বই না বলে গেরিলা অপারেশনের ম্যানুয়াল বলাই বরং ভালো— অন্তত আমার বিবেচনায়। তবে এই প্রচেষ্টা সম্মুখসমরে নয়, প্রজন্মের বিভ্রান্তিকর মগজে আর প্রায় ক্ষয়ে-যাওয়া মননের অলিতে-গলিতে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমরা বুঝি, গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের পায়ের তলার মাটি কেমন আলগা হয়ে গেছে। নরম পলিমাটির বদলে সেখানে ফাঁদ পেতেছে বিভ্রান্তির চোরাবালি। আশাবাদী অগ্রজেরা বলেন বটে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে, হয়তো ঠিকই বলেন তাঁরা; কিন্তু যে দেশটির বয়স এখন পঞ্চাশ, এখনও তার এমন দ্বিধান্বিত পদবিক্ষেপ আমাদের আশ্বস্ত করে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে, বইয়ের দিকে তাকালে, খবরের কাগজের নিয়মিত পাঠক হলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে বুঝতে পারি— এখনও এদেশে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস মানে ছাব্বিশে মার্চ আর ষোলোই ডিসেম্বরে পাওয়া দুটো ছুটির দিন। তাও শিশু-কিশোররা জানেন না কোনটা স্বাধীনতা দিবস আর কোনটা বিজয় দিবস— এ বিষয়ে তো ক বছর আগেও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। আমরা আফসোস করেছি, দুঃখ পেয়েছি এবং যেভাবে ইতিহাস ভুলে যাওয়াটা আমাদের জাতিগত অভ্যেস, সেভাবে ভুলেও গেছি। আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় দিবসগুলো পালনের সরকারি নির্দেশ রয়েছে এবং যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চালানো বিভ্রান্তিগুলোর একটি সুরাহা বর্তমান সরকার করেছে, ফলে বর্তমানের শিক্ষার্থীদের খানিকটা ইতিহাসনিষ্ঠ এখন না চাইলেও হতে হয়। কিন্তু এটুকুর জন্যই কি মুক্তিসংগ্রামটি হয়েছিল? ভাষার অধিকার, স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র কিংবা অসাম্প্রদায়িক সংবিধান এতোটাই সহজ ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে যতখানি তলিয়ে ভাবতে হবে, ততখানি সাঁতরাবার ক্ষমতা আমাদের কই? যে দীর্ঘ-ব্যাপ্ত সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাঙলাদেশ, সেই সংগ্রাম তো এখনও চলমান। যুদ্ধ শেষ হতে পারে কিন্তু সংগ্রাম তো শেষ হয়নি। স্বাধীন হয়েছি বটে কিন্তু গলা ছেড়ে মুক্তির গান তো গাইনি।
এই যে যুদ্ধ শেষ হলেও সংগ্রামটি আজও চলমান— এই বক্তব্য রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক বক্তব্যেরও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে যারা বিরোধিতা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে জেনোসাইডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিল— সেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রাজনৈতিক খুঁটি তো ধুলিস্যাৎ হয়নি। ফলে স্বাধীন দেশটি আমার— এই গৌরব যতখানি আছে; দেশটিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক অপশক্তি এখনও সক্রিয়, অতএব আমার সোনার বাংলা আজও নিরাপদ নয়— এই আশঙ্কাও আমার ততখানি। এ কারণেই চায়ের ক্যান্টিনের নির্দোষ আড্ডাতেও হঠাৎ করে পরিচিত মুখে উঠে আসে অপরিচিত বাক্যমালা— শহিদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ নাকি? বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন তো? এগুলো হলো গত পঞ্চাশ বছরের অপ-রাজনীতির রাজনৈতিক মিথ্যাচারের ফসল। এইসব রাজনৈতিক মিথ্যাচার আমাদের প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে নব্বইয়ের দশকে। শূন্য দশকেও তার জের আমরা টেনেছি। এখনও টানি। মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশকেই বলি— ‘এতই যখন দ্বিধা, তখন জন্মেছিলে কেন?’।
কিন্তু এইসব হাল ছাড়াছাড়ি আমাদের হয়; আমাদের যাঁরা অগ্রজ, যাঁরা জীবন বাজি রেখে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময়কে উৎসর্গ করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের জন্য— তাঁরা কিন্তু হাল ছাড়েন না। বরং দাঁতে দাঁত চেপে ঘড়ির বয়স্ক কারিগরের মতো তাঁরা ঠিক করে চলেন প্রজন্মের মগজের কলকব্জা। গত পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কয়টি অসামান্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, ঠিকঠাক বিবেচনা করলে আমরা দেখবো— তার সিংহভাগই ওই মুক্তিসংগ্রামের কারিগরদের লেখা। স্মৃতিকথায়, আত্মজীবনীতে, গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে কিংবা নিরীক্ষাধর্মী অ্যাকাডেমিক নিবন্ধে মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই আমাদের যোগান দিয়ে গেছেন সত্যের রসদ।
সেই হাজার হাজার পৃষ্ঠার রসদের মধ্যে আমি সাতাশি পৃষ্ঠার কথা বলবো বলে এই লেখাটি শুরু করেছি। মেয়ে বিচ্ছু: আজিমপুরের মুক্তিযোদ্ধা কাহিনি— ছোট্ট অথচ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থটির রচয়িতা বীর মুক্তিযোদ্ধা লিনু হক। যে সংগ্রামের মহাবাদলে আজ আমরা স্বাধীন দেশের পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে ঘুরি, তিনি সেই মহাবাদলের অংশ। যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতিচারণই এই বইটির মূল আখ্যান। বা বলা যেতে পারে এটি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিনু হকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড। আত্মজীবনীতে আমরা যেমন শুধু মানুষটিকে নয়, তাঁর সময়কেও পাই— তেমনি এই বইটিতেও ষাটের দশকের শেষদিকের উত্তাল ঢাকা শহরের প্রত্যক্ষ বর্ণনা পাই এবং সেই বর্ণনা একজন স্কুল শিক্ষার্থীর উপলব্ধিসিঞ্চিত। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্বে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস যেমন পাই, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তৎকালীন চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ডের সংবাদ ততটা পাই না। অথচ আমাদের আসা-যাওয়ার পথের মাঝেই চোখে পড়ে নবকুমার ইনিস্টিটিউট, চোখে পড়ে আজিমপুর কলোনী। কিন্তু তার ইতিহাস সন্ধানের সময় আমাদের হয়ে ওঠে না। উনসত্তরের উত্তাল ঐতিহাসিক দিনগুলোর নানা ঘটনাবহুল ইতিহাস খুঁজতে গিয়েও আমার অন্তত চোখে পড়েনি পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান:দেশ ও কৃষ্টি নামের বইটির বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের ইতিহাস। সেই অর্থে আমার জন্য শ্রদ্ধেয় লিনু হকের বইটি এই তথ্যের প্রথম সূত্র। তিনি নিজে যেহেতু এই আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী ছিলেন, তাই আন্দোলনের অনুপুঙ্ক্ষ ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন তথ্য-প্রমাণাদিসহ। বইটির এই অংশ পড়ার পর ইতিহাস জানার পাশাপাশি আরেকটি বোধদয় পাঠকের মনে হবার কথা। যে সময়টির কথা লেখক উল্লেখ করেছেন, তখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জেল-জুলুম আর অত্যাচার চালিয়ে বাঙালির অবিনশ্বর আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল; কিন্তু ওই রক্তচক্ষুকে না ভয় পেয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষার্থীরা, না তাঁদের অভিভাবকরা। কিন্তু স্বাধীন দেশে অনেকবার পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি ঢুকানো হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছে, নিকট অতীতে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণও করা হয়েছিল— কিন্তু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরা তার কোনো প্রতিবাদ তো করেনইনি, সেটা যে করা যায়— সম্ভবত সে ভাবনাও তাদের আসেনি। আমাদের প্রজন্মও এই পাপের ভাগীদার। আমাদের মনে পড়ে না স্কুলে কোনোদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-সম্বলিত পাঠ্যপুস্তকের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেছিলাম। বরং কয়েকটি নম্বরের লোভে পরীক্ষার খাতায় মিথ্যাচারই করেছিলাম। সম্ভবত এ কারণেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো অবিনাশী কোনো সংগ্রাম রচনা করা সম্ভব নয়। লিনু হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা পেরেছিলেন, কেননা তাঁদের মনন আর বোধের আকাশটা ছিল অবারিত, মেরুদণ্ডকে শান দেবার মন্ত্র তাঁদের জানা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর ইতিহাস-চিত্র বা বর্ণনা পাই বিভিন্ন গ্রন্থে-নাটকে-চলচ্চিত্রে। কিন্তু এই অবরুদ্ধ দিনগুলো আক্ষরিক অর্থেই কেমন ছিল, সেটি সুস্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ আমাদের কম। কারণ অধিকাংশ গ্রন্থেই মৃত নগরীর কথা আমরা জানি কিন্তু সেই মৃত্যুপুরীর ভেতর থেকে যে ফিনিক্স পাখির মতো গেরিলা অপারেশন হয়েছে— মেয়ে বিচ্ছু: আজিমপুরের মুক্তিযোদ্ধা কাহিনি বইটি তার প্রামাণ্য দলিল। কেবল অপারেশনের বর্ণনাই নয়, সহযোদ্ধাদের নাম, তাঁদের ভূমিকা প্রত্যেকটি ঘটনাই সবিস্তারে তুলে এনেছেন লিনু হক। এতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন, বিশেষত যাঁরা জেনোসাইড সংক্রান্ত গবেষণার জন্য কথ্য-ইতিহাসের অনুসন্ধান করেন, তাঁরা অনেক তথ্য এবং জীবন্ত তথ্যসূত্রের হদিশ পাবেন। কারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা লিনু হক এবং তাঁর সহযোদ্ধারা যেহেতু তখন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী ছিলেন এবং প্রত্যেকেই প্রায় সমবয়সী, সুতরাং তাঁদের স্মৃতিগুলো এখনও জীবন্ত।
আরেকটি দিক হলো, ঢাকা শহরের গেরিলা তৎপরতা নিয়ে যে নথিপত্রগুলো আমরা পাই, তাতে আজিমপুর বা তৎকালীন অন্যান্য কলোনি বাসিন্দাদের গেরিলা তৎপরতার সূত্র থাকে না। সে হিশেবে এই বইটি ঢাকার আজিমপুর কলোনির বাসিন্দাদের গেরিলা তৎপরতা ও তাঁদের যুদ্ধকালীন জীবনযাপন জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
বইটির নাম থেকেই বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে কিশোরীদের অংশগ্রহণ ও তাঁদের গেরিলা কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ এখানে আছে। এই দিকটি নিয়ে একটু কথা বলা প্রয়োজন, কেননা এখনও মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন ‘স্বনামধন্য’ গবেষকগণ তাঁদের বইপত্রে বা লেখায় এইটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, নির্যাতিত হওয়া ছাড়া একাত্তরের নারীর আর কোনো নিয়তি ছিল না। অথচ আমরা জানি, আমাদের মুক্তিসংগ্রামে কী অসামান্য বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন বাঙলার নারীরা। সম্মুখ সমর থেকে শুরু করে চিকিৎসাকেন্দ্র, গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীসংস্থা থেকে শরণার্থী শিবির— প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল কিংবদন্তীতুল্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাঙলায় আর কোনো প্রজন্মের নারীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের নারীদের মতো মেধা-মনন-প্রজ্ঞা-সাহস-ব্যক্তিত্বে এভাবে আকাশ ছুঁতে পারবেন না। অথচ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নারীদের অবদান এখনও মার্জিনের মন্তব্যের মতোই রয়ে গেল, এখনও তা পাদটীকাতেই স্থান পায়। যদিও গত কয়েক বছরে এই অচলায়তনটি ভেঙেছেন বেশ কয়েকজন গবেষক। কিন্তু কিশোরীদের অংশগ্রহণের নজির সম্ভবত এই বইটিতেই প্রথম। সে হিশেবে এই বইটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে হীরকখণ্ডসম।
বইটি প্রকাশ করেছে অঙ্কুর প্রকাশনী। প্রকাশনীর সত্বাধিকারী নিজেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বইটি শুরু হয়েছে লিনু হকেরই সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মলি আহমেদের স্বাধীনতার অনলপ্রভা শিরোনামের নাতিদীর্ঘ প্রারম্ভিকা দিয়ে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরীন আখতার। দুজনের কথাই মূল গ্রন্থে বিভিন্ন ঘটনার বিবরণে বেশ কয়েকবার এসেছে। আমাদের প্রজন্মের সাক্ষী হিশেবে আছেন ইরেশ হক— লিনু হকের আত্মজ— কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা মায়ের কৈশোর মানসপটে মুক্তিযুদ্ধের একটি দশককে তিনি দেখেছেন আমাদের প্রজন্মের একজন হিশেবে।
মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে, শিল্প হাতে যুদ্ধ করেছেন; যুদ্ধ-পরবর্তী বাঙলাদেশে তাঁরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বই— ইতিহাসের সুবর্ণ স্মারক— আমাদের সুদূর যাত্রাপথের সবচেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক সম্বল। এখন এই অমূল্য সম্পদ আমরা ধারণ করতে পারবো কিনা— সে প্রশ্ন আমাদের নিজেদের কাছেই করতে হবে।