বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর পরিস্থিতি ও ভূমিকা সম্পর্কে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা পোস্টে। গত ২৬ আগস্ট থেকে ০৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত এই বিশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া থেকে তাদের ভাঙন ও বর্তমান ক্রিয়াকলাপের বিশদ তথ্য উঠে এসেছে। একই সঙ্গে মূর্ত হয়েছে রাজনীতির মাঠে তাদের সক্রিয়তার উপলক্ষ বা নিষ্ক্রিয়তার কারণ।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) প্রণয়ন করে। প্রণয়নের পর ১৯৭৮ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটির বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ২১১টি বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। তবুও কতগুলো ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে, এখনো যার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই বাস্তবতাই উঠে এসেছে ব্র্যাকেটবন্দী দলের কাহিনি শিরোনামের চার পর্বের প্রতিবেদনে। নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশিত এই চারটি প্রতিবেদন খানিকটা তলিয়ে পড়লে বোঝা যায়— বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেরই দলীয় বৈশিষ্ট্য নিবন্ধনের শর্তানুমুখী নয় এবং এ কারণে তাদের অনেকেরই প্রায়োগিক রাজনীতি বাংলাদেশ আদর্শের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।
নিবন্ধন আইনের ঘেরাটোপে অস্পষ্ট আদর্শ
২০০৮ সালে ইসি সর্বমোট ৪৪টি দলকে নিবন্ধন দেয়, যার মধ্যে পরবর্তীতে ৫টি দলের নিবন্ধন বাতিলও করা হয়। এগুলোর মধ্যে ৪টি দলের নিবন্ধন বাতিল হয় ইসি’র শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায়।
আর যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামের (যার নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪) নিবন্ধন বাতিল হয় ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আরপিও’র ৯০ এইচ ধারা অনুযায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে যে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে, তারা কি আরপিও’র নিবন্ধন শর্তাবলী মেনে দল পরিচালনা করছে?
নিবন্ধন প্রক্রিয়ার চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় ইসি যে দলগুলোকে নিবন্ধন দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। যেহেতু ১৯৭৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলছে এবং একাধিক দাবির পরও সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেনি, সেহেতু মোটা দাগে তাদের নিবন্ধনের বিষয়ে ইসি বাধা দিতে পারে না। কিন্তু আমরা যদি আরপিও’র ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধীকরণের অযোগ্য হইবে’ মর্মে ৯০গ(১) অনুচ্ছেদভুক্ত পাঁচটি শর্ত (ক-ঙ) লক্ষ্য করি, তাহলে স্পষ্ট বুঝতে পারব বর্তমান ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অধিকাংশই নিবন্ধনের অযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বর নিবন্ধন দেওয়া ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ২০ নভেম্বরে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ইত্যাদি। আরও বেশকিছু ধর্মভিত্তিক দল আছে, সবার নাম উল্লেখ করে লেখার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাবে।
উল্লিখিত দলগুলোর গঠনতন্ত্র, নাম, দলীয় পতাকা বা চিহ্ন পরীক্ষা করলে দেখা যায়, আরপিও’র ৯০গ(১) অনুচ্ছেদের প্রথম শর্তেই অধিকাংশ দল নিবন্ধিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, কারণ তাদের প্রায় সকলের ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ হয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা, না হয় মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা বা কোরআন-সুন্নাহ আইন প্রতিষ্ঠা— যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত নয়, অর্থাৎ আরপিও’র ৯০গ(১)(ক) পরিপন্থী। তাছাড়া অনেক দলের নামেও একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা ধর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা আরপিও’র বিধান বিরোধী। তাহলে এই দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্র, দলীয় চিহ্ন বা পতাকায় সংবিধান পরিপন্থী হয়েও কীভাবে নিবন্ধন টিকিয়ে রেখেছে?
ব্র্যাকেটে ভাঙনে রাজনীতির সারাৎসার
৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বাদ দিলে বাকি যে দলগুলো রয়েছে, তাদের সিংহভাগও নানাভাবে বিভক্ত। একই নামে একাধিক দল ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে তাদের রাজনীতি পরিচালনা করছে।
সবচেয়ে বেশি ব্র্যাকেটবন্দী দল আছে স্বৈরশাসক এরশাদ-প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির নামে। এই দলের বিভক্তির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়, যেমন নয় জাসদ, বাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টির বিভক্তির ইতিহাস। প্রতিবেদনে বামপন্থী দলগুলো বিভক্তির যে আদর্শিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তা তাত্ত্বিক ও দলীয় নীতি-নির্ধারণের।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভালো-মন্দ বা জনমনস্তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এই কারণগুলো কতখানি যৌক্তিক, সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু জাতীয় পার্টির যে বিভক্তি, তার ষোলো আনাই স্বার্থগত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
বিএনপি বা চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসা দলগুলোর ক্ষেত্রেও তা-ই। রাজনীতি যেখানে আদর্শিক মানদণ্ডের প্রেক্ষিতে পরিচালিত হওয়ার কথা, সেখানে তাদের ব্র্যাকেটগুলো কেবল স্বার্থান্ধই নয়, কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীলও। আবার তাদের দল-বদলানোর মহড়া এমনই আশ্চর্যজনক যে, আমাদের চোখ কপালে উঠার জোগাড়।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিকল্প ধারা মূলত বিএনপিপন্থী নেতাদের নিয়ে গঠিত। বিএনপিচ্যুত হলেও তারা বিএনপি’র আদর্শচ্যুত ছিল না কখনো। তাদের নানা বক্তব্য-বিবৃতি এখনো খুঁজলেই পাওয়া যাবে। গত নির্বাচনের আগে এই দলটিতে ভাঙন দেখা দেয় এবং রাতারাতি জনাব একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সমর্থিত অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে এবং দুজন সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। তাদের একজন মাহি বি চৌধুরী (মুন্সিগঞ্জ-১) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের গণমাধ্যমের টকশোতে বড় গলায় যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটি কার্যকলাপের সমালোচনাকারী মাহি বি চৌধুরী রাতারাতি কীভাবে নৌকার প্রার্থী হয়ে গেল, তা বুঝতে গেলে এদেশের রাজনৈতিক ময়দানের আদর্শহীনতা বোঝা জরুরি।
নারীর রাজনীতি নাকি রাজনীতির নারী
এখন পর্যন্ত আরপিও’র যে সংশোধনগুলো আনা হয়েছে তার মধ্যে ২০০৮ সালের সংশোধনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল স্তরের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির বাধ্যবাধকতা। সময়সীমা শেষ হয়েছে গত বছর। কিন্তু ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনো নিবন্ধিত অনেক দলে নারী সদস্যের সংখ্যা কত তা সুস্পষ্ট করে বলতে পারেননি দলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোতে নারী সদস্যের সংখ্যা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশের খবর গণমাধ্যমটি দিয়েছে। সেটি প্রকাশিত হলে তাদের সার্বিক চিত্রটি পাওয়া যাবে কিন্তু সাধারণ জ্ঞানে আমরা বুঝি, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যেভাবে নারী নীতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত বক্তব্য দিয়ে যায়, তাতে তাদের দলে নারী সদস্যের সংখ্যা থাকারই কথা না। তাদের দলীয় কার্যক্রমের যে সকল সংবাদ প্রকাশিত হয়, তাতেও নারী সদস্যদের কোনো উপস্থিতি বা নাম আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু যে দলগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে না, তাদের ক্ষেত্রেও নারী নেতৃত্বের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক।
গণফোরাম, বিকল্প ধারা, এলডিপি’র কথা বাদই দিলাম, তাদের সার্বিক নেতৃত্বের অবস্থাই ভঙ্গুর। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোও নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে তেমন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।
নারী নেতৃত্বের চিত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও যে খুব আশাব্যঞ্জক, তা নয়। ২০১৬ সালের ০৭ মার্চ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী সদস্যের শতকরা হার যথাক্রমে ১২.৩৩, ১১.১১ ও ৭.৬৯ ভাগ। এই পরিসংখ্যান পাঁচ বছর আগের।
গত পাঁচ বছরে এই হার বেড়েছে বলেই যদি ধরে নিই, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, তাতে নারী নেতৃত্ব কার্যকরভাবে বিকশিত হচ্ছে কি? কারণ ক্ষমতাসীন দলে নারী নেতৃত্বের বিকাশ কেবল সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। গত কয়েক বছরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই পুরুষ অপরাধীদের পাশাপাশি আমরা নারী অপরাধীদের আস্ফালন দেখেছি। তাদের দলীয় পদ প্রাপ্তির বিষয়ে নানা প্রশ্নও উঠেছে।
ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে হয়েছে, আরপিও’র ধারা বিবেচনায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিধান পরিত্যক্ত না হওয়ার দরুণ যে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আছে, পরীক্ষা করলে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশের গঠনতন্ত্রই সংবিধান সম্মত নয়। অর্থাৎ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ যদি ঠিকঠাক বাস্তবায়িত না হয়, তবে তারা কেউই নিজেদের গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা দলীয় পতাকা-চিহ্ন, এমনকি নাম পরিবর্তন না করে রাজনীতি করতে পারবে না। সেই সঙ্গে অন্যান্য একাধিক দলের দায়িত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে মন্তব্য করেছেন, ‘দেশে তো রাজনীতি নেই’।
কথাটি যে সত্য নয় সে সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই করোনা মহামারির সময়েও সাধারণ মানুষ, সরকার ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন এবং প্রতিবাদের মুখে সরকার অনেক ন্যায্য দাবি মেনেও নিয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে আমরা এই রাজনীতিবিদদের অধিকাংশকেই তো পাই না। তারা পার্লামেন্টেও নেই রাজপথেও নেই, কেউ কেউ দলীয় কার্যালয়েও নেই— তবে তারা আছেন কোথায়?
আমরা তো জানি রাজনীতি ‘করার’ দায়িত্বটুকু রাজনীতিবিদদেরই, এখন তারাই যদি বলেন, দেশে রাজনীতি নেই, তাহলে তারা করছেন কী? আর যদি করার কিছু না-ই থাকে, তবে তারা কেন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হয়ে আছেন? রাজনীতির ময়দানে আমড়া কাঠের ঢেঁকির তাৎপর্য কী?