আমাদের শাহীন রেজা নূর ভাইয়ের জাহাজটি এবার বন্দর ছেড়ে গেল। যাঁকে ঘিরে একদিন আবর্তিত হয়েছিল আমার মতো সামান্য কলমচির ঘোরলাগা বিকেল সন্ধ্যাগুলো, আজ তাঁর স্মৃতিসমগ্র ছড়িয়ে আছে চারপাশে— ব্যথাতুর বিষণ্ন, অথচ সদা হাস্যময়। কেননা তুড়ি মেরে জীবনকে তাড়িয়ে নেয়ার ডাকনামই তো ছিল শাহীন ভাই। এ কারণেই বুঝি বসন্তবরণের মাহেন্দ্রক্ষণে প্রকৃতি তাঁর জন্য রচনা করেছে এই বিসর্জন সঙ্গীত? ‘কে বলে ‘যাও যাও’— আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া’— হাটখোলা থেকে শিল্পকলায় রিকশা করে যেতে যেতে শাহীন ভাই গাইতেন। সন্ধ্যাক্রান্ত শহরের বড়ো রাস্তাগুলোতে তখনও সোডিয়াম বাতি ছিল। নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে শাহীন ভাই জোরে হেসে উঠতেন। আশেপাশের যানবাহন থেকে যাত্রীরা ঘুরে তাকাতেন; কিন্তু সেই হাসি ছিল অসংশোধনীয়— অতএব অমর।
সে সময় হাটখোলায় দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়ের দোতালায় ছিল সম্পাদকীয় বিভাগ। শাহীন ভাইয়ের ঘরটি ছিল আমাদের আড্ডার স্বর্গ। বেলা বারোটায় উনার ঘরে ঢুকতাম, বের হতাম সেই সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটায়। কাজ না থাকলেও যেতাম— এমনকি আমাদের সঙ্গে কেউ যদি দেখাও করতে আসতেন, তিনিও শাহীন ভাইয়ের ঘরেই আমাদের খোঁজ করতেন। টেলিফোনে আমাদের কেউ খোঁজ করলে অপারেটর শাহীন ভাইয়ের পিবিএক্স লাইনটি ধরে দিতেন। কোনোদিন যদি আগে জানতে পেরেছি, শাহীন ভাই অফিসে যাবেন না, তবে কাজ থাকলেও আমরা কেউ কেউ সেদিন অফিস যেতাম না। শাহীন ভাইয়ের ঘরের উল্টোদিকের ঘরটায় বসতেন কবি মিনার মনসুর ভাই। উপ-সম্পাদকীয় লেখার আগে উনারা বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করতেন, আমরা পাশে বসে তাঁদের কথা শুনতাম। ইত্তেফাক অফিসের আরকাইভে খবরের কাগজে প্রকাশিত বিষয়ভিত্তিক সংবাদগুলো নিয়ে আলাদা ফাইল করা থাকতো। মাঝে মাঝেই শাহীন ভাই বিভিন্ন ফাইল চেয়ে পাঠাতেন। তখন আমাদের দায়িত্ব ছিল ফাইলগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স বের করা। এই কাজটি করতে করতেই পুরোনো সংবাদপত্রের উপর আমার আকর্ষণ তৈরি হয়। সংবাদপত্রের অফিসে প্রতিদিনের পত্রিকাগুলো ফাইল করা থাকে। সম্পাদকীয় বিভাগের টেবিলে ফাইলগুলো রাখা হয়। পত্রিকাতে কাজ করা মানেই অফিসে ঢুকে আগে প্রতিদিনের খবরের কাগজগুলো পড়া। একবার কী এক সংবাদের প্রসঙ্গে শাহীন ভাইয়ের সামনে আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘এই খবরটা দেখেননি? দু দিন আগেই তো পত্রিকাতে এসেছে’। শাহীন ভাই হেসে বলেছিলেন, ‘দু দশক আগে আসলে বরং ওর চোখে পড়তো’। দুজন মানুষ আমাকে আরকাইভ ব্যবহার করতে শিখিয়েছেন। একজন শাহীন রেজা নূর, অন্যজন অমি রহমান পিয়াল।
দুই
যে সময়ে শাহীন ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছিল, তখন বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো ইত্তেফাক অফিসের পরিস্থিতিও মালিকানা নিয়ে দোদুল্যমান। সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় লেখার সময় তখন সম্পাদকীয় বিভাগ বেশ ভাবতো। অনেক কথাই ইচ্ছে করলে বলা যেত না। কিন্তু তারপরও কীভাবে আসল কথাটি বলে দেয়া যায়, সেটা নিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে বেশ আলাপ-আলোচনা করতেন শাহীন ভাই। তখন তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখারই প্রথম পাঠক ছিলাম আমরা কয়েকজন। নিউজপ্রিন্ট কাগজের ছোটো ছোটো প্যাডে শাহীন ভাই খসখস করে লিখে চলতেন। কখনও কখনও কম্পোজ সেকশনের তাড়া থাকলে দু এক পাতা লিখে লিখে দিয়ে দিতেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যাঁরা সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন শাহীন ভাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সঙ্গে প্রজন্ম ৭১– এর কর্মী সংগঠকরা দেখা করতে অফিসে আসতেন। তখন এই আন্দোলনের নানাদিক খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। জাতীয় সংসদের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক দীর্ঘ মানববন্ধন আয়োজনের তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার সান্নিধ্য পেয়েছি। কোনো কোনো অনুষ্ঠানের প্রেস রিলিজও তিনিই লিখতেন।
শাহীন ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সম্পর্কটি খুব সহজ ছিল। তবে কারও সঙ্গেই তিনি রেগে গিয়ে কথা বলতেন না। রেগে যাবার যথেষ্ঠ কারণ থাকলে তিনি চুপ করে থাকতেন। একবার তিনি আমাকে কঠিন শাসন করেছিলেন। ঘটনাটি একটু না বললে বোঝা যাবে না তাঁর রেগে যাবার কারণটি কী।
এভারেস্ট জয়ী এম এ মুহিত (তখনও তিনি এভারেস্ট জয় করেননি) ভাইয়ের ছোটো বোন রাবেয়া বেবী আপাও তখন ইত্তেফাকে কাজ করতেন। বেবী আপার নেতৃত্বেই আমরা কয়েকজন কাজ করতাম। মুহিত ভাইদের কোনো একটি পর্বতজয়ের আগে গণমাধ্যমকে সে সম্পর্কে জানানোর জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। দিনটি ছিল শুক্রবার। এই সংবাদ সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তব্য রেখেছিলেন প্রথিতযশা অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। ইত্তেফাকের জন্য আমিই সংবাদটি লিখেছিলাম। শুক্রবার থাকার কারণে অফিসেও তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না। পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে শাহীন ভাইয়ের ফোনে। ফোন ধরতেই তিনি বকা আরম্ভ করলেন। ঘটনা হচ্ছে আমি খান সারওয়ার মুরশিদ স্যারের নামের বানান ভুল লিখেছিলাম। কিন্তু অফিসে যাবার আগ পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি, এ আর এমন কী ভুল। শনিবার দিন অফিসে গেলে শাহীন ভাই ঠান্ডা মাথায় আমাকে বলেছিলেন, ‘যে জাতির তরুণ প্রজন্ম অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর নামের বানান ভুলে যায়, সে জাতির ভবিষ্যত যে অন্ধকার, এই বিষয়ে তুমি একমত?’। পরে ব্যাপারটা বুঝলাম— অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ উপলক্ষ ছিলেন, শাহীন বোঝাতে চাইছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নতুন প্রজন্ম কেনো তাঁদের নাম ঠিকঠাক মতো জানবে না? এমন ঘটনা আরেকবার শ্রদ্ধেয় সনজীদা (দন্ত্য-ন-এ হসন্ত হবে) খাতুনের নামের বানানের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। ভুল বানানে তাঁর নাম লেখায় শাহীন ভাই সাদা কাগজে কুড়িবার আমাকে দিয়ে সঠিক বানানটি লিখিয়েছিলেন।
তিন
তাঁর সঙ্গে আমার গভীরতম স্মৃতি হচ্ছে কবিতা প্রসঙ্গে। আমি তখনও মধুসূদন পড়িনি জেনে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। খেদোক্তি করেই বলেছিলেন, ‘মধুসূদন পড় নাই তুমি সাহিত্যচর্চা করবা!’। এরপর শাহীন ভাইই আমাকে কিনে দিয়েছিলেন মধুসূদন রচনাবলী। কলকাতা সাহিত্য সংসদ বের করেছিল বইটি। এরপর প্রায় এক বছর তিনি আমাকে ধরে ধরে মধুসূদন পড়িয়েছেন। আলোচনার মাঝে তিরিশের দশকের কথা উঠতেই তিনি বলতেন, ‘তুমি কল্লোল যুগ নিয়া এত অবসেস্ড ক্যান? তোমার তো মিয়া জাহীদের সাথে কাজ করা উচিত ছিল’। পরে জেনেছিলাম জাহীদ রেজা নূর ভাই তিরিশের দশকের কবিতা সম্পর্কে দারুণ আলোচনা করেন।
শাহীন ভাইয়ের কাছে আমার সাংবাদিকতা শেখা হয়নি, সত্যি বলতে সাংবাদিকতা করার ইচ্ছেও একসময় কেমন উবে গেল। কিন্তু ওই যে তিনি ধরে ধরে মধুসূদন পড়ালেন, ওতেই আমার আগ্রহের কম্পাসটা ঘুরে গেল। আজও মধুসূদন দত্তই আমার কাছে কবিতার বরপুত্র। এখনও মেঘনাদবধ কাব্য কি কৃষ্ণকুমারী নাটক পড়তে বসলে মনে হয় নক্ষত্রের দোষে দস্তয়েভস্কি ও মধুসূদন হননের বদলে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এভাবেই শাহীন ভাই মধুসূদনকে আমার মধ্যে প্রোথিত করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে ভাগ্য বদলই সম্ভবত আমার নিয়তি।
এই বিচারে আমি আর শাহীন ভাই তো গুরুভাই। স্বর্গের অবিনশ্বর রেস্তোরাঁয় আপনি মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর আবৃত্তি করলে আমি ঠিক শুনতে পাবো।
বিদায় শাহীন ভাই!