২০০৪ সালের কোনো এক রৌদ্রদগ্ধ দুপুরের কথা মনে পড়ে। সম্ভবত সে বছরই আমার প্রিয় ব্যান্ড রেনেসাঁর নতুন একটি অ্যালবাম রিলিজ হলো একুশ শতকে রেনেসাঁ শিরোনামে। তখনও আমাদের ক্যাসেটে গান শোনার দিনগুলো শেষ হয়ে যায়নি। ওই অ্যালবামের একটি গান— সে সময়ে যে বাঙলাদেশের ছবিটা আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখতাম— তার সঙ্গে কী অবলীলাক্রমে মিলে গিয়েছিল। ‘হে বাংলাদেশ/ তোমার বয়স হলো কত?/ এখনও হেলে আছ একদিকে/ যেন যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে’— আজ থেকে সতেরো বছর আগের একটি গান।
বাঙলাদেশের বয়স এখন পঞ্চাশ। প্রাণীর ক্ষেত্রে বয়সের হিসেবটা যেমন দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তো তেমন নয়। পঞ্চাশ বছরের বাঙলাদেশ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাঙলাদেশ— কিন্তু তার মানে তো এই নয়, বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিটি উপাদানের বয়সই পঞ্চাশ। কিংবা পঞ্চাশ বছর বয়স্ক পরিণত বাঙলাদেশের দিকে তাকালে আমরা কি এখনও তার অনেক অপরিণত-অবিকশিত কোষ দেখতে পাই না? তাহলে পঞ্চাশ বছরের বাঙলাদেশ মানে, স্বাধীন ভূ-খণ্ডের পঞ্চাশ বছর। তার রাষ্ট্র হয়ে ওঠা কিংবা রাষ্ট্র হতে হতে আবার ছিটকে পড়া, রাষ্ট্র হিসেবে বাঙলাদেশকে ইতিহাসচ্যুত করে দেয়া কিংবা পুনরায় ইতিহাসের কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা— ইত্যাদি দোলাচলে, প্রশ্নে-উত্তরে আসলে বাঙলাদেশের বয়সটা নির্ধারণ করা উচিত। এ বোধ করি প্রত্মতাত্ত্বিক হিসেবের চেয়েও কঠিন, কেননা আপাতসরল কার্বন ডেটিং পদ্ধতির কোনো বন্দোবস্ত এখানে নেই।
স্বাধীন বাঙলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুল আলোচিত রাজনৈতিক পদবাচ্য হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। স্বনির্ভর অর্থনীতির আলোচনা করতে গেলে যেহেতু তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটতে হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার আলোচনা করতে গেলে যেহেতু মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়টিকে তুলে আনতে হয়— তাই ‘গণতন্ত্র আছে কি নেই’— এই তর্কটা আমাদের আড্ডাতে জিইয়ে রাখতে পারলে আমাদের পরিশ্রম বাঁচে। ইতিহাসের একজন সামান্য অনুসন্ধানী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি কিংবা পরনির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর চেয়ে জোরালো আলোচনা হয়েছে গণতন্ত্র নিয়ে। তাও গণতন্ত্রের রকমফের নিয়ে নয়, ‘উহা আছে কি নাই’ এই জাতীয় তর্কে আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ গত পঞ্চাশ বছর কলম পিষেছেন, আমাদের রাজনীতিবিদগণ বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্র আদতে কী, রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভূমিকাই বা কী বা গণতন্ত্রের জলে স্নান করা জনগণের মুখ দেখতে কেমন হয়— এই বিষয়ক আলোচনা আমি অন্তত পাইনি; বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়ভার আমরা গোড়া থেকেই শাসকদলের ওপর দিয়ে এসেছি। মানে ব্যাপারটি যেন অনেকটা এমন যে, কোনো রাষ্ট্রে রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট বানানোর মতো গণতন্ত্র বানিয়ে দেয়াটাও সরকারের কাজ। এ বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭৩ সালের সংসদ। বাংলাদেশের প্রথম এই সংসদে বিরোধী দলের কোনো নেতা ছিলেন না। এখানে উল্লেখ করে রাখি, এই ঘটনা কিন্তু বাঙলাদেশেই প্রথম নয়; বয়স আর উন্নয়নের বিচারে যারা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাঙলাদেশের তুলনা করে কপাল চাপড়ান, সেই সিঙ্গাপুরের জাতির জনক লি কুয়ানের টানা চার সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। পার্থক্য শুধু এই, বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন এনেছিলেন, তার প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যা তৎকালীন সংসদ বিতর্কেই পাওয়া যায়; কিন্তু লি কুয়ান সম্ভবত কোনো ব্যাখ্যাও দেননি।
বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন— অবৈধ উপায়ে মন্ত্রীত্ব ঠেকানোর জন্যই তিনি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এনেছিলেন। ওই সময়ে সরকারের বিরোধিতাকারী কয়েকটি দলের সংসদ সদস্য ও কয়েকজন নির্দলীয় সংসদ সদস্য সংসদকক্ষে আলাদা বসার ব্যবস্থা করার জন্য তৎকালীন স্পিকারের কাছে একটি আবেদন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই সংসদ বিতর্কে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, জাসদের আবদুস সাত্তার এবং চারজন নির্দলীয় সদস্য— সৈয়দ কামরুল, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সরকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং চাই থোয়াই রোয়াজা— অংশ নেন। ওই আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা স্পিকারকে জানিয়েছিলেন, আতাউর রহমান খান তাদের নেতা। মানছি, সংখ্যার নিক্তিতে বিবেচনা না করে বঙ্গবন্ধু যদি সংসদীয় রীতিনীতিকে গুরুত্ব দিতেন, তাহলে আতাউর রহমান খান হতেন বাঙলাদেশের ইতিহাসের প্রথম বিরোধীদলের নেতা। এইটুকু পর্যন্ত বললে কিন্তু ইতিহাসের প্রতি অর্ধেক সুবিচার করা হয়। পুরোটা বিচার করতে গেলে সেই ‘না-হওয়া’ বিরোধী দলটির মান কী হতো, সেটার সুলক সন্ধান করাও জরুরি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পেয়েছিল। সংসদীয় দল ও গ্রুপ সম্পর্কে প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনকালেই বিতর্ক ওঠে। সংসদ বিতর্কগুলো পড়লে দেখা যায়, সরকারদলীয় একজন সদস্য সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী সদস্যদের ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সরকারের বিরোধিতাকারী গ্রুপের এক সদস্য এ কথায় আপত্তি জানিয়ে বলেন— ‘আমরা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বিরোধী দল’। বোঝো অবস্থা! বৈধতার প্রশ্নে বিরোধী দল সরকারের স্বীকৃতিকেই গ্রহণ করেছিল? এ যেন গৌরকীর্তন— যে চক্ষে হাসাইলা গৌর, সে চক্ষেই কান্দাও।
ইতিহাসের এই উদাহরণটি আমি উল্লেখ করলাম আমাদের গণতন্ত্রচর্চার সীমাটা নির্ধারণের জন্য— অর্থাৎ গণতন্ত্রচর্চা বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? সংসদ থাকবে, জনগণ ভোট দিক বা না-দিক, তাদের ভোটার আইডি কার্ড থাকবে আর সংসদে বিরোধীদল থাকবে— যেমন স্বৈরশাসক এরশাদের সময় ছিল আ স ম আবদুর রবের গৃহপালিত বিরোধী দল আর আমাদের বর্তমান সংসদে এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো অর্ধমৃত বিরোধী দল।
কিন্তু গণতন্ত্র কি এ পর্যন্তই? বিজ্ঞজনেরা নিশ্চিতভাবেই না-সূচক মাথা নাড়বেন। কিন্তু এরপর তাঁরা গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলবেন, সেগুলো কোথাকার? কাদের সংসদীয় ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থার তুলনা করবো আমরা? আমাদের সংসদের সিংহভাগ সদস্যই পেশায় ব্যবসায়ি। দলের নিবেদিতপ্রাণ সৎ কর্মীর যদি আর্থিক সঙ্গতি না থাকে, তবে দল তাঁকে মনোনয়ন দিবে না; কারণ প্রতিটি দলই জানে প্রতিপক্ষ এতটা সরল অংক কষে না। সুতরাং আগে খবর হতো নির্বাচনের মাঠে কত টাকা ঢালা হচ্ছে, এখন খবর হয় কে কত টাকা দিয়েও মনোনয়ন বাগাতে পারছে না।
নির্বাচনের জন্য এই কোটি কোটি টাকা কোথায় খরচ হয়? গণতন্ত্র কায়েমের জনমনস্তত্ত্ব কই? সাধারণ জনগণও তো মনে করেন সৎ নির্ভীক কিন্তু দরিদ্র প্রার্থী যত ভালোই হন না কেন, তিনি ভোটে জিততে পারবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে মানলাম, কিন্তু এই কাজে ব্যবহৃত হয়েছেন কারা? সেই জনগণ, যারা প্রজাতন্ত্রের মালিক। ঘুঁটি যখন বুঝে যায় যে সে ঘুঁটি, তখন তার দামও বেড়ে যায়। অতএব আগে জনপ্রতি যে টাকায় জনগণ নিজেকে ভাড়া দিতেন, এখন তার দর বেড়েছে। অনলাইন-অফলাইন সবখানেই ব্যবহৃত হতে হয় যে!
অনলাইনের প্রসঙ্গটি যখন এলোই, তখন বলা প্রয়োজন, অন্তত বাঙলাদেশের প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ আর মাধ্যম মাত্র নেই, ওটা সামাজিক যোগাযোগ সংসদ হয়ে গেছে— দেশের একমাত্র সক্রিয় বিরোধী দল, ২৪ ঘণ্টা ৭ দিনের বিরতিহীন সার্ভিস। জনগণের দায়িত্ব যেহেতু ম্যান্ডেড দেয়া, সুতরাং জনগণ বুঝে গেছে খামোখা জনপ্রতিনিধিদের ম্যান্ডেড দিয়ে লাভ কী, আমরা বরং নিজেরাই নিজেদের ম্যান্ডেড দেই। তো এই স্বপ্রণোদিত বিরোধী দল যদিও গণেশ উল্টানোর ক্ষমতা রাখে না কিন্তু গণেশ যে একখান আছে আর তা যে উল্টানোও যায়— এটা বোঝে। ফলে জঙ্গীগোষ্ঠী থেকে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, ব্যবসায়ি থেকে ভূমিদস্যু সবাই ভেঙে কাঁঠাল খাওয়ার মতো একটা পাকাপোক্ত মাথা পায়— জনগণের মাথা।
তবে একটা বিষয়ে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ সৎ। যুক্তিতে হোক বা অযুক্তিতে সরকারবিরোধীতার কোনো বল এরা মাঠে রাখে না— হয় বাউন্ডারি, নাহয় ওভার বাউন্ডারি। ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদী বক্তা আবু ত্ব-হা আদনানের ব্যক্তিগত সফর বা লুকোচুরিকে ফেসবুক গুম বানিয়ে সরকার পতনের ডাক পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। সেই ফরহাদ মজহারের স্টাইল। গত কয়েকদিনে আমি এ বিষয়ে যতজনের পোস্ট পড়েছি, পড়ে মনে হয়েছে, সেই উগ্রবাদী বক্তা নিজে এসেও যদি বলে সে ‘গুম হয়নি’, তবুও বঙ্গফেসবুকবাসী এটা মানতে নারাজ। এখন দেখি আর মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদ স্যারের শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদটি।
পঞ্চাশ বছরের বাঙলাদেশে স্বনির্ভর অর্থনীতির কয়েকটি ধাপ আমরা পেরিয়েছি। কিন্তু স্বনির্ভর রাজনীতির? রাজনৈতিক প্রপঞ্চগুলোর যে একটি স্বদেশী ও স্বজাতীয় পরিভাষা নির্মাণ করতে হয়, এটা পঞ্চাশ বছর পরও আমরা জানি না, নাহয় মানি না। আমরা যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তবে বুঝতে পারবো— এই স্বদেশী রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টাটাই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গণতন্ত্রকে তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, সমাজতন্ত্রকে তিনি ‘আমাদের সমাজতন্ত্র’ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের পর এগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। স্বয়ং আওয়ামী লীগও এখন ওমুখো হতে নারাজ। আদর্শভিত্তিক জাতীয় সরকারের ‘বাকশাল’ মডেলকে বানানো হয়েছে ‘একনায়কতন্ত্র’ কিন্তু সামরিক সরকারের শাসনামলকে আবার ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ বলে প্রচার করা হয়েছে। এখনও বাকশালের কথা উঠলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ছ্যাঁৎ করে ওঠেন— যেন গরম তেলে বেগুনটা সবে পড়ল। কারণটা না বুঝলেও অনুমান করতে পারি। গত পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার অবমুক্ত বাঙলাদেশ বিষয়ক দলিলগুলো তো একটু খোঁজ-খবর করলেই পাওয়া যায়। কতো নাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! সব কী আর পড়া যায়, পড়লেও লেখা যায়!
পঞ্চাশ বছর পরও হোঁচট খাবার জন্য কেবল পথের দোষই দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু হোঁচট তো খায় লোকে পায়ের দোষে। এই রাজনৈতিক সত্যটুকু আমরা আজ পর্যন্ত স্বীকার করলাম না।