অমর একুশে বইমেলা বাঙালির এক অলৌকিক পবিত্র আয়োজন। একুশের সূর্যমুখী চেতনাকে ধারণ করে বইমেলা আমাদের মাথা নত না করার এক দৃপ্ত প্রত্যয়। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা উদ্বেল হই বইমেলার তরঙ্গে, আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন বইয়ের প্রতীক্ষা। সারা বছর এই একটি মেলার জন্য কেবল লেখক-প্রকাশকরাই নন; আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন সারাদেশের নানা প্রান্তের মানুষ। গণমাধ্যম জুড়ে থাকে বইমেলার আয়োজন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠাগারগুলো বই কিনতে আসে এই মেলায়। সবকিছু মিলিয়ে এই মেলা হয়ে উঠে আমাদের এক অনন্য উৎসব, আমাদের মহান একুশের চেতনার এক অপূর্ব স্মারক।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকেই। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভূত-দর্শনকে ছুঁড়ে ফেলে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির যে দর্শন, তাকে ঘিরেই রচিত হয় আমাদের ভাষা আন্দোলন। বায়ান্নর অনিঃশেষ চেতনার পথ ধরেই এগিয়ে যেতে থাকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পথ— রচিত হয় একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ কূট-চেতনার বিপরীতে উচ্চারিত হয়েছে বাংলার অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। পাকিস্তানের বর্বর শাসনামলে গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরার ইতিহাস আমরা স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম পড়েছি; মত-প্রকাশ বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বুট জুতো মোড়া খড়গের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সে-ই শোষণ বঞ্চনা আর ধর্মান্ধতার অচলায়তন ভেসে যায়— বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মানের প্রত্যয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী পরাজিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানি অপ-দর্শনের মূলোৎপাটন হয় কি? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা পেয়ে আসছি। পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ আবার চলে যায় সামরিকতন্ত্র আর মোল্লাতন্ত্রের কবলে। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হয়েছে বাংলার মানুষকে, রক্ত দিতে হয়েছে রাজপথে। এই সার্বিক সংগ্রামমুখর শুভ চেতনাকে ধারণ করেই বইমেলার সূত্রপাত এবং এগিয়ে যাওয়া।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে এই মেলার আয়োজন হয় অনানুষ্ঠানিকভাবেই— শ্রদ্ধেয় শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে। মুক্তিযুদ্ধকালে কোলকাতায় প্রকাশিত বিভিন্ন বইসহ সদ্য প্রকাশিত কিছু বই নিয়ে ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির মাঠে বিক্রির ব্যবস্থা করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বইমেলায় প্রাঙ্গন ব্যবহারের সম্মতিটুকু ছাড়া বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা ছিলো না। মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ আরও কিছু প্রকাশনীর নিজস্ব উদ্যোগেই ফেব্রুয়ারি মাসে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়— বলতে গেলে এটাই বইমেলার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রথম সহযোগিতা। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৭৯ সাল থেকে ‘একুশের গ্রন্থমেলা’ নামে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনে বইমেলা হয়, যার মূল উদ্যোক্তা ছিলো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আর সহযোগিতায় বাংলা একাডেমি ও স্থানীয় প্রকাশকবৃন্দ। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে একাডেমি প্রাঙ্গনে শুরু হয় বইমেলা।
এরপর থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করাই হয়ে উঠে বাংলা একাডেমির একমাত্র কাজ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা, সে পথে তারা কতো দূর সফল, তা বিচারের যোগ্যতা আমার নেই। তবে বইমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমি যে দিনকে দিন অচল হয়ে যাচ্ছে— এটা বোঝার যোগ্যতা, বিবেচনাবোধ ও পরিস্থিতি সবই বর্তমান।
বাংলা একাডেমি মুখে বা বিবৃতিতে যাই বলুক না কেনো গণ-মানুষের কাছে বইমেলার অর্থ এবং বাংলা একাডেমির কাছে বইমেলার অর্ত যে সম্পূর্ণ আলাদা তা আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি। বইমেলা যেভাবে আমাদের কাছে একুশের চেতনার স্মারক, বাংলা একাডেমির কাছে তা নয়। একাডেমি কর্তৃপক্ষ বোধ করি একুশের চেতনা বলতে কেবল ভাষা আন্দোলনের কিছু আলোকচিত্রকেই বোঝে। তাই প্রতি বছরের বইমেলাতে আমরা কিছু দাতা গোষ্ঠীর নাম দেখতে পাই বইমেলার প্রবেশ পথের গেটে। বইমেলা বাংলা একাডেমির কাছে একটি বাৎসরিক বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এই বাণিজ্য ‘সুষ্ঠুভাবে’ বজায় রাখতে তারা সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়ে থাকেন। ফলে ফি বছর বইমেলা হয়ে উঠছে একটি নিষেধাজ্ঞার মেলা, অবশ্য এ বছর আগেভাগেই বাংলা একাডেমির মহা-পরিচালক তাঁর মহা মূল্যবান বক্তব্যে প্রকাশকদের নানাবিধ দিক-নির্দেশনা প্রদান করে রেখেছেন। একটি ডালভাত বইমেলা আয়োজনে প্রকাশকরা যেনো বাংলা একাডেমিকে বরাবরের মতোই সাহায্য করেন, সে ঘোষণা তিনি আগেই দিয়ে রেখেছেন।
গত কয়েক বছরে বইমেলা প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির স্বেচ্ছাচারিতা এবং মৌলবাদ তোষণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। নতুন নতুন বুলি আওড়ে তারা বইমেলাকে আরোও নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। অথচ এই বইমেলার সূচনালগ্নে বাংলা একাডেমির উল্লেখ করার মতো কোনো ভূমিকাই ছিলো না। এই চরিত্রহীন বাংলা একাডেমি এখন জামাত হেফাজতের ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। ২০০৪ সালের ২৭ জুলাই এই বইমেলার সামনেই মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হন প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। প্রতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রাঙ্গনে হুমায়ুন আজাদ স্মরণে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। সেখানে বাংলা একাডেমির লোকজনও উপস্থিত থাকেন অনেক সময়। মুখে যাই বলুক না কেনো গত বারো বছরের কোনো বইমেলায় বাংলা একাডেমি হুমায়ুন আজাদের স্মরণে কিছু করেনি। সন্তর্পনে সত্যকে এড়িয়ে তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে ‘গুড বয়’ হয়ে থাকতে চেয়েছেন। ২০১৫ সালে বইমেলা থেকে ফেরার সময় পুলিশের সামনেই নির্মমভাবে নিহত হন লেখক অভিজিৎ রায়। মৌলবাদী নরকের কীটরা গত বছর একে একে হত্যা করে মুক্তচিন্তার লেখক ও প্রকাশককে। মেধা ও সৃজনশীলতার ওপর এতো ন্যাক্কারজনক আক্রমণ এর আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই জাতি আশা করেছিলো এবারের বইমেলাতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই স্মরণ করা হবে নিহত লেখক আর মুক্তচিন্তকদের। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন বাংলা একাডেমির নগ্ন দৃশ্য জাতি প্রত্যক্ষ করলো এবারের বইমেলার শুরুর দিন থেকেই। মুখে একুশের চেতনার ফেনা তুলে মৌলবাদীদের কাছে একাডেমির এমন নির্লজ্জ আত্মসমর্পন জাতি হিশেবে আমাদের জন্য লজ্জার। বইমেলার ১৫তম দিনে জামাত-শিবির নিয়ন্ত্রিত একটি ফেসবুক পেইজের হুমকিতে বাংলা একাডেমি ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’- এর অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিলো। গত বছরও একই ধরনের ধুয়া তুলে তারা ‘রোদেলা’ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয়। একটি বইয়ে কী লেখা হবে সেটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে লেখকের ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর। লেখকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু তা কোনো প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দেবে না। কোনো লেখক যদি তাঁর গ্রন্থে কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য লিখে থাকেন, তার বিচার করবেন পাঠক। পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সেই লেখক কালের ধুলোয় মুছে যাবেন। বিশ্বের সব ভাষার সাহিত্যেই এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর কোনো বই নিয়ে কারও দ্বিমত থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে। একটি বইয়ের অযৌক্তিক বক্তব্যকে খণ্ডন করতে আরও দশটি বই লেখা যেতে পারে। চিন্তার বিরুদ্ধে চিন্তা আসতে পারে, দর্শনের বিরুদ্ধে দর্শন দাঁড়াতে পারে— এটাই বইমেলার সৌন্দর্য, এটাই জ্ঞান চর্চার পথকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার পাথেয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি এই যে স্টল বন্ধ করে দিচ্ছে, পুলিশ দিয়ে বই জব্দ করছে, প্রকাশকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে পাঠাচ্ছে— এটা জাতির চেতনার সঙ্গে প্রতারণা। কোন লেখক কী লিখবেন আর কোন প্রকাশক কী ছাপাবেন— তা ঠিক করে দেবার বাংলা একাডেমি কেউ না। সৃজন ধারার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সংযোগ খুব সামান্য। পৃথিবীর কোনো মহৎ সাহিত্য বা শিল্পই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে আসেনি, এসেছে সৃজনশীল মানুষের হাত ধরে। বইমেলা লেখক-প্রকাশক-পাঠক এই তিন শ্রেণির একটি সমন্বিত আকাঙ্ক্ষার ফল। বাংলা একাডেমি বইমেলা নিয়ে কোনো প্রত্যাশা করে বলে মনে হয় না, কারণ বইমেলার প্রসঙ্গে এটি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম মাত্র।
যে ফেসবুক পেইজের পোস্টের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমি পুলিশ লেলিয়ে ব-দ্বীপ প্রকাশনী বন্ধ করে দিলো, তাদের কার্যক্রম সম্বন্ধে সকলেই জানে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিষ ছড়ানো, প্রগতিশীল লেখক-ব্লগার-প্রকাশক হত্যা, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পোড়ানোসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সব ধরনের অপকর্মই এই পেইজ থেকে পরিচালিত হয়। বাংলা একাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত কোনো ফেসবুক পেইজের অঙ্গুলি হেলনে নির্ধারিত হয়, তখন বুঝতে হবে ভূত সর্ষের মধ্যেই আছে। অতএব, এই সর্ষে দিয়ে আর ভূত তাড়ানো সম্ভব নয়— এটা সর্ষেওয়ালারা না বুঝলে বাংলাদেশের মানুষকেই বুঝতে হবে। মগজে মৌলবাদকে লালন করে বাংলা একাডেমির হর্তাকর্তা হওয়া যায়, কিন্তু মহান একুশের চেতনার পথে বাংলা একাডেমিকে চালনা করা যায় না। বইমেলার আয়োজনে বর্তমান বাংলা একাডেমির নজিরবিহীন মৌলবাদ তোষণ দেখলেই এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
বাংলা একাডেমির অপোগণ্ড দাপ্তরিক চার দেয়াল ছেড়ে প্রাণের বইমেলা আমাদের প্রাণে ফিরে আসুক।