স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করলে নিঃসন্দেহে বিষয়টি হবে আঁৎকে উঠার মতো। স্বাধীন রাষ্ট্রে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের উপর বিভিন্ন সময়ে যে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার অধিকাংশেরই বিচার হয়নি। বিচারহীনতা অবশ্য সমাজের নানা অপরাধের ক্ষেত্রেই বাড়ছে। কোনো অপরাধ ‘অপরাধ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেটা নিয়ে কতদিন আলোচনা থাকে তার উপর। কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হলে প্রথম কিছুদিন তা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়; তারপর অন্য আরেকটি ঘটনার আড়ালে তা চাপা পড়ে যায়। এই ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির দুষ্টচক্রে বস্তুত পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধীরা। আর অপরাধ বাড়তেই থাকে সমাজে।
একসময় গণমাধ্যমে আমরা ‘ফলো-আপ’ প্রতিবেদন পড়তাম। কোনো একটি ঘটনার পর তা নিয়ে দীর্ঘ ও ধারাবাহিক তদন্তের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীরা সত্য উদ্ঘাটন করতেন। আজকাল এই ‘ফলো-আপ’ প্রতিবেদনের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। ফলে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে এবং পুরোনো ইস্যুগুলো নিয়ে আর আলোচনাই হচ্ছে না।
আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে, যে গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্ব ও ব্রতই হল ঘটনার পেছনের সত্যটুকু উদ্ঘাটন করা, সমাজের অন্যায়গুলো মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া– তারাই নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে সাংবাদিক হত্যার উদাহরণও বাংলাদেশে কম নয়। সাংবাদিকরা একসময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ খড়গ। বিএনপি-জামাযাত জোটের দুঃশাসনের সময় আমরা দেখেছি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে, নির্যাতন চালানো হচ্ছে তাদের উপর। যে মানুষেরা সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের পেছনে কাজ করেন, তাদের রক্তাক্ত বা হাতে হাতকড়া পরানো ছবি আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি।
এগুলোর বিচার হয়নি। কবে বিচার হবে, আমরা জানি না।
দুই
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে লেখার জন্য হত্যা করেছে দেশের বরেণ্য সাংবাদিকদের। স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকরা রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাজনৈতিক দলের নেতাদের পেশীশক্তি আর ক্ষমতার উন্মত্ততার শিকার হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা এমনকি কালো টাকার মালিক বড় বড় ব্যবসায়ীরাও সাংবাদিকদের উপর নানাবিধ নির্যাতন চালিয়েছেন, এখনও চালাচ্ছেন। কিন্তু আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বলে সম্প্রতি সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি একেবারে জল-ভাতের মতো সহজ করে দেওয়া হয়েছে। মানে এখন দুর্নীতিবাজ পুলিশ বা আমলা হতে হবে না, কালো টাকার মালিক বা ঋণখেলাপী হতে হবে না– রাজনৈতিক পেশীশক্তি থাকুক বা না থাকুক নিজের কোনো অপরাধ প্রকাশিত হয়ে গেলে ৫৭ ধারা বলে সাংবাদিকদের এক হাত নিয়ে নেওয়া যাবে!
কেবল গণমাধ্যমকর্মীরাই নন, এই কালাকানুনের বলি হচ্ছেন লেখক, ব্লগার, রাস্তায় প্রতিবাদে নেমা আসা মানুষ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ সোচ্চার হওয়া কোনো অনলাইন অ্যকটিভিস্ট। এই ধারা বাতিলের দাবি উঠেছে অনেক দিন আগেই। কিন্তু সরকার তা বাতিল করা তো দূরের কথা, একে কী করে আরও নির্যাতন-উপযোগী করা যায় সে বিষয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি মানিকগঞ্জের এক বিচারককে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম মুজতবা ধ্রুবর বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ধ্রুবর প্রতিবেদনটি ছিল মানিকগঞ্জের এক জ্যেষ্ঠ সহকারী জজের বাড়ি বদলের জন্য রাখা ট্রাকে এক শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথ আটকানো নিয়ে। একটি মানবিক বিষয় মানুষের সামনে তুলে ধরা, এটাই ছিল প্রতিবেদকের অপরাধ।
জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ একজন আইনজীবী হয়েও কোন আইনের বলে একজন অসুস্থ শিশুর হাসপাতালে যাবার পথ আটকে বাড়ি বদল করছিলেন, এটা কিন্তু আলোচনায় আসেনি। অন্যায় করেছেন সে-ই জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ, কিন্তু মামলা হল বিষয়টি নিয়ে যিনি প্রতিবেদন তৈরি করলেন তার বিরুদ্ধে। মানে চোরের মায়ের গলা কত বড় এই মামলা দিয়ে সেটা প্রত্যক্ষ বোঝা যায়।
এর আগেও আমরা দেখেছি (৩০ এপ্রিল, ২০১৭) ওয়ালটন নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় গণমাধ্যমকর্মী আহমেদ রাজুকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তার বিরুদ্ধেও ৫৭ ধারায় মামলা করেছিল ওয়ালটন গ্রুপ।
এর আগে ফরিদপুরে একই আইনে মামলা হয়েছিল সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ফরিদপুরের যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে প্রতিবেদন করায় হামলার শিকার হয়ে পা হারিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের আমলে তিনি একই বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট ও প্রতিবেদন তৈরি করে মামলার শিকার হলেন। এক দল ক্ষমতায় এসে হামলা করে, অন্য দল ক্ষমতায় থেকে কালাকানুনের বদৌলতে মামলা করে– এর মাঝখানে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েও সত্যটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন নজির অনেক। বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। তবে বাংলাদেশে এটি বাড়ছে ক্রমশ। এর একটি ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখতে পাই ২০১৩ সালে, হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের সময়। সে সময় এই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর আক্রমণ চালায়।
৯ জুন, ২০১৭ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসিতে রাজধানীর মিরপুর থানাধীন কল্যাণপুরের নতুন বাজার এলাকায় রমযান মাস কেন্দ্র করে জোর করে খাবারের দোকান বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন বিকাশ বিশ্বাস। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আচরণ কতটা একপেশে হলে এমন ঘটনা খোদ রাজধানীতেই ঘটতে পারে, তা আমরা বিকাশের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি। প্রতিবেদনটিতে বায়তুল মোকারম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমামের বক্তব্যও নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, জোরপূর্বক দোকান বন্ধের কোনো বিধান ইসলামে নেই।
তারপরও, প্রতিবেদনটি ফেসবুকে পোস্ট করা হলে তার নিচে যে ভয়াবহ রকমের সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা হয়েছে তা অকল্পনীয়। কোনো কোনো মন্তব্যে প্রতিবেদককে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতি কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে পড়ছে না। যদিও আমরা দেখি ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়ি এসে হাজির হয়ে ৫৭ ধারায় আটক করছে কাউকে কাউকে। তাহলে এই ধারা বা তার প্রয়োগ কি কেবল তাদের জন্য যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন বা সমাজের অন্যায়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরবেন?
তিন
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় এ যাবত যে মামলাগুলো হয়েছে তার সিংহভাগই দমন ও নিপীড়নমূলক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে যে ধরনের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য পোস্ট করা হয়, সে বিষয়ে ৫৭ ধারার প্রয়োগ কিন্তু দেখা যায় না। ৫৭ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে–
কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।
আইনপ্রণেতারা বোধকরি প্রধানমন্ত্রী বা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বক্তব্য কানে শুনেন না। তারা কোনোদিন জামায়াত-শিবিরের পরিচালিত ফেসবুক পেইজ ‘বাঁশের কেল্লা’র পোস্ট দেখেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মের নামে অশ্লীল ওয়াজের ভিডিওগুলোতে যে মানুষরূপী পশুদের বয়ান শোনা যায়, সেগুলোর মাধ্যমেও ৫৭ ধারার লঙ্ঘন হয় না। এই কালাকানুন কেবল প্রয়োগ হয় লেখক-সাংবাদিক-ব্লগার বা প্রতিবাদকারীদের উপর।
আইন না হয় অন্ধ, কিন্তু আইনের যষ্ঠি যাঁরা, তাঁরা তো দেখতে পান। না কি তাঁরা দেখেও না-দেখার ভান করেন? বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা এমনই যে, বার বার মনে পড়ে যায় শেকসপীয়রের কিং লিয়ার নাটকের সেই সংলাপ:
Tis the time’s plague when madmen lead the blind.
০৫ আষাঢ় ১৪২৪
লেখাটি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো উল্লিখিত তারিখে। বিডিনিউজে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।