একটি বিশেষ স্টাইলে নিজের তোলা একটি ছবি বাঁধিয়ে রাখার খুব ইচ্ছে আমার। কোমরে হাত, ঘাড়টা আমার ডান হাতের দিকে বাঁকানো। অবশ্য ছবিটা যিনি দেখবেন, তার মনে হবে আমি বাঁ দিকে ঘাড় কাত করে রেখেছি। ছবিটার উপরে অ্যামবুশ করে লিখে রাখা হবে জীবনানন্দ দাশের সে-ই অনন্য কবিতার পঙক্তি,
আবার আসিবো ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়.. ..
নিজের এমন একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখার শখটা পূরণ হচ্ছে না আমার। যখনই দেয়ালে ছবি টাঙাতে যাই- তখনই দূর থেকে দেখে মনে হয়- না, হলো না তো। হলো না। ঠিক রুমীর মতো লাগছে না।
রুমী। শফি ইমাম রুমী। উনিশ শো একাত্তর সালের এই দিনে (৩০ আগস্ট) সহযোদ্ধাদের সাথে রুমীর সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয় যায়। তাঁর সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন লেখায় জানা যায়- ত্রিশ আগস্টের পর আর তাঁরা রুমীর দেখা পাননি।
তবে কি এই দিনটিই রুমীর চলে যাবার দিন?
রুমী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ। ভাষা আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল সময়ে যাঁর জন্ম, একাত্তরের নিবিড় প্রশান্তিতে তাঁর চলে যাওয়া। মাঝখানে দৃপ্ত জীবনের এক অনিমেষ অধ্যায়। আদমজী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি। তারপর ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেও তিনি বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ক্লাশ করেন। ফলে সে-ই সময়ের উত্তাল পরিস্থিতি তাঁকেও স্পর্শ করে এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য তিনিও তৈরি করতে থাকেন নিজেকে। আর সে কারণেই ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগ পেয়েও যুদ্ধ শুরু হবার দরুণ সে সুযোগটি তিনি গ্রহণ করেননি।
মুক্তিযুদ্ধে যাবার বিষয়ে রুমী শুরু থেকেই পরিবারের সাথে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মা জাহানারা ইমামকে বোঝাতে সক্ষম হন যে- বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের কবিতায় রুমী এক নিবেদিত পঙক্তিমালা। এ বিষয়ে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থের এক জায়গায় বলেন,
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান বিতার্কিক রুমীর সাথে তর্কে পারবো, সে শক্তি কী আমার আছে?
একাত্তরের জন্য রুমীর প্রথম প্রয়াস ছিলো ২ মে সীমান্ত অতিক্রম। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয় তবে দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটি ছিলো একেবারে সফল। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমন্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিলো উল্লেখযোগ্য।
ধানমন্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, এবং এই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে বেশ কিছু সংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করে যার মধ্যে ছিলেন বদি, চুন্নু, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সাথে তাঁর বাবা শরীফ ও ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদও গ্রেফতার হন। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তাঁদেরকে তাঁর সাথে যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী ও চুন্নুকে আর দেখা যায়নি।
রণাঙ্গণ থেকে রুমী চিঠি লিখেছিলেন তাঁর মামা সৈয়দ মোস্তফা কামাল পাশাকে। তিনি বর্তমানে 5 Grenfell Gardens, Harrow Middlesex, HA3 0QZ, UK এই ঠিকানায় থাকেন। চিঠিটি কী অসামান্য ছিলো।
Agartala, June 16, ‘71
Dearest Pasha Mama,
Don’t be surprised! It was written and has come to pass. And after you read this letter, destroy it. Don’t try to write to Amma about this letter. It will put them in danger.
This is a hurried letter. I don’t have much time. I have to leave tomorrow for my base camp.
We are fighting a just war. We shall win. Pray for us all. I don’t know what to write… …there is so much to write about. But every tale of atrocity you hear, every picture of terrible destruction that you see is true. They have torn into us with a savagery unparalleled in human history. And sure, as Newton was right, so shall we too tear into them with like ferocity. Already our war is far advanced. When the monsoons come, we shall intensify our operation.
I don’t know when I shall write again. Please don’t write to me.
And do your best for SHONAR BANGLA.
Bye for now. With love and regards.
Rumi.
ইংরেজীতে লেখা এই চিঠি পড়ে আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কী অসামান্য সংবেদনশীল প্রতিটি শব্দ! রণাঙ্গণে থেকেও রুমীর কী অসামান্য শব্দচয়ন।
রুমীর মতো করে সে-ই ছবিটা আর তোলা হলো না। আমাদের সমস্ত তারুণ্যে এখন দৈন্যদশার চূড়ান্ত রূপ। রুমীর মতো করে বলতে পারি না বলে শর্মিলা বসুরা আমাদের মাথার উপর দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়, আর আমরা ‘সত্য প্রকাশিত হইবেই’ মর্মে জীবনের দাঁড় বেয়ে চলি। সত্য হয়তো ঠিকই প্রকাশিত হবে, কিন্তু সে-ই প্রকাশিতব্য সত্য শর্মিলা বসুদের মতো ইয়োগাদের কতোটুকু স্পর্শ করবে- আমি জানি না। শেক্সপীয়র শর্মিলা বসুদের কথা মনে রেখেই নির্মাণ করেছিলেন ইয়োগাকে- আর রুমীকে মনে রেখে তৈরি করেছিলেন হ্যামলেট- আর আমরা, একাত্তর উত্তর প্রজন্ম, হোরেশিও- বন্ধুত্বের তীব্র মর্মবেদনাকে ট্র্যাজিডির মলাটে নিয়ে রুমীর জন্যে লিখে চলি, কেউ কেউ সে লেখা পড়েন, মন্তব্য করেন। ‘ভালো হয়েছে’, ‘অসাধারণ’.. ..ইত্যাদি বিশেষণে ভাসি; অতঃপর রুমীরা চলে যান আর্কাইভে।
আর্কাইভেও রুমীদের সহজে পাওয়া যাবে না। তারা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, এই নচ্ছাড় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়ে লাভ নেই, এরা মনে রাখতে পারে না।
হয়তো তাই। গোল্ড ফিসের মেমোরি আমাদের, অথচ যুদ্ধাপরাধীদের অ্যামিবার আয়ু।
তবুও আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির পরিবর্তন হয়। চল্লিশ বছর বয়সী বাঙলাদেশ নামক ক্ষুদ্র একটা রাষ্ট্রে বসে আমি স্বপ্ন দেখি আজ থেকে একশত চল্লিশ বছর পর আরেকজন রুমীর জন্ম হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যার লেখা চমৎকার একটা বই পড়ে ক্ষমা প্রার্থণা করবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। লজ্জিত হবে শর্মিলা বসুর পরিবার। যাঁকে দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো কোনো শিশু তার এইম ইন লাইফ রচনায় লিখবে- আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা ফ্রিডম ফাইটার..।
আর সে-ই ঝলমলে রুমী তাঁর আত্মজীবনীর উৎসর্গপত্রে লিখবে- “বইটি উৎসর্গ হলো আজ থেকে একশত বছর আগে জন্ম নেয়া আমার পূর্ব-পুরুষদের প্রতি। অক্ষম, ‘শুয়োরের বাচ্চা’ হলেও, আমি যাদের ভালোবাসি”।
আমি সে-ই রুমীর জন্য আমার পোট্রেটটা রেখে গেলাম।