এমনটাই যেনো হবার কথা ছিলো!
হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ আর্জেন্টিনা থেকে আসবেন মেসি। বাঙালি তাঁকে বরণ করে নেবে তার হাজার বছরের ঐতিহ্যগত আতিথেয়তায়। মেসি তাঁর অনবদ্য জাদুতে মুগ্ধ করবেন বাঙালিকে, সেইসাথে মুগ্ধ হবেন বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা আর মেসির জন্যে তুলে রাখা ভালোবাসার আবির মেখে। মেসি কিংবা আজকের আর্জেন্টিনা বাঙালির এই অসামান্য আয়োজনে যারপরনাই মোহিত। এই তথ্য আর্জেন্টিনার গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। এই সফরকে তারা কেবল ‘ঐতিহাসিক’ বলেই উল্লেখ করেননি, আর্জেন্টাইন ফুটবল ইতিহাসের একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে
৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১। রবিবার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবিবার ছোটোগল্পের মতোই ছিলো দিনটি। সূর্যোদয় সেদিন দুবার হয়েছিলো। একবার প্রাকৃতিক নিয়মে, অন্যবার সকাল ১১ টায়। বাঙলাদেশে এর আগে ফুটবলের এতো বড়ো কিংবদন্তী আর আসেননি। তিনি লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, ২৪ বছর বয়স্ক এক তরুণ ফুটবলার। কিন্তু এ তো কেবল এক বর্ণনা! বাস্তবে মেসি বর্ণনার চেয়েও বেশি কিছু, রূপকল্পের চেয়েও গভীরতর।
আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি বাঙালির হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তী, ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সে ঘটনা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। এখনও তিনি কোটি বাঙালির কাছে ফুটবলের আকাশ। মেসি সে-ই আকাশেই এলো নতুন চাঁদ হয়ে, একেবারে স্বগেদ্ভাসিত স্নিগ্ধতা নিয়ে।
বিশ্বকাপ ফুটবলে বাঙলাদেশ খেলার সুযোগ পায়নি, তবুও ফুটবলের উন্মাদনা থেমে থাকে না কখনও। প্রতি বিশ্বকাপেই আমাদের হাসি-কান্নার এপিক হয়ে থাকে ফুটবলের বিস্ময় দল আর্জেন্টিনা। সেই আর্জেন্টিনা ঢাকার মাটিতে পা রাখলো, আর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই সবার হৃদয় ভাসিয়ে নিয়ে চলেন নিজের সঙ্গে।
মেসির ঢাকায় এই আগমনটি একেবারে মধ্য-গগনের সূর্য হয়ে আসার মতোই। এর আগেও বিশ্বসেরা কয়েকজন ক্রীড়াবিদ এসেছেন বাঙলাদেশে। কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এবং আরেক ফুটবল জাদুকর জিদান। কিন্তু তাঁরা দুজনই এসেছেন সায়াহ্নবেলার গান গাইতে, বেটোফেনের সুর হয়ে আর মেসি এলেন উন্মাদনায়, এরিক ক্লেপটনের গিটারের মাতাল ছন্দে। তাই সারা দেশের মানুষের আগ্রহ একেবারে স্থির হয়েছিলো মেসির দিকে, চুম্বকের মতো- যেনো এতোটুকু সরবার নয়।
তাই গণউন্মাদনা আর তীব্র আকর্ষণে প্রাণের মানুষটিকে হৃদয়-কাব্যে জড়িয়ে ধরলো এ মহানগর। বাসের ধারে জানালার পর্দাটা একটু ফাঁকা করে মেসিও দেখে নিচ্ছিলেন তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকা বাঙলাদেশকে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার মুখে রাস্তার ধারে হাজার হাজার ছেলে-বুড়োকে আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝে নিলেন ভূ-মানচিত্রে এ দেশটির অবস্থান বিন্দুবৎ হলেও এ খেলাটি ঘিরে বাঙালির আবেগ আকাশছোঁয়া। প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নেওয়া রাজকুমারের কাছে ঢাকার প্রত্যাশা ছিলো ফুটবল জাদু। ন্যু ক্যাম্পের সাত রাজার ধনের কাছে একটি গোল দেখতে উন্মুখ হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সত্যি কথা বলতে দিনটা এতো বেশি মেসিময় ছিলো যে, সকালে ভিড়েভরা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দুপুর সাড়ে ৩টায় ফাঁকা হতেই সেখান দিয়ে নীরবে শহরে আস্তানা গাড়ে নাইজেরিয়া ফুটবল দল। লা আলভিসিলেস্তের সঙ্গে সুপার ঈগলদের উপস্থিতিতে ঢাকা হয়ে উঠেছিলো রীতিমতো ফুটবল নগরী। শুধুই কি মেসি!- তাঁর রাজসিক বহরে হিগুয়াইন, আগুয়েরো, ডি মারিয়ার মতো বিশ্বকাঁপানো নামগুলোও ছিলেন ঢাকার বাসিন্দা।
বিমানবন্দর থেকে বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট দেখতে দেখতে মেসিরা যখন হোটেলে ফিরছিলেন- ফাঁকা রোড দিয়ে মেসিদের বাসকে তখন প্রাণপণ অনুসরণ করেছে মিডিয়া। পেশাদারিত্বের বাইরে বেরিয়ে আলোকচিত্র সাংবাদিক, প্রতিবেদক সকলেই ‘মেসি মেসি’ বলে গলা ফাটিয়েছেন। আর বাসের ভেতর সাদা টি-শার্ট পরা তরুণ প্রবল ঔৎসুক্যে সিট থেকে হাত নাড়ছিলেন। এ যেনো আপ্লুত হয়ে জানিয়ে যাওয়া- ‘আমি তোমাদেরই লোক’।
মেসির অরুণ আলোর অঞ্জলি
লিওনেল মেসির জন্ম ২৪ জুন, ১৯৮৭। বয়সের হিসেব দিয়ে অর্জনের লেখচিত্র আঁকতে গেলে হোঁচট খেতেই হবে। আর্জেন্টিনার এই জীবিত কিংবদন্তী বর্তমানে স্পেনের বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবে খেলছেন। বর্তমান প্রজন্মের এই অসামান্য প্রতিভাবান ফুটবলার কিন্তু ২১ বছর বয়স হবার আগেই কয়েকবার ব্যালন ডি ʼঅর এবং ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়্যার অফ দ্য ইয়ার হিসেবে মনোনয়ন লাভ করেন এবং ২২ বছর বয়সে দুটি পুরষ্কারেই ভূষিত হন। আর ম্যারাডোনা তো বলেই দিয়েছেন- মেসি তাঁর উত্তরসুরী।
লিওনেল মেসি অতি অল্প বয়সেই তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব দ্রুতই তাঁর সম্ভাবনা বুঝতে পারে। তিনি ২০০০ সালে রোসারিও কেন্দ্রিক নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ দল ছেড়ে তার পরিবারসহ ইউরোপে পাড়ি জমান। এর মূল কারণ ছিলো বার্সেলোনা তার বর্ধন হরমোন স্বল্পতার চিকিৎসার প্রস্তাব দিয়েছিলো। ২০০৪-০৫ মৌসুমে খেলতে নেমে তিনি লা লিগার ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে কোনো ম্যাচে খেলা ও গোল করার রেকর্ড স্থাপন করেন। তাঁর অভিষেকের বছরেই বার্সেলোনা স্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে – লিগ এবং ২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের গৌরবজনক ডাবল অর্জন করে। তার সাফল্যের সূচনাকারী মৌসুম ছিলো ২০০৬-০৭ মৌসুমে, যখন তিনি বার্সেলোনার প্রথম একাদশে দলের নিয়মিত সদস্যে পরিণত হন। একই সাথে এল ক্লাসিকোতে হ্যাট্রিক করেন এবং ২৬টি ম্যাচে ১৪টি গোল করেন। সম্ভবত এখন পর্যন্ত তাঁর সফলতম মৌসুম কেটেছে ২০০৮-০৯ এ, যেখানে তিনি ৩৮টি গোল করেন এবং দলের ট্রেবল জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মেসি ২০০৫ ফিফা যুব চ্যাম্পিয়ানশিপে ছয়টি গোল করেন, যার মধ্যে দুটি ছিলো ফাইনালে। এর স্বল্পসময় পরেই তিনি আর্জেন্টিনার মূল আন্তর্জাতিক দলে সুযোগ পান। ২০০৬ সালে তিনি কনিষ্ঠতম আর্জেন্টাইন হিসাবে ফিফা বিশ্বকাপে খেলেন এবং পরের বছর কোপা আমেরিকায় রানার্স-আপ মেডেল জয় করেন। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে আর্জেন্টিনা দলের সাথে স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়ে তিনি তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেন।
তবে এই পরিসংখ্যানেই মেসিকে ফ্রেমবন্দী করা যায় না। এদেশের লক্ষ কোটি দর্শক রাতের পর রাত জেগে থেকেছেন কেবল বাঁ পায়ের জাদুকরী কিছু মুহূর্ত দেখতে, ঢুলুঢুলু চোখে তারা দেখেছেন- মাঠের ডানকোণা থেকে অদৃশ্য এক চুম্বক সাথে নিয়ে বল পায়ে এঁকেবেঁকে দৌড়, অবিশ্বাস্য বডি-ডজে মার্কারকে ছিটকে ফেলা, আলতো পরশে বল নিয়ে ভিন-গ্রহের ক্লোজ কন্ট্রোলে অল্প অল্প করে এগিয়ে যাওয়া, বুলেটের মতো শটে হাওয়ায় ভাসিয়ে বা আচমকা মৃত্তিকাপ্রেমী শটে অদ্ভূদ ফিনিশিং, গোলকিপারের সাথে হাত মেলানো দূরত্বে থেকে কীভাবে যেনো চিপ করে বল জালে জড়িয়ে দেয়া.. .. এ যেনো অন্য কিছু, যে দেখে, সে-ই জানে।
আমাদের ফুটবলের এক প্রাণময় সন্ধ্যা
খেলার শুরুর আগেই আর্জেন্টিনার কোচ আলেহান্দ্রো সাফ বলেছিলেন, মেসির আজ মুড ভালো। তার মানে, আজ বেশ সুখের দিন। কোচের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিই ছিলো। মেসি খেললেন পুরো সময়টাই এক্বেবারে মেসির মতোই। তিনটে গোল দিয়েছে আর্জেন্টিনা। তার মধ্যে মেসি নিজেই দুটো গোল দিয়েছেন, এটা বলাই যায়।
ফলাফল ৩-১। তার মধ্যে ইগুয়াইনের পা থেকেই দুটো। আরেকটা ডি মারিয়ার অবদান। বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পুরো খেলায় প্রায় ভালো করে নীল সাদা জার্সিকে প্রতিরোধ করতে না পারলেও নাইজিরিয়া দলের বদলি খেলোয়াড় শিনেদু ওবাচি একটি গোল শোধ করে যান ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে।
পুরো খেলাটার বিচারে একটা কথা বলতেই হবে, সেদিন অবশ্যই ফেভারিটদের মতোই খেলেছে আর্জেন্টিনা। পুরো সময়টাই তাদের দাপট ছিলো মাঠে। মেসির খেলা দেখে অনেকেরই মত, তিনি যেমন বার্সার হয়ে খেলেন, তেমনটাই খেলেছেন মঙ্গলবার ঢাকায়। তাঁর মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্য, আর বল তাড়া করার সর্বক্ষণের চেষ্টা ছিলো, তা দর্শকদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। খেলা শুরু হয়েছিলো একঘন্টা দেরিতে। দেরির কারণটা আগাম ঘোষণা করে রেখেছিলেন উদ্যোক্তারা। লম্বা সফরের পর ক্লান্ত নাইজিরিয়া দলের তেমনটাই অনুরোধ ছিলো। আর্জেন্টিনাও দিনের আলো থাকতে থাকতে মাঠে নামতে চায়নি।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে যখন তাঁরা মাঠে নামলো- তখন উল্লাসে ফেটে পড়লো চারদিক। খেলার ২৪ মিনিটে ডি মারিয়া বল দেন লিওনেল মেসিকে। তিনি হাল্কা করে বল ভাসিয়ে দেন প্রতিপক্ষের বক্সে দাঁড়ানো হিগুয়েনকে। বুক দিয়ে বলটি নামিয়ে ডান পায়ে শট নেন তিনি। বল আশ্রয় নেয় জালে। ঠিক দুই মিনিট পর মেসি নাইজেরিয়ার রক্ষণভাগের চারজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন। গোলরক্ষক আইয়েনুগবা শুয়ে পড়ে তা ঠেকিয়ে দেন। কিন্তু বল পেয়ে যান চৌকষ ডি মারিয়া। খালি গোলপোস্টে বল ঠেলে দুই গোলে এগিয়ে নেন তিনি দলকে। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে (৪৫+) বেঁচে যায় নাইজেরিয়া। প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে থেকে শট নেন মেসি। কর্নারের বিনিময়ে দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন গোলরক্ষক।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হতে না হতেই নাইজেরিয়ার এক খেলোয়াড় আড়াআড়িভাবে বল ফেলেন আর্জেন্টিনার বক্সের মাঝামাঝি জায়গায়। ওবাচি কেবল বলের গতি পথ পাল্টে দেন গোলপোস্টের দিকে। গোলরক্ষক রোমেরোর হাতে লেগে বল আশ্রয় নেয় জালের উপরের দিকে। খেলার ৬৫ মিনিটে ডি মারিয়া বল ঠেলে দেন বক্সের ভেতর দাঁড়ানো হিগুয়েনকে। বল ধরেই শট নেন তিনি। কিন্তু গোলরক্ষকের হাতে লেগে বল ফিরে আসলেও নাইজেরিয়ার অন্য এক খেলোয়াড় উওয়া ইচেইজিলের পায়ে বল লেগে তা গোল-লাইন অতিক্রম করে যায়। ৭৭ মিনিটে হিগুয়েনকে মাঠ থেকে তুলে নেন কোচ আলেহান্দ্রো সাবেইয়া। তার বদলে খেলতে নামেন অনেকের মতে আর্জেন্টিনার ফুটবল ইশ্বর হিসেবে পরিচিত দিয়েগো মারাদোনার জামাতা সার্জিও অ্যাগুয়েরো।
তবে স্টেডিয়ামে মানুষের ঢল দেখে বিদেশি খেলোয়াড়রা সকলেই আপ্লুত। ফুটবলকে উপমহাদেশ যে কতোটা ভালোবাসে, তার প্রমাণ তাঁরা স্বচক্ষে দেখে গেলেন। ফুটবলের উন্নতিতে আগামীতে এই খেলার উদাহরণ নিশ্চয়ই কাজে লাগবে।
বিদায় নিলো মেসি হৃদয়রাঙা সুরে
খেলা শেষ। মেসিরা ফিরে গেছেন তাঁদের জন্যে নির্ধারিত হোটেলে। এরপর নৈশ্যভোজ। বাঙলাদেশ তখন প্রশান্তির ঘুমে, বুকে নিয়ে মেসির পায়ের জাদুর সেলুলয়েড। রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তাঘাটেও সুনসান নীরবতা। ঘুম নেই শুধু রূপসী বাংলা হোটেলের লবিতে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের। নির্ঘুম রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন জনা বিশেক অটোগ্রাফশিকারী। তাঁদের হতাশ করে ৬ সেপ্টেম্বর রাত তিনটায় লবি দিয়ে হেঁটে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাসে উঠলেন আর্জেন্টিনার এই কিংবদন্তীর জাদুকর। দূর থেকে ছবি তোলার ইচ্ছা পূর্ণ হলেও অটোগ্রাফ নেওয়ার ইচ্ছা অপূর্ণই থাকলো সাধের ঘুম বিসর্জন দিয়ে মাঝরাত্তিরে হোটেলের সামনে অপেক্ষমাণ ভক্তদের। তারপর বিদায়ের পালা। ভোররাতে সবার আগে হোটেল ছেড়েছে কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলা, অধিনায়ক মেসিসহ ২৭ জনের একটি দল। কারণ পরের রোববারেই রিয়াল সোসিয়েদাদের সঙ্গে বার্সেলোনার লা লিগার ম্যাচ। বার্সার মেসি-মাচেরানোরা তাই সরাসরি স্পেনেই যাচ্ছেন। রিয়ালের গঞ্জালো হিগুয়েইন আর অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াও তা-ই। স্প্যানিশ লিগেই খেলা মার্টিন ডেমিকেলিস, এভার বানেগা ও এদুয়ার্দো সালভিওরাও সঙ্গী হয়েছেন তাঁদের। তাই খেলার দিনের ভোররাত চারটা ৫ মিনিটে কাতার এয়ারওয়েজে ঢাকা ছাড়তে হলো তাঁদের। অবশ্য আর্জেন্টিনা দলের বাকি সদস্যরা ঢাকা ছেড়েছেন পরদিন সকাল আটটায়।
আর্জেন্টিনার মতো নাইজেরিয়াও ঢাকা ছেড়েছিলো কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে। ছয় সদস্যের একটি দল বিমানে উঠেছে ৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টায়। এই দলে আছেন চেলসির মিডফিল্ডার জন ওবি মিকেল। দুবাই হয়ে তিনি ফিরে গেছেন ইংল্যান্ডে নিজের ক্লাবে। বাকিরা দুই ভাগ হয়ে এমিরেটস এয়ারলাইনসে নাইজেরিয়া ফিরেছেন আরেক এক দল সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে ও অন্যটি রাত নয়টা ৩০ মিনিটে। আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া প্রীতি ম্যাচের জন্য ইরান থেকে আসা রেফারিও ৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার ফ্লাইটে ফিরেছেন।
অতিথিদের আগমনের সময় যেমন, তেমনি চলে যাওয়ার সময়ও নাইজেরিয়াকে নিয়ে নয়, সব আগ্রহ ছিলো আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই। আরও স্পষ্ট করে বললে, আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন মেসি।
যদিও শুরু থেকেই ভক্তদের সতর্ক করে যাচ্ছিলেন নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা, কিন্তু আবেগ কি আর এসব বিধিনিষেধ মানে! পাবলো জাবালেতা ও হাভিয়ের মাচেরানোর পর বের হলেন মেসি। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ‘মেসি’ ‘মেসি’ বলে চিৎকার। মেসি শুধু একবার তাকিয়েই উঠে গেলেন বাসে। আসার দিন বাসের যেখানে বসেছিলেন (পেছনের দিকে বাঁ সারিতে), ফিরে যাবার রাতেও জানালার পাশে ঠিক সেখানেই গিয়ে বসলেন। টিভি ক্যামেরা আর ফটোসাংবাদিকদের যেনো আঁশ মিটছিলো না ছবি তুলে। মেসির স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রতিযোগিতায় নামলেন র্যাব আর পুলিশের সদস্যরাও। মুঠোফোনে তুলতে লাগলেন ছবি। মেসি একবার বিদায়ী ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন, আরেকবার ‘থাম্ব সাইন’ জানাতে উঁচিয়ে ধরলেন বুড়ো আঙুল। হয়তো বুঝতে পারছিলেন, আপাতত শেষবারের মতো তাঁকে দেখার স্মৃতিটা ধরে রাখতে ব্যাকুল সবাই। এ জন্যই বাসের জানালার পর্দা নিজে থেকেই সরিয়ে দিলেন ভালোমতো। গত কদিনের ভ্রমণ আর খেলার ক্লান্তি খুব একটা দেখা যাচ্ছিলো না তাঁর চোখেমুখে। তাঁকে ঘিরে এই উন্মাদনাটা মনে হলো উপভোগই করছেন।
ভোরে রাস্তাঘাট একেবারেই ফাঁকা ছিলো বলে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। সেখানেও মেসিদের নিয়ে শুরু হয় আরেক দফা শোরগোল। ছবি তোলার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিমানবন্দরের কর্মকর্তা, কর্মচারী আর নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যেও ছিল ছবি তোলার বিপুল উৎসাহ। বিমানের জন্য অপেক্ষার সময়টায় মেসি-হিগুয়েইনরা গিয়ে বসেছিলেন ভিআইপি লাউঞ্জে। সে সময় ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে খেলার পুনঃপ্রচার হচ্ছিলো। সতীর্থরা একসঙ্গে বসে খেলা দেখেছেন। এ সময় বেশ খুনসুটিও করছিলেন মেসি। ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছিলেন টিভিতে। হয়তো মুগ্ধ দর্শকের মতো নিজেই দেখছিলেন নিজের খেলা! নির্ধারিত সময়েই ছেড়েছে বিমান। রানওয়েতে বিমান যখন দৌড় শুরু করলো- মেসি তখন চলে যাচ্ছেন বাঙলাদেশ ছেড়ে। স্মৃতির কবিতায় শব্দ-কল্প-উপমায ‘বাঙলাদেশ’ এঁকে মেসি তখন চলে যাচ্ছেন বাঙলাদেশ ছেড়ে।
আর্জেন্টিনার সাথে বাঙালির সম্বন্ধ অনেক আগের, একেবারে যেনো ‘পুরাতনী তুমি, নিত্য-নবীনা’। সে-ই রবীন্দ্রনাথ-ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তারপর ম্যারাডোনা আর এখন মেসির নতুনত্ব। এই চির-নতুন, চির-সবুজ সম্পর্কের এই ক্যানভাসে মেসিদের সফরটা যেনো ছিলো আরেকটি গাঢ় এবং উজ্জ্বল রঙ। তাই সব কিছু ফেলে সেদিন নতুন রঙে সেজেছিলো বাঙলাদেশ, বাঙালির হৃদয় বারান্দায় এক চিলতে রোদের মতো ছড়িয়ে থাকা ফুটবলের জন্য ভালোবাসা। তাই মেসিরা হয়তো চলে গেছেন, সময়ের হিসেবে চব্বিশ ঘণ্টাও অবস্থান করেননি- তবুও আর্জেন্টিনার ফুটবল প্রাণময় হয় আমাদের মনোবীণায় মেসিরা জেগে থাকেন আমাদের হৃদয়ে- যেমন রবীন্দ্রনাথের গান জেগে থাকতো ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর গ্রামোফোনে।