একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি একটি মহাকাব্য হয়, তবে তার প্রবেশদ্বার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই অবিনাশী উচ্চারণ। একটি মুখবন্ধ—যার মধ্যে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তর-উপস্তর ব্যাখ্যা করা আছে; আছে নির্যাতিত হওয়ার খতিয়ান, নির্দেশনামা, করণীয় এবং অকরণীয়সমূহ। মাত্র ঊনিশ মিনিটের এই পারাবারপ্রতিম ভাষণে জাতির জনক আসলে রচনা করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার সংজ্ঞা, তাকে বিস্তৃত করেছিলেন ‘মুক্তি’র অভিধায়; এবং বলাই বাহুল্য এই নাতিদীর্ঘ ভাষণটিতেই তিনি বপন করে গিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ইশতেহার। তাঁর উচ্চারিত এক হাজার একশত সাতটি শব্দের প্রতিটি শব্দই তৎকালীন সময়ঘনিষ্ঠ হয়েও ভবিষ্যৎমুখী, স্পষ্ট অথচ ইঙ্গিতবাহী এবং রাজনৈতিক বিচারে সুদূরপ্রসারী। ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণের ইশতেহার যেমন এই ভাষণে প্রোথিত, তেমনি পঁচাত্তর পরবর্তী অন্ধকার সময় থেকে সংগ্রামে-ত্যাগে আবার আলোর দিকে ওঠে আসার প্রেরণাও এই ঐতিহাসিক ভাষণ।
আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার দরুণ দীর্ঘ একটি সময় স্বাধীন বাংলাদেশে অবাধে ঘটেছে পাকিস্তানতন্ত্র, চলেছে সামরিক ও মোল্লাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় মহড়া। পঁচাত্তরের পর থেকে দীর্ঘ একুশ বছর পর্যন্ত চলা এই মৌলবাদী অপশাসন ব্যবস্থায় ৭ই মার্চের ভাষণকে পাঠানো হয়েছিলো নির্বাসনে। কেননা, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সামরিক শাসক ও তাদের তাঁবেদাররা জানতো—৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিটি ছত্রে লুকিয়ে আছে পুনর্বার জ্বলে ওঠার মন্ত্র। ফলে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি ৭ই মার্চের এই অনবদ্য ভাষণটিকেও নানাভাবে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চলেছে। বই-পত্র বা দলিল-দস্তাবেজে তার উল্লেখ না থাকায় মানুষ সত্য ইতিহাসটুকু জানতে পারেনি। অথচ সময় গড়িয়েছে। ইতিহাস বিকৃতির কানাগলিতে বেড়ে উঠেছে অন্তত দুটি প্রজন্ম। তারপর ৭ই মার্চের ভাষণকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানাবিধ রাজনীতি। যেহেতু এই ভাষণটিকে ঘিরে পরিপূর্ণ গবেষণা বা প্রচার ছিল না, ছিল না কোনও বইপত্র বা প্রামাণ্যচিত্র; সেহেতু বঙ্গবন্ধু কী বলেছেন আর কী বলেননি—সে নিয়ে বিতর্ক তৈরির সুযোগ নেয় নানা পক্ষ। যে ভাষণটি নিয়ে হতে পারতো অসামান্য সাহিত্যকর্ম বা চলচ্চিত্র, হতে পারতো সুচিন্তিত অভিসন্দর্ভ—তাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিতর্ক। সেসব বিতর্ক যুক্তি-তর্কের বাইরে গিয়ে মূলত গালগপ্পে রূপ নিয়েছে, অর্থাৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিলের রাজনীতি চলমান আছে।
এ কথা ঠিক, গত দশ বছর ধরে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বারবার প্রচারিত হচ্ছে। এ নিয়ে কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র এবং সাহিত্যকর্ম। কিন্তু শিক্ষার যে মূলধারা—তাতে এখনও ঠাঁই পায়নি ৭ই মার্চের এই অবিনাশী পঙক্তিমালা। ৭ই মার্চ এলেই পাড়ায় পাড়ায় মাইক বাজিয়ে ভাষণটি চালানো হয় ঠিকই কিন্তু এর প্রভাব কতটুকু পড়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে? সারা দিন মাইক বাজিয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল প্রচার করাই সম্ভব কিন্তু এই প্রচারই কি যথেষ্ট? তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন মানুষ চাইলেই ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনতে পারেন ইউটিউব বা অন্য যে কোনও ওয়েবসাইট থেকে। তাহলে সারা দিন মাইক বাজানো হয় কার জন্য? যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বেড়ে উঠছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য, তাদের কাছে এই ভাষণের মর্মার্থ পৌঁছানোর উদ্যোগ কোথায়?
দুই
ওপরের কথাগুলো বললাম একটি সুনির্দিষ্ট কারণ সামনে রেখে। কয়েক মাস ধরে আমরা কয়েকজন একটি কাজ করে চলেছি। সারা দেশে ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের কণ্ঠে আমরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি শোনার আয়োজন করেছি। অংশগ্রহণকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৭ই মার্চের ভাষণের বিভিন্ন অংশ বঙ্গবন্ধুর মতো করেই বলার চেষ্টা করছে। তারপর সেটুকু রেকর্ড করে পাঠাচ্ছে আমাদের ই-মেইল ঠিকানায়। মাত্র দেড় মাসে আমরা ৬৮৫৭টি ভাষণ পেয়েছি, যা সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ, আমরা ভাবিনি এতোটা সাড়া পাওয়া যাবে। কোনও কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন আলোচনা করেছি, তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে কথা বলেছি, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি—যতটা সহজে তারা ভাষণটি মুখস্থ করতে পারছে, ততোটা সহজে এই ভাষণের মর্মার্থ আত্মস্থ করতে পারছে না। ইন্টারনেট বা নানা ধরনের বইপত্র থেকে তারা ভাষণটি সংগ্রহ করেছে, ফলে কারও কারও কাছে পূর্ণাঙ্গ ভাষণটিও নেই। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ভাষণের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যও ঠিক মতো পৌঁছায়নি। আমাদের একটি ছোট দল, দলের নাম ‘মুক্তির গান’। এই ছোট দলটি বড় একটি স্বপ্ন নিয়ে এই শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে যেমন আপ্লুত হয়েছি, তেমনি হয়েছি আশাহত। যে ভাষণটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত, যে ভাষণটি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভূমিকাপত্র—তার পূর্ণাঙ্গ লিখিত রূপটিও অনেক শিক্ষার্থীর কাছে নেই! শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে হয়তো ভাষণটি আছে কিন্তু তার যে বয়সভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন—তা তো অনুপস্থিত। ফলে সকলের কাছে জাতির জনকের এই অবিস্মরণীয় উচ্চারণের ঢেউ পৌঁছালেও মুক্তো পৌঁছায়নি। যে ভাষণটি সম্বন্ধে জানতে আমাদের প্রজন্মকে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছিলো, সে ভাষণটি সম্বন্ধে এখনকার শিশু-কিশোররা জানে, তবে তা অপর্যাপ্ত এবং ভাসা ভাসা।
তিন
এমন একটি আশাহীনতার জায়গায় যখন আমরা দাঁড়াই, তখন মনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন তৈরি হয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের পাঠ্যপুস্তককে ব্যবহার করেছিলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপ-আদর্শকে প্রজন্মের মগজে প্রতিষ্ঠিত করতে। যে ক্ষতি তারা করে গিয়েছিলো, যে যা-ই বলুন না কেন, তা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। কারণ, এখনও আমাদের পাঠ্যপুস্তকে চলে সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ, এখনও আক্ষরিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শপ্রসূত পাঠ্যপুস্তক আমরা প্রণয়ন করতে পারিনি। আমার এই বক্তব্যের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো—আজ পর্যন্ত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ৭ই মার্চের এই ভাষণটিকে অন্তর্ভুক্ত করা গেলো না। যেহেতু পাঠ্যপুস্তক হচ্ছে প্রতিটি প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম, সেহেতু ৭ই মার্চের এই ভাষণটি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক আলোচনা-ব্যাখ্যার সবচেয়ে উপযোগী স্থান হতে পারে পাঠ্যপুস্তক। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল গত দশ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন, অথচ জাতির জনকের এই অবিনাশী ভাষণটি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। উল্টো আমাদের পাঠ্যপুস্তকে চালানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ছুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও পাকিস্তানি ভূত বিদ্যমান। এই সমীকরণের সহজ সূত্রটি হচ্ছে—স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির খপ্পড়ে পড়া প্রজন্মের অধিকাংশই ধর্মেও থাকে আবার জিরাফেও থাকে। ফলে এরা ৭ই মার্চের অমোঘ ভাষণ সারা দিন মাইকে বাজালেও এর বাস্তব প্রতিফলন রচনা করতে সমর্থ হয় না। কারণ, এই ভাষণেই তো জাতির জনক আমাদের অনুপ্রবেশকারীদের সম্বন্ধে সতর্ক করেছেন।
চার
প্রতি বছর ৭ই মার্চ এলে আমরা নানা ধরনের আলোচনা, সেমিনার বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এগুলো তো উদযাপন; ৭ই মার্চের অনন্যসাধারণ ভাষণ তো আমার মুক্তি সংগ্রামের মুখপত্র, কেবল উদযাপনের উপলক্ষ নয়। তাই পাঠ্যপুস্তকে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলেই আগামী প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে জানতে বড় হবে। তখন তার কাছে গিয়ে ইতিহাসের মিথ্যা বেসাতি করে কোনও লাভ হবে না। যে প্রজন্ম তার পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পড়ে বড় হবে, সে প্রজন্ম জানবে—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকারীদের অবস্থান হয় আস্তাকুঁড়ে।