মা দিবস শেষ হলো।
দিবস উদযাপন অত্যন্ত আনন্দঘন একটি বিষয়। বিভিন্ন দিবসের বিভিন্ন প্রতিপাদ্য- বাঙালি নানাভাবে সেসব দিবস উদযাপন করে থাকেন, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা এসব দিবসের প্রতিপাদ্য মুখস্থ করে রাখেন, দিবসকে কেন্দ্র করে হাল আমলের টি-শার্ট, পোস্টার, শুভেচ্ছা কার্ড আরও কতো কী! গণমাধ্যমগুলোতে বিশেষ দিবসের বিশেষ সংবাদ, বিশেষ অনুষ্ঠান। মানে সবকিছু মিলিয়ে উৎসবমুখর জাতির উৎসবের আর শেষ নেই।
সে-ই ধারায় ‘মা দিবস’ পালিত হলো। বাঙলা-ইংরেজি-মাদ্রাসা-কারিগরি সকল মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা তাদের মায়েদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের মতো করে। হয়তো কেউ কেউ কোনো কিছুই বলেনি, অনেকে হয়তো জানেনই না কোন দিনটি ‘মা দিবস’- তারপরও এই যে সে ‘কিছুই বলেনি’ একেই ধরে নিই তার শুভেচ্ছা।
কিন্তু যতো কিছুই হোক না- এমনকি ‘মা দিবস’কে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠান হোক, ঘোষণা করা হোক সরকারি ছুটি, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলের নেত্রী একজোট হয়ে দেখা করুন মায়েদের সঙ্গে, সকল মায়েদের সঙ্গে। সংসদ উপনেতার মা হতে সংসদ ভবনের বাদামওয়ালার মা পর্যন্ত, মুশফিকুর রহিমের মা হতে কমলাপুর রেলস্টেশনের হাসেইম্যার মা পর্যন্ত, জেনেটিক রেগুলেশনে পিএইচডি করা তরুণীর মা হতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিশিকন্যা নুপূরের মা পর্যন্ত- সবাই যদি ‘মা দিবস’ এ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমমানের পুরস্কার পান; তবুও মায়েরা সম্ভবত খুশি হবেন না।
‘মা দিবস’ এলেই মায়েদের অবচেতন মনের কোণে মেঘ জমে, ভারি মেঘ, মায়েরা সহ্য করতে পারেন না, তারপরও খুশি মনে কথা বলেন। ‘মা দিবস’ এলেই বাঙলার প্রতিটি মায়ের মনে পড়ে রওশন, সাঈদার কথা। চোখের কোণে বিদ্যুৎ রেখার মতোন খেলে যায় সন্তান হারানোর আশঙ্কা, আতঙ্কিত হন মা, মায়েরা- তাঁদের সকলের মুখ পাণ্ডুর হয়ে যায়। মায়ের মুখ পাণ্ডুর- এর চেয়ে বিষাদের দৃশ্য আর কিছু নেই পৃথিবীতে।
রওশন ও সাঈদা কেবল দুটি নাম নয়, কেবল দুজন মা নন; তাঁরা ইতিহাস এবং এ দুজন সেই ইতিহাসের অংশ; মাত্র দু জন। ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানিবাহিনী সারা বাঙলায় নজিরবিহীন নারী নির্যাতন চালায়। কিন্তু এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই এটা নিয়ে রয়ে গেছে মতদ্বৈধতা। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দুইলক্ষ; মার্কিন গবেষক সুসান ব্রাউনমিলারের মতে- এই সংখ্যা অনেক বেশি প্রায় চার লক্ষ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের একটা বড়ো অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলো। সে বিপুল সংখ্যক গর্ভপাতের পাশাপাশি তাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলো পঁচিশ হাজার শিশু।
তবে একটা দুঃখ বুকের কাছে পাথর হয়ে থাকে, গলার কাছে কান্না গুলিয়ে ওঠে যখন দেখি বাঙালিরাই বাঙলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ‘সামাজিকতার’ পাশা খেলা খেলছে। একটি উদাহরণ দেয়া প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী- জগন্নাথ হল, শহীদুল্লাহ হল, ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)- একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। মনে প্রশ্ন জাগে- রোকেয়া হলে কী পাকিস্তানি বাহিনী যায়নি? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিলো বেগম রোকেয়া হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ বেগম আখতার ইমাম (যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম নারী অধ্যাপক) তাঁর রোকেয়া হলের বিশ বছর গ্রন্থে লিখেছেন
সেনাবাহিনীর আক্রমণ আমাকে চিন্তিত করে তুললেও আশ্বাস পেয়েছি তারা ভেতরে ঢুকবে না। আমি সারারাত জেগে রইলাম। শেষ পর্যন্ত কেউ ভেতরে ঢুকল না।
কিন্তু এটি মিথ্যাচার, নির্লজ্জ মিথ্যাচার। এই মিথ্যাচারের সূচনা কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই শুরু হয়ে যায়। বাঙলাদেশ স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিনের মধ্যেই একটি গ্রন্থ বের হয়। নাম বাংলায় নারী নির্যাতনের ইতিহাস। সেখানের এক অংশে লেখা ছিলো-
হলের প্রায় সকল ছাত্রী কয়েকদিন আগে হল ত্যাগ করলেও সেদিন রাতে হলে ছিলেন সাতজন ছাত্রী। তারা সবাই পরীক্ষার্থী। হলের প্রভোস্টের বুদ্ধিমত্তার জন্য তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। লম্পটের দল হামলা করেছিলো হলের প্রভোস্ট মিসেস আখতার ইমামের বাড়িতে.. ..। রাত তখন দেড়টা থেকে দুটো, বাইরের গেট ভেঙে তারা ঢুকেছিলো প্রভোস্টের ঘরে। ঢুকে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলো- তোমরা অফিসার লে আও। মিসেস আখতার ইমাম এখানকার সবচেয়ে বড়ো অফিসার বললেও তারা বিশ্বাস করেনি। মেশিনগান ও সঙ্গীনের মুখে তাঁর সাথে কথা বলা হয়েছে। নরপশুরা বারবার জিজ্ঞেস করেছে- ‘লাড়কী কাঁহা, লাড়কী কো লে আও’। প্রভোস্ট বললেন- বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তারা বাড়ি গেছে। অপরদিকে ছাত্রীরা হলের ভেতরের স্টাফ কোয়ার্টারে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলো। (পৃষ্ঠা ১১৬-১১৮, বাংলায় নারী নির্যাতনের ইতিহাস, সম্পাদনায়: আশ্রাফুজ জামান, পরিবেশনায়: উজালা প্রকাশনী)
এটি মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বের হয়। সেইসময়েই এ সত্যটা আড়ালের চেষ্টা চলে। জানি না- কেনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই মিথ্যাচারটি এখনও করে বেড়ায়, এতে কোনো লাভ নেই; কেননা ইতিহাসের শক্তি প্রমত্ত আর ইতিহাস শাশ্বত মহিমায় ভাস্বর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাসে কী ঘটেছিলো এ সম্পর্কে ঢাকাস্থ তদানীন্তন মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সেখানে উল্লেখ পাওয়া যায়-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ফ্যানের সিলিং এ ৬টি মেয়ের পা বাঁধা নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
২০০২ সালে প্রকাশিত আর্চার কে ব্লাডের বিখ্যাত বই দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ এর এক অংশে উল্লেখ রয়েছে-
..What was generally believed was that the army plan of attack at the university was to take no prisoners and to kill all the students present in the dorms…..Rokeya Hall, a dormitory, for girl students, was set ablaze and girls were machine gunned as they field the buildings…The attack seem to be aimed at eliminating the female student leadership since many girl students leaders resided in that hall
অর্থাৎ স্পষ্টতই বোঝা যায়- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনো নীতিবোধ প্রদর্শন করতে এদেশে আসেনি। মেহেরজান চলচ্চিত্রে যতোই প্রেম দেখাক, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রেমিক হিসেবে আসেনি একাত্তরে- এসেছিলো ঘাতক হিসেবে, নরপশু হিসেবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ প্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান সেই ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটিতে। জানোয়ার ইয়াহিয়ার সেই ছবিটিই ছিল সমগ্র পাকিস্তানির রূপ। ওই একটা রূপই এদের আছে।
মাঝে মাঝে ভাবি- মা দিবস এলে কেমন লাগে এই যুদ্ধশিশুদের মায়েদের? বাঙলাদেশ ছেড়ে যে নূতন নীড়ের পথে শিশুরা চলে গেছে- সে তো এদেশেরই কোনো এক মায়ের সন্তান। সে মা তো গর্ভে তাকে ধারণ করেছে, এবং শরীরের সবটুকু দিয়ে সেই সন্তানকে জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধশিশুর মায়েদের খোঁজ আমরা কেউ নেইনি। আমাদের পেরেক মারা মানসিকতা ভুলে গেলো সেই মায়ের কথা- যার জীবনও হয়তো থেমে থাকেনি, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে যে তার সেই সন্তানের কথা ভাবে, সেই যুদ্ধশিশুটির কথা ভাবে। যুদ্ধশিশু আমিনা, যে ‘আমিনা লিন উলসি’ নামে এখন পরিচিত, সে যখন আসে বাঙলাদেশে, তাঁর মা কে খুঁজতে তখন কী এই বাঙলার কোনো এক নিভৃতে এক মা তাঁর বুক ফাটা আর্তনাদে আছড়ে পড়ে না উঠোনে? কোন মা কবে তাঁর সন্তানকে ভুলে গেছেন? এমন ইতিহাস আছে কারো জানা?
আমাদের রাষ্ট্র আমাদের হীন মানসিকতা সেইসব যুদ্ধশিশুর মায়েদের বাধ্য করেছে ‘চুপ করতে’। সে সন্তানের কথা তোলা যাবে না, তার জন্যে কাঁদা যাবে না- সে যুদ্ধশিশু। কিন্তু হায়- মায়ের কাছে সে যে সন্তান, কেবলই সন্তান- আর কোনো পরিচয় নেই তার। মা কীভাবে ভুলে যাবে তাঁর আপন সন্তানকে?
অতএব- আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, অন্তত আমার মা’কে বলতে চাই- মা, আপনাকে জানাবো না আর ‘মা দিবস’ এর শুভেচ্ছা, কেননা এখনও সে-ই মায়েদের শুভেচ্ছা জানানোর পথটা পরিস্কার হয়নি। একদিন আমি জানি সব বাঙালি মায়েরা ‘মা দিবস’ এর সকল শুভেচ্ছা প্রত্যাখ্যান করবেন। সন্তানের দেয়া শুভেচ্ছা কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে বলবেন- ‘যা, ইতিহাসের দায়টা মিটিয়ে আয়, আমি তোর শুভেচ্ছার প্রতীক্ষায় রইলাম’। সে-ই ‘মা দিবস’টির পরের দিন সংবাদপত্রের ব্যানার খবর হবে- ‘যেদিন যুদ্ধশিশুর মায়েরাও পাবেন মা দিবসের শুভেচ্ছা, সেদিন পূর্ণ হবে সকল বাঙালি মায়ের অমৃত ভাণ্ডার’। এমন একটি মা দিবস আসবে, যেদিন যুদ্ধশিশুর মায়েদের শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে আসবে তাঁদের সন্তানেরা, আমার আত্মার আত্মীয়রা। সকল বাঙালি মায়েরা সূর্যের মতোন উজ্জ্বল আর দীপ্তিময় হাসি নিয়ে তাঁদের সন্তানের পাশে দাঁড়াবেন, সন্তানের দেয়া উপহারে গর্বিত হবেন, বাঙলার সকল মায়েরাই হবেন ‘রত্নগর্ভা মা’, পৃথিবী তাকিয়ে দেখবে অপূর্ব মা-সন্তানের সম্বন্ধ, পৃথিবীর সব মায়েরাই হয়ে উঠবেন শ্রেষ্ঠ মা- সারা গ্রহে আলোড়ন পড়ে যাবে মা-সন্তানের নিটোল উৎসবে।
সেদিন দূরে বসে আরেকজন মা চোখের জল মুছে হেসে উঠবেন। তিনি হাসবেন, কিন্তু চোখের জল থামবে না। তাঁর আঁচলের প্রান্তে মিশে থাকবে মহার্ঘ্য ভালোবাসা। আমার সেই অবিনাশী মায়ের নাম- বাঙলাদেশ।