কিছুদিন ধরে একজন মানুষ আমায় খুব ভাবিয়ে তুলেছেন। আমার চিন্তার ফ্রেমে বারবার একটি প্রশ্ন রেখে গেছেন— ‘আমি কী বলি নাই?’ তিনি বলেছিলেন, বহুদূরের কণ্ঠস্বরের ক্ষীণ সুরের পালে হাওয়া লাগিয়ে তিনি সত্যিই বলেছিলেন; বলেছিলেন—
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তান থাকবে না— এর ভেতরে একটি নূতন রাষ্ট্র নবজাতকের মতো চিত্কারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে
কিন্তু এইটুকু বলে দেয়াতেই কী সব হয়ে যায়? যায় না। বাঙালির বন্ধু ভাগ্য কতোটা সুপ্রসন্ন তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু বাঙালির শত্রুভাগ্য এক কথায় ঈর্ষণীয়। দূরের ছবি না দেখলেও সেই পাকিস্তান সময় থেকেই বর্বরতার খড়গ নিয়ে পাকিস্তান বাঙালিকে গ্রাস করতে চেয়েছিলো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১— দীর্ঘতর না হলেও দীর্ঘ একটি সময়; এই সময়কালে ইতিহাস তৈরি হয়েছে, ভেঙেছে বেঈমানির চার দেয়াল, তৈরি হয়েছে একটি রাষ্ট্র, স্বাধীনতার সুউচ্চ সৌধে যার নাম ‘বাঙলাদেশ’।
এই বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও বেশ অদ্ভুত একটা নিয়তি নিয়ে বড়ো হয়। বাঙলাদেশ তার শৈশব পেরোনোর আগেই পিতৃহারা হয়, চালান হয়ে যায় শয়তানের ভাগাড়ে; পঁচাত্তর থেকে বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে কোনো কনে দেখা রোদ আসেনি, কেবল শকুন চিনে নেবার রাত নেমেছে। সংবিধান থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে দুটি স্তম্ভ— ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। আর সেখানে ঠাঁই দেয়া হয়েছে কিছু কুৎসিত কথা, পবিত্র সংবিধানকে করে তোলা হয়েছে স্পর্শের অযোগ্য; রাষ্ট্র নামের ‘বাঙলাদেশ’ রাষ্ট্রের প্রেত হয়ে বড়ো হতে থাকে— তার বয়স বাড়ে একাত্তর থেকে একাশি, একাশি থেকে একানব্বই, একানব্বই থেকে দু হাজার এক, দু হাজার এক থেকে দু হাজার এগারো.. ..কড়ায় গুনে চল্লিশ বছর— কিন্তু বাঙলাদেশ আসলে শৈশব থেকে জঠরের অন্ধকারে যেতে থাকে। ক্রমশ অন্ধকার; সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দেশ আজ ষোলো কোটি শুয়োরের বাচ্চার দেশ, তাজউদ্দীন আহমেদের অর্থ-পরিকল্পনার বাঙলাদেশ আজ ঋণখেলাপীর গ্যালারির বেশ্যা.. ..। কিন্তু অচেনা এক কারণে এই বাঙলাদেশকে ভালোবেসেছেন অনেকেই, জানি না কেনো— হয়তো ‘বাঙলাদেশের’ চোখ দুটো খুব সুন্দর, মায়াবী; কিংবা তার অধরে একটি তিল আছে হয়তো, ভোরের সূর্যালোকের মতো ধ্রুব, উজ্জ্বল; এবং এটাও আশ্চর্য যে— বাঙলাদেশকে ভালোবাসেন যাঁরা, তাঁদেরও খেতে হয় গলাধাক্কা; সায়মন ড্রিঙ-এর কথা মনে করা যেতে পারে; পরের ইতিহাস যাই হোক এই বাঙলাদেশে এমন সরকারও আসে যারা সায়মন ড্রিঙ-এর মতো মানুষকে বের করে দেয়।
এসব কিছু নিয়ে আমি যখন ভীষণ ভাবনায় মত্ত— তখনই নামে বৃষ্টি, বৃষ্টির সাথে আমার ঘরে আসেন ডেভিড ম্যাকাচ্চন, তাঁর হাতে একাত্তরের সেই অবিনাশী কবিতাখানি। অনেকখানে ছিঁড়ে গেছে, পাবলিক লাইব্রেরির শীর্ণ দু’তালার পুরোনো পত্রিকা থেকে জোড়াতালি দিয়ে যেটুকু উদ্ধার করা হলো, সেটুকু নিয়েই এসেছেন ডেভিড ম্যাকাচ্চন।
.. ..he spoke of killing still going on Dacca.. ..
.. ..wrote that the sun rises and sets
and the sky is blue as though nothing had happened
and here too in England!
It has been a wonderful spring of warm days,
blue skies, fresh breezes and flowers,
the trees so green,
the air delicious with scented freshness,
and the students lie about on the grass
in bright clothes making it impossible to believe
that life could be so miserable, elsewhere. ১
বন্ধুর চিঠিতে খবর
হত্যার তাণ্ডবলীলা প্রবল গতিতে চলছে,
বিশেষত ঢাকায়।
লিখেছে বন্ধু— সেখানে সূর্য ওঠে আবার অস্ত যায়!
আকাশ নাকি আগের মতোই সুন্দর-স্বচ্ছ-নীল,
মনে হবে যেনো কিছুই ঘটেনি, স্বাভাবিক রাত আর দিন!
আর এখানে, এই ইংল্যান্ডে?
একটা আশ্চর্য সুন্দর উত্তাপের দিনে গড়া
বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে।
আকাশ তেমনি নীল, সঙ্গে
নির্মল মৃদু হাওয়া আর সতেজ ফুলের পাপড়ি।
গাছগুলো কতো সবুজ!
চারদিক স্নিগ্ধ আমেজে ভরা!
আর ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল পোষাকে
গড়িয়ে পড়ছে ঘাসে।
পৃথিবীর কোথাও কোথাও মানুষের জীবন
কতো কষ্ট আর হাহাকারে পূর্ণ।
চিঠিটি লেখা হয়েছিলো একাত্তর সালে, বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়; মানে কবিতাটিও সে সময়েই লেখা। ডেভিড ছিলেন মূলত মন্দির গবেষক। ইংল্যান্ডের কভেন্টির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ডেভিডের জন্ম হয় ১৯৩০ সালের ১২ আগস্ট। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কভেন্টির ‘কিং হেনরী এইট গ্রামার স্কুল’ এ তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষালাভ। তারপর আঠারো মাস (১৯৪৯-৫০) দেশের আইনানুযায়ী সামরিক কর্মে যোগদান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শুরু। কেম্ব্রিজের ‘যেশাস কলেজ’ এ অধ্যয়ন ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৫ সালে ইংরেজি-ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষা-সাহিত্যে ‘ট্রাইপস’ পেয়ে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে কেম্ব্রিজ থেকে স্নাতকোত্তর হন। কর্মজীবনের শুরুতে (১৯৫৩-১৯৫৫) ডেভিড দক্ষিণ ফ্রান্সের দুটি ফরাসী বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিশেবে শিক্ষকতা করেন। এরপর দু’বছর পিতা-মাতার সঙ্গে কভেন্ট্রিতে বসবাস করেন। ১৯৫৭ সালে ভারতে আসেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির প্রভাষক হিশেবে। ১৯৬০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের প্রভাষক হিশেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৪ সালে ঐ বিভাগের রিডার পদে উন্নীত হন। বিলেতে থাকাকালীন তিনি ছিলেন ‘ট্যাগোর সোসাইটি’র একজন উদ্যোক্তা২ ; ভারতবর্ষ ও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর যথেষ্ট কৌতুহল। তাই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর একটি অনবদ্য মায়া ছিলো। তিনি তাঁর এক লেখায় লিখেছেন—
বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে একটা প্রাণ আছে যা এই অঞ্চলের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখে। এই সংস্কৃতি কোন ধর্ম-সমাজ-বর্ণ বা গোত্র দ্বারা বিভক্ত না, যদিও এখানে বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়।৩
১৯৬১ সালের কথা। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে দেবে না পাকিস্তান সরকার। বেতারে টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু বাঙালি তার হৃৎ-স্পন্দন ভুলবে কীভাবে? শুরু হলো আন্দোলন। ডেভিড তখন কোলকাতায় থাকেন। কোলকাতাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটিতে সন্ধ্যার পর বসতেন। নিয়মিত ডায়রি লিখতেন তখন, এবং তাঁর ডায়রির অধিকাংশটুকুই এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে লেখা৪। ১৮৬১ সালের ০৮ মে, বাঙলা ২৫ বৈশাখ, ১৩৬৮ সালে ডেভিড তাঁর ডায়রিতে লিখছেন—
মানুষকে সব-সময়ই যুদ্ধ করতে হয়েছে বিচিত্র অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে— কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ আজ বুঝিয়ে দিলো গান গেয়েও যুদ্ধ করা যায়। পাকিস্তান সরকার তাদের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে তারা একটি জাতিকে নিষ্পেষিত করার চক্রান্ত চূড়ান্ত করেছে। আমার বিশ্বাস— পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ সেটা প্রতিহত করতে পারবেই।৫
২০১২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘রবীন্দ্র-উত্তর বাঙালি দর্শন’ শীর্ষক সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধের একস্থানে রয়েছে—
ইংরেজ অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকাচ্চন ১৯৬২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে সমবেত শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ একত্রে গান করেন—
কে এসে যায় ফিরে ফিরে আকুল নয়ননীরে।
কে বৃথা আশা ভরে চাহিছে মুখ’পরে।
সে যে আমার জননী রে।।
কাহার সুধাময়ী বাণী মিলায় অনাদর মানি।
কাহার ভাষা হায় ভুলিতে সবে চায়।
সে যে আমার জননী রে।।৬
গানটি দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া। এর সঙ্গে ডেভিড ম্যাকাচ্চনের আয়োজিত অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নেই। কেবল আগ্রহী পাঠকদের জন্য গানটি শোনানোর অভিপ্রায়ে এখানে দেয়া হলো।
১৯৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তিন থেকে চার সপ্তাহের জন্যে ডেভিড আসেন বাঙলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান)। তিনি আসেন মূলত মন্দির-মসজিদ ও প্রাচীন অট্টালিকা দেখার জন্যে। অশ্রান্তভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকেন যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সে সময় বাঙলায় চলছে স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন।
সে সময়ের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ডেভিড একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন দ্যা রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পত্রিকায়। তিনি লেখেন—
পাকিস্তানের জনগণ যে সুখে নেই, সেটা বোঝা যায়। অনেকেই বলতে চাইছেন সেখানে একটি অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে উল্টো— পশ্চিম পাকিস্তানের আচরণ (পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি) অসহ্য। আমি গ্রামে ঘুরে ঘুরে দেখেছি সেখানকার মানুষদের মধ্যে কোনো হিন্দ-মুসলমান বিভেদ নেই, কিন্তু পাকিস্তান সরকার ধর্মের ধুয়া তোলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।.. ..শুনেছি এদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও নাকি সাম্প্রদায়িকীকরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাকিস্তানে হিন্দুরা কোনো উত্সব অনুষ্ঠান করতে পারে না, এটা যতোটা না পড়শি মুসলমানের বাধা তার চেয়ে বড়ো বাধা সরকার ও তার লোকজন।.. ..পূর্ব পাকিস্তানে হাঙ্গামা জটিল হয়ে পড়ছে মূলত দুটি কারণে; একটি হলো— সরকারের বৈষম্যনীতি ও পূর্ব-পাকিস্তানিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অন্যটি হলো— অবাঙালিদের (বিহারিদের) সরকার কর্তৃক মৌলবাদী সুবিধা প্রদান করা।… পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশের একটি বড়ো কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যনীতি; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা দমন-পীড়নের আশ্রয় নিতে ব্যস্ত। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধারণা এটা হচ্ছে অজ্ঞতার কারণে, তাই তারা সেখানে পাকিস্তান কাউন্সিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নেয়। এদের অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ খোলা হবে, এতে নাকি পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা হবে। আমার কষ্ট হয়েছি এই ভেবে যে— শেষ পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে! .. ..কিন্তু একটি বিষয় আমার বারবার মনে হয়েছে, বিশেষত পাবনায় গিয়ে যে— পূর্ব-পাকিস্তানের ভেতরে একটি নূতন দেশ লুকিয়ে আছে, তার প্রতিবাদ যেনো সে দেশের ছবিটাই দেখায়। ৭
ডেভিড মারা যান ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি; উডল্যান্ড নার্সিং হোমে। বাঙলাদেশ তখন স্বাধীন। বাঙলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই ডেভিড বলে গিয়েছিলেন-
‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তান থাকবে না— এর ভেতরে একটি নূতন রাষ্ট্র নবজাতকের মতো চিত্কারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে’
ডেভিড ম্যাকাচ্চন বিশ্বাস করতেন— বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য— হিন্দু, মুসলমান কিংবা বৌদ্ধধর্ম নয়। বাঙলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়— ডেভিড ছিলেন তখন ইংল্যান্ডে। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অত্যাচারের সংবাদে তিনি উদ্বিগ্ন সময় কাটিয়েছেন এবং সে সময়টাতে তিনি ছিলেন খুব অসুস্থ। সে সময় তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও গবেষক, সমালোচক ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের কাছে লেখা এক আবেগঘন চিঠিতে আমরা পাই—
সুহৃদ— কী হচ্ছে বাঙলাদেশে? এভাবে পাকিস্তান সরকার মানুষ হত্যা করছে? তোমরা চুপচাপ কেনো? সংবাদমাধ্যমে তো সব খবর পাই না। গার্ডিয়ানের একটা খবরে পড়লাম সেখানে নাকি নারী নির্যাতন চালাচ্ছে ‘স্টুপিড সোলজাররা’? সুহৃদ— আমার ভালো লাগছে না; নার্সিং হোমের দিনগুলো খুব কষ্টে কাটছে। আমি কী কিছুই করতে পারবো না বাঙলাদেশের মানুষগুলোর জন্য? আমি যেবার সেখানে গিয়েছিলাম, তাঁদের আতিথেয়তা দেখেছি। তাঁরা কেমন আছে সুহৃদ? কী ঘটছে চারপাশে? আমি কেনো অক্ষম হয়ে গেলাম এই যুদ্ধের সময়ে?
শুনেছি শরণার্থীরা নাকি ভারতীয় সীমান্তে এসে আশ্রয় নিয়েছে? তুমি খোঁজ করো— ওঁদের মধ্যেই হয়তো আছেন ময়মনসিংহের সেই পরিবারটি, যাঁরা আমাকে খাওয়ানোর জন্যে একবেলা না খেয়েছিলো। সুহৃদ— অনুজ আমার, তুমি এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাও, আমার লকারে Kodak-Duo ক্যামেরাটা আছে, আর যোগাযোগ করো অমিয় ব্যানার্জীর* সঙ্গে— তাঁর কাছে আমার Agfa-Isolatte ক্যামেরা আর Weston Master III মডেলের এক্সপোজারটা আছে। এগুলো বিক্রি করো সুহৃদ— আবেগ দেখানোর সময় এখন না; এগুলো বিক্রি করে যা পাও তা নিয়ে শরণার্থী শিবিরে যাও। ওইখানে বাঙালিরা রয়েছেন— যাঁরা মাটির কাছে থাকেন, যাঁদের শান্তির নীড়ে হায়না হানা দিয়েছে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে মানবজীবন সার্থক হবে না সুহৃদ। তুমি যাও। কী করলে দ্রুত জানিও। আমি পঙ্গু হয়ে নার্সিং হোমে পড়ে না থাকলে তোমাকে এই কষ্টটা করতে হতো না।
ডেভিড ম্যাকাচ্চন— সেদিনের সেই চিঠিটাই নাকি ছিলো আপনার লেখা শেষ চিঠি? আমি অবশ্য কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র পাইনি; অনুস্টুপ-এর শরৎ সংখ্যায় প্রতিভা সান্যালের ‘পটুয়া আর্ট’-এর ওপর এক লেখায় বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে। এটা কী সত্যি আপনার লেখা শেষ চিঠি?
যদি তাই হয়— তবে শুনুন ডেভিড ম্যাকাচ্চন; এর কোনো উত্তর ড. সুহৃদ আপনাকে দিয়েছিলেন কি না আমি জানি না, আপনার ক্যামেরাগুলো বিক্রি করে কয়জন শরণার্থীকে সাহায্য করা গিয়েছিলো আমি জানি না, জানি না ময়মনসিংহের সেই পরিবারটি বেঁচে আছে কি না— এসব কোনো কিছুই জানবার দরকার নেই আমার।
তবে আপনাকে কয়েকটি কথা জানাতে চাই। যে রাষ্ট্রটি ‘স্বাধীন হবেই’ ভেবে আপনি নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিলেন, সত্যি সে রাষ্ট্রটা স্বাধীন হয়েছে; ডেভিড— ওই হায়নারা ত্রিশলক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে, এর বিচার হয়নি; দুই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনার দীর্ঘ-ভারী নিঃশ্বাস এখনও আমাদের বিবেকের পর্দা দুলিয়ে যায়, এরপরও এগুলো নিয়ে মিথ্যাচার করে শর্মিলা বসুর মতো গবেষকরা। ডেভিড— তারপরেও আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, বাঙলাদেশ এখন চল্লিশ পেরোনো গাঙচিল, অজস্র মিথ্যাচারের মধ্যেও এখনও এই বাঙলাদেশে প্রতিদিন সকালে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা গায়— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি.. ..’। পৌরাণিক বৃষ্টির মতো ধ্বংস নেমে আসে মাঝে মাঝে, তারপরেও রবীন্দ্রনাথের মতো স্থির-ধ্রুব-অবিচল জেগে থাকে বাঙলাদেশ, উন্মুক্ত নীলিমার দিকে তাকিয়ে; ওইতো আসছে ১১ই জ্যৈষ্ঠ— ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ নিটোল বাঙলাদেশ দেখবেন কেমন আলগা করে খোঁপার বাঁধন, যেনো রাণী হয়ে আসে। এই আমার বাঙলাদেশ ডেভিড ম্যাকাচ্চন, যার স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘কিছু করতে পারেননি বলে’ আপনি আপনার শেষ বয়সের পঙ্গুত্বকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।
ডেভিড ম্যাকাচ্চন— আপনি যেখানেই থাকুন- ভালো থাকুন।
- Hindu-Muslim Artistic continuities in Bengal, Journal of the Asiatic Society of Pakistan, December, 1968.
- Temples of Bengal (some resque proposals), Now, October 06, 1967
- The Ramayana on the temples of Bengal, Eastern Railway Magazine.
- Fascinating Record of a Bygone Life: Terracotta temple need immediate protection, Statesman, February 08 & 10, 1966.
- The Impact of the Europeans on the temple Art and Architecture in Bengal, Quest, Monsoon, 1967.
- Pinnacled Temples of Bengal, Quest, July-August, 1971
- An Unidentified Samaharamurti of Siva at Bhaior (West Bengal), Journal of Indian History, August, 1970.
- Temples of Calcutta, Bengal Past and Present, January-June, 1966.
- Temples Round Krishnanagore, Rammohun College Journal, 1965-66.
- The Temples of Birbhum, The Visvabharati Quarterly, 1967.
- Notes on Some Temples in Howrah District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on the Temples of Purulia District, Published in District Handbook, 1961.
- Notes on Some of the more important temples of Hoogly District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on Some Representative Temples of Midnapur District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on Some Temples in Bankura District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on Some Temples in 24 Parganas District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on Some Old Temples and Mosques in Murshidabad District, Published in District Handbook, 1961
- Notes on Some Temples in Birbhum District, Published in District Handbook, 1961
- Ancient Monuments and Fairs, Prof. David J McCutchion of Jadavpur University has kindly revised this account taken from A. Mitra’s glossary of better known Ancient monuments of Nadia.
- The Temples of Burdwan District (Unpublished)
- Field Guide to the Ancient Monuments and Museums of East Bengal, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যাল কর্তৃক প্রকাশিত Calcutta Review তে প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে লিখিত।
- Patua Art: Recent Developments in Style and Presentation, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (কোলকাতা) কর্তৃক আয়োজিত পট ও পটুয়া সম্বন্ধে আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধ।
- The Temples of Burdwan District, সেন্সাস বিভাগের হ্যান্ডবুকের জন্য বিশেষভাবে লিখিত।
- Kali Temple at Malancha, Kharagapur
- Comparative Religion and the Spirits of Tolerance, (৪ ও ৫ নং প্রবন্ধ দুটো ডেভিড ম্যাকাচ্চনের বন্ধু সুহৃদ ভৌমিকের কাছে আছে)
- Ancient Temples, Mosques and Churches of Calcutta, নিরঞ্জন হালদারের অনুরোধে লিখিত।
- Architectural Styles of Bengal Temple, এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত বক্তৃতা।
- Temple Terracotta of Bengal, Art Industry- এর আয়োজিত সভার বক্তৃতা।
- পূর্ব পাকিস্তানের মন্দির, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৌষ-চৈত্র ১৩৭৫
- বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা, এক্ষণ, কাতির্ক-মাঘ, ১৩৭৫
- বাংলার পোড়ামাটির মন্দির, সাহিত্যপত্র, আষাঢ়, ১৩৭৭
- পূর্ব পাকিস্তানের অন্তরে, খানাকুল হুগলী থেকে প্রকাশিত, বৈশাখ, ১৩৬৫
- তুলনামূলক ধর্ম ও সহনশীলতার মনোভাব, বৈশাখ, ১৩৬৭
- কলিকাতা ও আশপাশের মন্দির, অন্বিষ্ট, শারদীয়া, ১৩৭০
- The Temples of Bankura (1972), Writers’ Workshop.
- The Temples of Birbhum, Visvabharati Santiniketan.
- Indian Writing in English- Critical Essays (1969), Writers’ Workshop.
- Late Mediaeval Temples of Bengal: Origins and Classifications (1972), The Asiatic Society
- Patuas and Patua art in Bengal (1999), Firma KLM.
- Brick Temples of Bengal, from the Photo Archives (1983) of David McCutchion Hardcover
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্যে আপনি আপনার প্রিয় ক্যামেরাগুলো বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন; আজ বিয়াল্লিশ বছর পর আমার হৃদয়-প্রহরের ঊর্ণাজালে আমি আপনাকে, আপনার সৃষ্টিকর্মকে ঘিরে রাখবো ডেভিড। ১৯৭১ সালে আমার এই বাঙলাদেশের জন্যে আপনি নার্সিং হোমে বসে কেঁদেছিলেন; আজ বিয়াল্লিশ বছর পর আমি আপনার জন্যে রাজপথে দাঁড়িয়ে কাঁদবো। অঝোর কাঁদবো। বিরামহীন বুক ভাসানো কান্না কাঁদবো।
আপনার কোনো ঋণ তো আর আমি শোধ করতে পারবো না— কেবল এই কান্নাটুকু ছাড়া। সেটুকুই শোধ করে যাবো আমার বাকিটা জীবন। ইতিহাসের খেরোপাতায় নাকি ‘কান্নার দায়’টা শোধ করে যেতেই হয়।
তথ্যসূত্র
১। সমালোচক ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের প্রবন্ধসমগ্র- ০২ এ উল্লিখিত ম্যাকাচ্চন ও তাঁর হেঁয়ালী জীবন প্রবন্ধে উল্লেখ আছে—
ডেভিড একবার আমাদিগকে বলিয়াছিলেন তাহার কোনো এক প্রিয় ছাত্রের কথা। নামখানা বড়ো খটোমটো, মনে পড়িতেছে না.. ..পরে এশিয়াটিক সোসাইটিতে দ্যা লেইট মেডিভ্যাল টেম্পেলস অব বেঙ্গলের উপর কাজ করিবার সময় তিনি একখানা আত্মজীবনী লিখিবার ইচ্ছা ব্যক্ত করিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির তরুণ প্রুফ রিডার জগন্নাথ কাজখানা করিতে সম্মত হইলো। কিন্তু হেঁয়ালীপনার কারণে উহা শেষ হইলো না। পরে অর্ধসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে ‘ছাপানোর কিছু আছে কিনা খুঁজিতে যাইয়া’ এই কবিখানা পাইয়াছি। সম্ভবত ইহা কোনো পত্রের অংশ কেননা পোস্টকার্ড জুড়িয়া ছিলো আর যতোদূর মনে হয় পত্রখানা সেই প্রিয় ছাত্রকেই লিখা হইয়াছিলো’ (ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের প্রবন্ধসমগ্র- ০২, এশিয়াটিক সোসাইটি কোলকাতা হতে প্রকাশিত, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা: ১৯৭)
২। বিলেতে প্রতিষ্ঠিত ট্যাগোর সোসাইটির কার্যনির্বাহী কমিটির তালিকায় ‘এক্সিকিউটিভ মেম্বার’ হিসেবে ডেভিড ম্যাকাচ্চনের নাম পাওয়া যায়। The Tagore Society Journal-XXVIII, p. 335-347
৩। Calcutta Review 1966 এ প্রকাশিত প্রবন্ধ Field guide to the ancient Bangle Culture থেকে অনূদিত, পৃষ্ঠা: ৫৬
৪। ডেভিড ম্যাকাচ্চন ও ফরস্টারের ভাষায় ইংরেজ জাতি, অশোক রায় চৌধুরী, প্রতিভাস, কোলকাতা, ২০০৯, পৃষ্ঠা: ২৯
৫। অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিতে ডেভিড ম্যাকাচ্চন, সুহৃদকুমার ভৌমিক ও জগন্নাথ রায়, মিত্র ও ঘোষ, ১৯৯২, পৃষ্ঠা: ১০০-১০১
৬। সেমিনার বক্তৃতা সংকলন নথি- ২০১২, বাংলা একাডেমী
৭। Impression of East Pakistan, The Radical Humanist, 1965 থেকে অনূদিত।
*। অমিয়কুমার বন্দোপাধ্যায়- বিখ্যাত আলোকচিত্রসংস্থা ‘বর্ন এন্ড শেফার্ড’-এর আলোকচিত্রী এবং আকাশবাণীর সংবাদপাঠক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের মাতুল।
০২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৯