১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ যদি বাঙলার মানুষের আত্মার অহংকার হয়, তবে তার নথিভুক্ত বিবরণী হতে পারে বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি— বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। কেবল স্বাধীন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন এজন্যই নয়, এর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত দীর্ঘ নয়মাসের গণ-মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামের কালানুক্রমিক খতিয়ান।
১৯৭২ সালের ০৭ জানুয়ারি রাতে পাকিস্তানের ফরেন অফিস থেকে জরুরিভাবে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনের জন্যে ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। ০৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে তাঁদের লন্ডন পাঠানো হয়। ০৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডন পৌঁছে তাঁর হোটেলে সমবেত জনাকীর্ণ সাংবাদিকদের সামনে তিনি একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি সকালে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে এবং বিকেলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে ঢাকা পৌঁছে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একটি ভাষণ দিয়েছিলেন।
এই বিবৃতি ও ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে বাঙলাদেশের পাশে থাকা রাষ্ট্রগুলোর প্রতি জাতির জনকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে পাকিস্তানের কারাগারে থাকার সেই দুঃসহ দিনগুলোর যন্ত্রণা-ভাষ্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙলার মানুষ যে চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছে, তার কথাও তিনি বারবার স্মরণ করেন বক্তব্যে। রাজনীতিবিদ হিশেবে তাঁর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতারও একটি অনন্য প্রমাণ পাওয়া যায় বক্তব্যে। লন্ডন, দিল্লি এবং ঢাকা— তিন জায়গাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাঙলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে ভুট্টোর প্রস্তাবের প্রসঙ্গ এনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন—
আমার দেশবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোনো কিছু বলতে পারবো না।
অবশেষে তিনি দেশবাসীর সামনে বক্তব্য রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকেলে।
দুই
বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওইদিন একটি চলন্ত মাইক্রোবাসে বসে সেকালের একটি রেডিও-গ্রামোফোন-ক্যাসেট রেকর্ডারে (থ্রি ইন ওয়ান) এই অডিওটি রেকর্ড করেছিলেন জনাব সুমন মাহমুদ।
পাকিস্তানি হানাদারদের দখলমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার মাটিতে এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ। প্রতিবছর দশই জানুয়ারি সারাদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের নানা আয়োজনে সাতই মার্চের সেই অনন্য ভাষনটিই কেবল বাজানো হয়, কিন্তু তার সঙ্গে এই ভাষণটিও বাজানো উচিত, কেননা এর মধ্য দিয়ে বাহাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্র কাঠামোর স্পষ্ট দিক-নির্দেশনাটি পাওয়া যায়।
প্রায় ২০০০ শব্দের এই অলিখিত ভাষণটি বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে পাঁচটি পর্যায় আমরা পাই।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
- স্বজাতির আত্মমর্যাদাবোধের প্রতি শ্রদ্ধা
- আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহবান
- স্বাধীন বাঙলার মানুষের প্রতি নির্দেশ
- স্বাধীন বাঙলাদেশের রাষ্ট্র ও আইন কাঠামো প্রসঙ্গে দিক-নির্দেশনা
পুরো ভাষণটিকে এই পাঁচটি পর্যায়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তার জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। রাষ্ট্র যখন ভুল পথে হাঁটে তখন জনসাধারণ তার সঙ্গে থাকে না— এ কথা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে ভালো আর কে জানতেন!
এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুই কিন্তু স্পষ্ট করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট দলের যুদ্ধ নয় এবং এটি একটি জনযুদ্ধ। ভাষণটি তিনি শুরুই করেছেন বাঙলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাহি, পুলিশ তাঁদের সম্বোধনের মাধ্যমে। তিনি অভিবাদন জানিয়েছেন ‘মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা’, ‘ছাত্র সমাজ’, ‘শ্রমিক সমাজ’, ‘কৃষক সমাজ’ উল্লেখ করে এবং কর্মচারীদের প্রসঙ্গে তিনি অভিবাদন-পর্বে বলেছেন—
… পুলিশ, ইপিআর যাদের ওপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু নিজেকেও পুনর্সংজ্ঞায়িত করেছেন জাতির সামনে। গোটা ভাষণে তিনি কোথাও নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি করে কোনো কথা বলেননি; বরং বারবার বলেছেন—
নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়; আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই।
অর্থাৎ স্বাধীন বাঙলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে জাতির জনকের নির্দলীয় ভালোবাসার ইশতেহার স্বাক্ষরিত হলো।
পাকিস্তান কারাগারে কাটানো তাঁর দুঃসহ দিনগুলোর কিছু স্মৃতিচারণ তিনি করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি যে তাঁর জাতির আত্মমর্যাদাবোধের প্রশ্নে আপোষহীন, সে কথাও দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করেছেন—
মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না।
স্বজাতির প্রতি তাঁর যে অনন্য মমত্ববোধ তার স্ফূরণ ঘটেছে, যখন তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন—
.. ..মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও।
ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি পর পর উচ্চারণ করে গেছেন— ‘জয় বাঙলা’, ‘স্বাধীন বাঙলা’, ‘বাঙালি আমার জাতি’, ‘বাঙলা আমার ভাষা’, ‘বাঙলার মাটি আমার স্থান’।
এই উচ্চারণ বাঙালি জাতির চৈতন্যের আদর্শলিপি।
বঙ্গবন্ধু যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্যে, তেমনি আহবান জানিয়েছে যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশের পুনর্গঠনে সহযোগিতার জন্য। ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেবার জন্যে এবং স্মরণ করেছেন সেখানে মৃত্যুবরণ করা বাঙলার মানুষকে। একই সঙ্গে তিনি জনসাধারণকে পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছেন যে,
.. .. শতকরা ৬০টা রাষ্ট্র আছে, যার জনসংখ্যা এক কোটির কম।
সুতরাং এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেবার মতো উদারতা যে রাষ্ট্র দেখিয়েছে, তার প্রতি তিনি বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দক্ষতায় বঙ্গবন্ধু যেহেতু প্রবাদপ্রতিম, তাই তিনি তাঁর জনসাধারণকে এটিও জানিয়ে দিয়েছেন যে,
.. .. যেদিন আমি বলবো, সেইদিন, ভারতের সৈন্য বাঙলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে।
যেখানে স্বজন হারানো দিকভ্রান্ত মানুষ, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ষড়যন্ত্রে তখনও তত্পর, ভুট্টো তখনও অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর, স্বাধীন বাঙলাদেশ হিশেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রয়োজন— এমন একটি পরিস্থিতিতে এটি কতো গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগি একটি রাজনৈতিক ভাষ্য— তা আজকের দিনে বসে হয়তো চিন্তা করা যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিষয়েও তিনি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাতিসংঘের সদস্যপদের বিষয়েও কথা বলেন এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলেন— “দিতে হবে”।
এই ভাষণে স্বাধীন বাঙলার মানুষের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তার আগে তিনি উপস্থিত জনতাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন সাতই মার্চের ভাষণের কথা। অর্জিত স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন—
এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাঙলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়.. .. যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকুরি না পায়, কাজ না পায়.. ..
এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে চুরি-ডাকাতি, লুটপাট বন্ধে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন। পাকিস্তান আমলে ঘুষখোরদের যে রমরমা ছিলো, তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন—
.. ..তখন সুযোগ ছিলো না, আমি ঘুষ ক্ষমা করবো না
যুদ্ধফেরত গেরিলাদের হাতে তখন অস্ত্র, তাই তিনি সবাইকে শান্তি বজায় রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। বাঙলার মানুষকে তার কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন—
যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও.. .. জমিতে যাও, ধান বুনাও।
তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন—
সাবধান বাঙালিরা। ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।
এ ভাষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাধীন বাঙলাদেশের রাষ্ট্র ও আইন কাঠামো প্রসঙ্গে দিক-নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলেছেন—
বাঙলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাঙলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাঙলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়েও তিনি বলেছেন—
একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে, আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে।
শান্তিপূর্ণ ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল জাতি হিশেবে বিশ্বের কাছে বাঙলার মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রত্যয়ও তিনি ব্যক্ত করেন। ভাষণের শেষের দিকে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বপ্ন-সাধনার এক অপূর্ব মণিকাঞ্চণ লক্ষ্য করি আমরা। তিনি বলছেন—
.. .. বাঙলার মানুষ হাসবে। বাঙলার মানুষ খেলবে।.. ..মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। পেট ভরে ভাত খাবে। এই আমার জীবনের সাধনা। এই আমার জীবনের কাম্য।
এরপর শেষ হয় স্বাধীন বাঙলাদেশে জাতির পিতার প্রথম ভাষণ। তিনি ভাষণ শেষ করেন সে অবিনাশী উচ্চারণে— “জয় বাঙলা”।
তাঁর কণ্ঠে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অপরাজেয় মানুষ।
তিন
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে ব্যক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রতিশ্রুতি, তা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বাস্তবায়ন করে চলেছে। তাঁরই কন্যা বর্তমানে বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বাঙলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা আমাদের জাতিগত ইতিহাসের গতিপথ কী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে নির্দেশিত পথে হাঁটছে?
যে ষড়যন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধু বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সে ষড়যন্ত্রের শিকার আজ আওয়ামী লীগ নিজেই। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে কোথাও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নেই। ‘সমাজতন্ত্রের’ মতো এটিও নির্বাসিত হয়েছে সামরিকতন্ত্র আর মোল্লাতন্ত্রের করালগ্রাসে। মৌলবাদীরা আজ আওয়ামী লীগের ছাতার নিচে থেকে অপকর্ম করে যাচ্ছে, তার দায় বর্তাচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর। রাজনৈতিক আদর্শ যখন গঠনতন্ত্রের কয়েকটি বাক্য মাত্র হয়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা বিরাজ করছে।
সুতরাং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেবল উদযাপন আর সেমিনারে বন্দী রাখলেই চলবে না। এর যে অনবদ্য সাহসিকতার চেতনা, রেসকোর্সের সেই ভাষণের মাঝে যে চিরন্তন দিক-নির্দেশনা জাতির জনক দিয়েছেন, তার পুনর্পাঠ আবশ্যক।
এ সত্য যতোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উপলব্ধিতে না আসবে, ততোক্ষণ সকল উদযাপন আর গলা ফাটানো— কেবলই ভুয়া, কেবলই ফক্কিকার।