এমন একটি লেখা লেখার ইচ্ছে আমার ছিলো না। নিঃসঙ্গ বাতায়নের সাথে গুবাক তরুর সারির কথোপকথন আর কখনো হবে না। এ-ও এক ট্র্যাজিডি- গ্রীক ট্র্যাজিডির সাথে সামঞ্জস্য; কেবল ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়- কিংবা এরও বাইরের কিছু।
আমি জানি না, ক্যামেরার কোন অ্যাঙ্গেলে কথা বলতে ভালোবাসতেন আশফাক মুনীর মিশুক। জানি না সেলুলয়েডের সাথে কেমন প্রেম ছিলো তারেক মাসুদের। জীবনের ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মিশুক মুনীর কী কোনোদিন অ্যাপারচারের হিসেব নিয়েছিলেন? তারেক মাসুদ কী কখনো ভেবেছিলেন- মাটির ময়নার রানওয়েতে পড়ে থাকে বিধ্বস্ত শব। জানা হয়নি- কেবলই জানি, আজকের পর থেকে তাঁরা দুজনেই দু’টি অনন্য পোট্রেট- বিষণ্ন নীলিমার ধারে যে পোট্রেটের ফ্রেমে নিবেদিত হয় প্রণতির পঙক্তিমালা।
তাঁরা নেই, একই ঘটনায় নেই আরও অনেকেই। আসবেন না আর ফিরে। আলোর সরণি ধরে পথ হাঁটতে হাঁটতে কী পথ হারিয়ে ফেললেন আশফাক মুনীর মিশুক? তারেক মাসুদ কী শর্ট ফিল্মের ইন্দ্রজালে হারিয়ে গেলেন?
কিন্তু কোথায় গেলেন?
কোনো উত্তর নেই- শ্রান্ত গাঙচিলের মতো প্রশ্নগুলো মুখ চেয়ে থাকে। বিষণ্ন, বড্ডো বেশি মলিন। কখনো শোকাহত। এবং প্রতিবাদী।
আমাদের দেশটা বামনের দেশ, এখানে মহাকায়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়। পলিমাটির ক্ষুদ্র ব-দ্বীপে গর্বিত হবার মতো মানুষ খুব বেশি নেই। এখানে স্বপ্ন মানেই উঁচু তলার এপার্টমেন্টের ছাদ আর মিহিন শাড়ির কোলবালিশ।
কিন্তু এর মাঝেও আকাশটা আমাদের ছিলো। কখনো কখনো সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা আলোর পাণিপ্রার্থী হতাম। সেই আলোর নানা নামের মাঝে দুইটি নাম ছিলো তারেক মাসুদ ও আশফাক মুনীর মিশুক। তাঁদের মহান কর্মযজ্ঞের বেদীতে কী আছে নিবেদন করার, এক হৃদয়জ শ্রদ্ধার্ঘ ছাড়া?
সেটুকুই নিবেদন করলাম। প্রিয় কাঁঠালচাঁপার গন্ধে আর প্রণয়িনী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের অনুপ্রেরণায় আমি তাই নিবেদন করলাম এক বিষন্ন প্রণতি। বিষন্ন কেনো? আমার আকাশ জুড়ে মেঘ। ‘কাগজের ফুল’ এ সে মেঘের ছবি আঁকা যায় না।
‘ক্যামেরা ডিরেক্টর’ হিসেবে কাজ করে যে বাঙালিরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আশফাক মুনীর মিশুক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসির ভিডিওগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সবার কাছে মিশুক মুনীর নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। ‘মিশুক মুনীর’- কী আশ্চর্য ব্যাতিচার এই নামের মধ্যে। কিন্তু মানুষটা ব্যাতিচারিক ছিলেন না নিশ্চয়ই। তাঁর ক্যামেরার কাজ দেখে মনে হতো- তিনি আলোকে ভালোবেসেছিলেন। মায়া-পার্বণে তাই আলোর সাথে মিশে গেছেন মিশুক; তিনি চলে গেছেন- এ আমি মিথ্যে বলেছিলাম। তিনি আছেন, আলোর বারান্দায় স্মৃতির ডেপথ অব ফিল্ডে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়।
বাঙলাদেশের প্রথম ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশন একুশে টিভিতে হেড অব নিউজ অপারেশনস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মিশুক মুনীর। দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। বাবার সাথে এইখানে বুঝি তাঁর সন্ধি ছিলো? আদরের সুতোয় তাই বাবার মতোই তিনি দিতে চেয়েছিলেন আদর্শ- কোনো পুস্তক থেকে নয়; জীবন থেকে, জীবনের আয়না থেকে। সান্ধ্যভাষার আলোকচিত্রে তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন- জীবন মানেই ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের ল্যা–স্কেপ। কী জানি, তাই বুঝি ক্যাম্পাসে আসলেই অপরাজেয় বাঙলার দিকে তাকিয়ে থাকতেন সূর্যাস্তের চোখে। কলাভবন তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে নয়, জীবনের ফোরগ্রাউন্ড নেমে আসতো।
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত The Real News Network এর ছিলেন Director of News Operations। চলচ্চিত্রের মাঝে আলোকচিত্র এবং ভিডিওগ্রাফির যে অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে হয়- তা করে দেখিয়েছিলেন এই মানুষটি। সর্বশেষ গত বছর তিনি এটিএন নিউজে প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দেন। বাঙলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের ছবি রানওয়ের প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন মিশুক। এছাড়াও রিটার্ন টু কান্দাহার, ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম প্রামাণ্যচিত্রগুলোতেও কাজ করেছেন তিনি।
মিশুক মুনীরের অনেক বড়ো একটি অংশগ্রহণ ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনে। তিনি এ বিষয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদনও প্রচার করেছিলেন সম্প্রচার মাধ্যমে। কিন্তু আজ আর এই মিছিলে তিনি থাকবেন না। কেবল মিশুক মুনীর নামের এক অখণ্ড অনুপ্রেরণা উজ্বল হয়ে থাকবে আমাদের সে-ই প্রত্যয়ী মিছিলে।
তারেক মাসুদ
তারেক মাসুদকে চিনতে হলে মুক্তির গান দেখতে হবে। বোদ্ধার চোখে নয়, একেবারে সাধারণ চোখে- যে সাধারণত্ব অনাবিল চেতনায় ধরা পড়েছিলো একাত্তরের রণাঙ্গণে। বীর মুক্তিযোদ্ধা- এক দুর্জেয় প্রত্যয় আর তারই সাথে মাটির টানের মমত্ব। সে-ই সাধারণ চোখে তারেক মাসুদ হয়ে উঠবেন একটি ক্যানভাস- যার আদি-মধ্য-অন্ত জুড়ে কেবল ভালোবাসার রঙ।
ভালোবাসার রঙ কথাটি লিখতেই হৃদয় কথা বললো- ভালোবাসা শাশ্বত, ভালোবাসার মৃত্যু নেই।
তারেক মাসুদ তার বাল্যকালের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি সাধারণ শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেন এবং এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাঙলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালের শেষ দিকে তিনি জীবনের প্রথম ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই ডকুমেন্টারিটি ছিলো প্রখ্যাত বাঙালি শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর।
এরপর থেকে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, এনিমেশন এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশে-বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। বাঙলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অরডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি করতেন।
তারেক মাসুদ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে অনিবার্যভাবে একটি কথা মনে আসছে। একবার লেয়ার লেভিনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম আমি। সেখানে তিনি তারেক মাসুদ সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন মুক্তির গান নিয়ে কথা। সেই সাক্ষাৎকার থেকে লেয়ার লেভিনের বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি।
সত্যি বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে ঘুরে আমি ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলাম, বিভিন্ন বিপদ সামনে এসেছে, সমস্যা হয়েছে, আমি পিছপা হয়নি। তাছাড়া গণহত্যা আর নারী নির্যাতনে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি জাতি ‘বিপ্লবের কোন সুরে’ হঠাৎ জেগে উঠলো, আমার পুরো ফুটেজগুলোতে আমি সেই ‘সুর’কে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবে দুঃখের বিষয় হলো বাঙলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার কয়েকদিন আগে গুপ্তচর সন্দেহে ভারতীয় বাহিনী আমাকে আটক করে, এবং আমি বাঙলাদেশ ত্যাগ করতে আমি বাধ্য হই। পরে অবশ্য আমার ফুটেজগুলো পরীক্ষা করার পর তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। তবে সত্যি বলতে এ ফুটেজগুলো নিয়ে আমি আসলে কিছুই করতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে আমার সঙ্গীর কথাটি স্মরণ করতে হয়, কেননা আমরা যখন বাঙলাদেশে আসার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন তিনিই প্রথম আর্থিক বিষয়টি সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি কানে তুলিনি। কিন্তু পরবর্তীতে তার কথাই সত্য হলো। দীর্ঘ ২০ বছর ফুটেজগুলো পড়েছিলো, আমি কিছুই করতে পারিনি। এছাড়াও মার্কিন দর্শকদের কাছে এ ফুটেজগুলো বিশেষ আবেদন রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে আমি আসলে কিছুই করতে পারিনি।
তবে তারেক সেটা করে দেখিয়েছে। আমার পরিচয় মূলত ছিলো তারেকের বড়ো ভাই বেনুর সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তার মাধ্যমেই জানতে পারলাম তারেকের কথা। কবে তা বিশেষ কিছু ছিলো না। এক শনিবারের কথা আমার খুব মনে পড়ে। সেদিন ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। হঠাৎ একটি ফোন এলো এবং ও প্রান্ত থেকে পরিচয় আসলো ‘তারেক মাসুদ বলছি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বাঙলাদেশ থেকে, ৭১ সালে আপনার ধারণকৃত ফুটেজগুলো দিয়ে আমি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই’। আমি ১৯ বছর যাবত যে বক্তব্যটির জন্য স্বপ্ন দেখছিলাম, সেদিন সেটা হয়ে গেলো- আমি তাকে দেখা করতে বললাম।
তারেকের কাজ ‘মুক্তির গান’ অসাধারণ। আমার ধারণকৃত ফুটেজগুলো এ ধরণের উপস্থাপনার মাধ্যমে সত্যিই অসাধারণ হয়ে উঠেছে। একজন চিত্রগ্রাহক যখন তার ছবির এতো সমন্বিত রূপ দেখতে পায়, তখন তার ভালোলাগার কোনো সীমানা থাকে না।
এখানে শব্দগুলো অন্ধকার, চিত্রগুলো নির্বাক
লেখার শুরুতে বলেছিলাম- এ হলো গ্রীক ট্র্যাজিডি, ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণে পরাহতের মানচিত্র। কিন্তু এবার ভেতরটা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। এর সাথে ভাগ্যের যোগ নেই। যোগ আছে অব্যবস্থাপনার, এর সাথে যোগ আছে অসচেতনতার। সারা বাঙলাদেশের দিকে তাকালে এই কথাটি যেনো বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠে। মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ চলে গেলেন- নির্মম সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে তাঁরা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। খবরে দেখলাম সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শোক জানানো হলো। এরই নাম বুঝি শুভঙ্করের ফাঁকি! এ শোকের মূল্য কি? এ শোক কী পারবে, যে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিলো, তাকে ফিরিয়ে দিতে? আমাদের ভবিষ্যত কী তবে নেমেসিসের হাতের মুঠোয়?
বধির হয়ে কেবলই ঘুমাই, চেতনার দরজায় কড়া নাড়ে বিবর্ণ ফুটেজ। জেগে উঠি। ট্রাইপডের উচ্চতা বাড়িয়ে চেষ্টা করি আকাশ দেখার।
আকাশ তখন রোদন করে- ‘তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর আর নাই’।