মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- ‘শুকতারা’ শব্দটির অর্থ কী? কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। অভিধানের ভিতর থেকে যে অর্থটাই উঠে আসে- তাকেই বড্ডো বেশি নিরর্থক মনে হয়, মনে হয়- এর চেয়েও গভীর, এর চেয়েও প্রগাঢ় কোনো অর্থ যেনো কোথায় লুকিয়ে আছে। ১৫ অক্টোবর- বাঙলা আশ্বিনের শেষ- শরতের সায়াহ্নবেলা। প্রকৃতির চোখ হয়তো সে কথা বলে না, তবুও শরতের চলে যাবার পথে তার আঁচলের বিদায়ী রাগ মনের মাঝে কেমন যেনো বিষন্নতা জাগায়, এ বিষন্নতা কোথাকার, কীসের?
১৫ অক্টোবর, ২০০৭। আজকের তারিখ। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তারিখটি বড়ো পুরোনো, অনেক বেদনার। বর্ষচক্রের আবর্তনে শরতের শেষে গভীর দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ১৫ অক্টোবর- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’। ১৯৮৫ সালের এই দিনে জগন্নাথ হলের পরিষদ ভবনের ছাদ ধসে পড়েছিলো। ঝড়-বৃষ্টির সেই মর্মন্তুদ রাতে নেমে এসেছিলো এক মর্মান্তিক, মানবিক দুর্যোগ। বেদনাবিধূর এ ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৩৪ জন এবং পরে আরও ৫ জন। মোট ৩৯ জন। ৩৯ টি তাজা প্রাণ। কতো লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন।
কিন্তু কী ঘটেছিলো সেদিন? সে-ই শারদীয় দূর্গা উৎসবের দিনে? পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য সবারই ছিলো মনের টান। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন অতিথিরাও। রাত পৌনে নয়টায় সবাই এক সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের পরিত্যক্ত প্রাদেশিক সংসদ, অর্থাৎ জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে বসে অন্যান্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক শুকতারা দেখছিলেন। নিজেদেরই এক সতীর্থ মনন অধিকারীর অভিনয় দেখবেন সে প্রত্যাশায় অডিটরিয়ামটি পূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ ভয়ংকর শব্দ; সেই সাথে সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে এক নারকীয় অবস্থা। গগনবিদারী চিৎকারে চারপাশ ততোক্ষণে এক ধ্বংসস্তুপ। বৃষ্টির জলে ৬৪ বছরের পুরনো চুন-সুড়কির ছাদ ভেঙ্গে গেছে। ইট, টালি, লোহা ও কাঠের গরাদসহ চুন-সুড়কির স্তুপে চাপা পড়েছে সকলে!
এদের কেউ হয়তো মাত্রই টিউশনি করে এসেছিলো। নিজের কক্ষ থেকে তোয়ালে বা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতেই কেউ হয়তো এসেছিলো টেলিভিশন কক্ষে। কেউ হয়তো নিজের ঘরের ট্রাঙ্কে যত্ন করে রেখেছিলো প্রিয় কারো জন্য কেনা কানের মাকড়ি- পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবার আগেই দিয়ে যাবে বলে। কিন্তু সে-পথে গেলো না কেউ- কেবলই পড়ে রইলো কয়েক খণ্ড নৈঃশব্দের পদাবলী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এই ট্র্যাজিডির সংবাদ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সে সময় জগন্নাথ হলে কোনো ছাত্র সংসদ না থাকলেও দ্রুতই উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেন তদানীন্তন ডাকসুর ভিপি আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মনসুরও দলের কর্মীদের নিয়ে এগিয়ে আসেন। হলের প্রভোষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ললিত মোহন নাথ চট্রগ্রামে থাকলেও পরদিনই ছুটে এসেছেন। এমনকি তৎকালীন স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ নাইরোবিতে কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনে থাকলেও তড়িঘড়ি ছুটে এসেছেন এবং পরে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লক্ষ টাকা করে প্রদান করাসহ পাঁচ তলা ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নির্মাণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। উনচল্লিশটি তাজা প্রাণের প্রাণের মূল্য নির্ধারিত হয় পাঁচ কোটি টাকা এবং ব্যক্তিগত স্নেহ-ভালোবাসার মূল্য এক লক্ষ টাকা!!
এখানেই যদি লেখাটি শেষ করি তবে বিবেকের দায় এড়ানো যাবে না। তাই লিখতে হবে আরও কয়েকটি অনুচ্ছেদ- আঁকতে হবে কয়েকটি নিষ্ঠুরতার মানচিত্র। এ ঘটনাটির পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছে, তার আগে তেমনটি ছিলো না। কেবল আঙুল চুষেই দিন কাটিয়েছে স্বৈরশাসক এরশাদের সরকার আর তার তাঁবেদার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জগন্নাথ হলের এই পরিষদ ভবনটির সংস্কারের জন্য একাধিকবার কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছিলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কিন্তু হয়নি। কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙেনি তখনো। ভবনটি সংস্কার করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যখন উদ্যোগ গ্রহণ করলো- তখন নিভে গেছে ৩৯ টি প্রাণের আলো। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠেছিলো- সরকার অযথাই অর্থ ব্যয় করে রাজপথ আলোকিত করে, আমলাদের মেদস্ফীতে সহায়তা করে- কিন্তু কী আশ্চর্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের কোনো নজরই নেই। এতো অবহেলা কেনো শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের প্রতি?
তবে ‘মানুষ’ কথাটির একটি গভীর তাৎপর্য আছে। এ তাৎপর্য যুগে যুগে কালে কালে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি সত্যের মঞ্চে, অবধারিতভাবে। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেদিন মানুষ নেমে এসছিলো রাস্তায়। উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছিলো। কেবল তাই নয়, আজও তাদের মাঝে কেউ কেউ আছেন যারা ১৫ অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। জগন্নাথ হলের নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতির মিনারে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পাঠক- জেনে আশ্চর্য হবেন, তাদের কোনো স্বজনই সেদিন মারা যাননি, এমনকি তাদের পরিবারের কেউ নেই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে বা করছে। তবুও তারা আসেন কেবল এই জন্য যে, সেদিনের সেই শোকের মিছিলে তারাও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার দাদু এমনই একজন মানুষ। তিনিও ছিলেন সেদিনের সেই উদ্ধার ব্রতে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. সামান্তলাল সেন। জগন্নাথ হলের ট্র্যাজিডির দিনে এই মানুষটির নেতৃত্বেই ঢাকা মেডিক্যালের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-চিকিৎসক-সেবিকা-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন আহতদের উদ্ধারে, সেবা-শুশ্রূষায় নিজেদের সবটুকু উজার করে দিতে। আর নাম না জানা সাধারণ মানুষ- যাদের কেউ হয়তো এসেছিলেন ঢাকা মেডিক্যালে সামান্য চিকিৎসার জন্য- তারাও সেদিন হাত লাগিয়েছিলেন, যেনো নিজের জীবনটুকু দিয়ে বাঁচিয়ে তুলবেন সবাইকে। সবার একটাই প্রত্যাশা- একটাই আকাঙ্খা- যেনো সবাই বেঁচে উঠেন। কিন্তু হায়- জীবন প্রদীপ যে নিভে গেছে অনেক আগেই।
নিহত শিক্ষার্থীদের নাম
- আশীষ কুমার হালদার
- বাবুল কুমার ঘোষ
- বিধান চন্দ্র বিশ্বাস
- গোপাল চন্দ্র কর্মকার
- জন শ্যামল সরকার
- কার্তিক চন্দ্র বালা
- নিরঞ্জন পাল
- অলোক কুমার কর্মকার
- অনুপম সাহা রায়
- অমোক কুমার সাহা
- অতুল চন্দ্র পাল
- পরিতোষ কুমার মিস্ত্রী
- রবীন্দ্রনাথ বাড়ৈ
- রণজিৎ কুমার মৃধা
- রশ্বিনী কুমার বর্মণ
- শিবনারায়ণ দাস
- ঠাকুরদাস দাস
- তুষার কান্তি দাস
- রণজিৎ কুমার রায়
- গোবিন্দ কুমার ভৌমিক
- মৃণাল কান্তি জয়ধর
- তপন কুমার মণ্ডল
- উত্তম কুমার রায়
- শান্তি প্রিয় চাকমা
- অসীম কুমার সরকার
- প্রতাপ চন্দ্র সাহা
নিহত অতিথিবৃন্দের নাম
- গোপাল চন্দ্র সরকার
- গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস
- তপন পাল
- তপন সরকার
- নিরঞ্জন ভৌমিক
- নির্মল চন্দ্র দাস
- পুলিন রায়
- বিনোদ বিশ্বাস
- মইনুদ্দিন
- মোঃ আবদুস সোবহান
- রতন মালী
- শুকদেব সরকার
- শৈশব রায়
- সুধাংশু শীল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবসটি এখন কেবল পঞ্জিকার পাতাতেই বন্দী। কয়েকটি সামান্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় এ দিনটির সব কথা। কারো যেনো জানবার আগ্রহ নেই, দেখবার আগ্রহ নেই- নেই একটু বোঝার আগ্রহ- কেনো এমন হলো, কী ঘটেছিলো সেদিন। এমনকি সেদিনের নিহতদের স্মরণে প্রকাশিত হয়নি কোনো পূর্ণাঙ্গ স্মারকগ্রন্থও। কেবল প্রচারের আলোতেই মেলে ধরতে চাইছি নিজেদের সবটুকু অজ্ঞতা আর অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে। জগন্নাথ হলের আয়োজনেও তেমন কিছুই নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!
বাস্তবিকই তাই। আগে বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষকগণকে রেজিস্টারের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি পাঠানো হতো- যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজন সম্বলিত সূচী থাকতো- কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। বিষয়টি এমন নয় যে, চিঠি পেলেই সকলের হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা দেয়- কিন্তু কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের স্বাভাবিক গণযোগাযোগের কাজটিও করছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক সৌজন্যের দীর্ঘ বিরতিতে নিহত ও আহতদের স্বজন ও পরিবারবর্গ অক্টোবরের শোক আয়োজনে আমন্ত্রিত হওয়া তো দূরে থাক, অনুষ্ঠানমালার স্বাভাবিক খবর পাবার প্রত্যাশাটুকুও ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সকল হল ইউনিটের অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিগত দিনগুলোতে তাদের নির্লজ্জ অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের ‘জগন্নাথ হল ট্যাজিডি’ নিয়ে লেখা ও গাওয়া বিখ্যাত গান ‘মরনসাগর পাড়ে তোমরা অমর তোমাদের স্মরি’ গানটিও এখন আর আগের মতো গাওয়া হয় না।
সব কিছু মিলিয়ে একটি গভীর বেদনার রেখা স্পষ্টত হয় হৃদয়ের সুদূর বন্দরে। এরপরও কথা থেকে যায়। মনে পড়ে যায় মানুষের কথা, জীবনের কথা। সেদিনের সেই মানুষগুলো- যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন নিঃস্বার্থে। আর যারা চলে গেছেন মরনসাগর পানে- তাদের জন্য হৃদয়ের গভীর প্রণতি, আর নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা- কারণ এখনও নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়, সেনাবাহিনীর বরাদ্দ বাড়ে- কিন্তু হায় জগন্নাথ হলের ছাদ ধসে মৃত্যুবরণ করা ৩৯ জন ছাত্রের পূর্ণ জীবন পরিচয় আর আলোকচিত্র নিয়ে কোনো গ্রন্থ পর্যন্ত প্রকাশ করা যায়নি। আমরা তো প্রতিদিনই লজ্জা পাই- তাই জানি এ লজ্জাও আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। হায় রে নির্লজ্জ জাতি।