। এই ফারাবীই শহীদ ব্লগার রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এ কারণে সে তখন গ্রেফতারও হয়।
সম্প্রতি সুলেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়েও সে নানাবিধ কটূক্তি করে যাচ্ছে এবং লেখককে হুমকি দিচ্ছে। এজাহারে ফারাবীর সঙ্গে রাহীর কথোপকথনের উল্লেখ দেখানো হয়। এই ফারাবী ফেসবুকে ও ব্লগে অকথ্য ভাষায় অন্য ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করে প্রায়ই। হায়, এভাবে অন্য ধর্মের অবমাননা করা হলেও রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারা দেখাতে পারে না!
এই ফারাবীর সঙ্গে রাহীর যে কথোপকথন দেখা গেছে, তা থেকে সহ-ব্লগারদের অনেকের কাছেই এটি স্পষ্ট যে, ফারাবীর বানোয়াট ও উদ্ভট তথ্যের জবাব দেওয়াটাই জন্য রাহীর কাল হয়েছে। ফারাবী সেগুলো চালান করেছে থানায়; যা নয় তার চেয়েও গুরুতরভাবে উপস্থাপন করেছে পুলিশের কাছে। শিবিরের সন্ত্রাসী এই বিকৃত-মস্তিষ্কের ফারাবী পুরো ঘটনার কুপ্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
বলাবাহুল্য, ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস’-এর ধারা ফারাবীও অমান্য করেছে এবং ব্যক্তির তথ্যের যে গোপনীয়তা, তাও লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, রাষ্ট্র ধর্মের চোখ দিয়ে দেখছে না।
তিন
সামনে রাহীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। হাতে যে সময় আছে, আর তার উপর দিয়ে যে মানসিক চাপ যাচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠে পরীক্ষা দেওয়াটা তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জটা কেবল তার জন্যই না, আমাদের জন্যও। যে ব্লগার স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ব্লগিং করেছেন– যুক্তির লড়াই করেছেন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করতে– তাদের মিথ্যাচারের জবাব দিতে– উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রাক্কালে তাকে বহন করতে হচ্ছে ৫৭ ধারার অভিশাপ।
যে দেশে প্রতিদিন প্রতিরাত কুচক্রী মহল বিকৃত করছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আর সরকার কেবল বক্তৃতার মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে– যে দেশে ইতিহাস-বিকৃতিকারীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না ৫৭ ধারা– যে দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের পরেও হেঁটে বেড়ায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা, অথচ প্রচলিত আইনের ধারায় তারা আটক হয় না– সে দেশে রাহীর মতো একজন ব্লগার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারবেন না? তাকে হেরে যেতে হবে? একটা বছর নষ্ট হবে তার মূল্যবান জীবন থেকে?
আর যারা নির্বিকারে এখনও ‘বাঁশের কেল্লা’ চালিয়ে যাচ্ছে, অপমান করছে আমার মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা, অপমান করছে জাতির পিতাকে– প্রতি ঘণ্টায়– প্রতি মিনিটে– সেসব নরপশু কিনা ঘুরে বেড়াবে! এটা কী ট্র্যাজিডি?
নাকি আলোহীন ভবিষ্যতে অচেনা এক বাংলাদেশের এপিটাফ?
১৯ চৈত্র ১৪২০
লেখাটি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো উল্লিখিত তারিখে। বিডিনিউজে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।