লেখার কতোটুকু ফরমায়েশি আর কতোটুকু আয়েশি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া ভার। তবে এর মাঝেও একটি সান্ত্বনা এই যে- মানুষ কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রত্যাশা করে না। যেমন, ছোটোগল্প আসলে কতো ছোটো? কিংবা মনেরও কি মন আছে? তাই লেখা যেমনই হোক- তার উৎসমূলের হিসেব খুঁজতে যাওয়াটা বোধ হয় উচিত হবে না- কারণ এটি রবীন্দ্রনাথের লেখা নয় যে- এর পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট কারণ থাকবে, কিংবা কোনো অসীম ভালোলাগার মাত্রাকে মাত্রাহীন ছন্দে প্রকাশ করা যাবে।
আমার এ লেখাটা ‘নিতান্ত’ই। আরও পরিস্কার করে বললে হয়তো অপরিশীলিত ভাবনার পরিস্ফূটনান্মোখ কলি। আমি লিখতে ভালোবাসি- কারণ ওই সময়টাতে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি। আমি যদি টেনিসনের মাতাল লোটাস ইটারও হই- তবুও আমি তখন ধরা পড়ি নিজের আয়নায়। বস্তুত এ কারণেই প্রত্যেক মানুষকে লিখতে বসা উচিত। একবার লিখতে বসলে- একবার স্বপ্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে- জীবনের কোনো মঞ্চেই আর কোনো দৃশ্য মঞ্চায়নে বাদ পড়বে না। এমন একটা কথা কি এতো সহজে বলে দেয়া যায়? এটা কি এক ধরণের সিদ্ধান্ত নয়? আমি কি জীবন সম্বন্ধে এতো কিছু জানি যে- আজকাল সিদ্ধান্ত দিয়ে বেড়াবো? ব্যাপারটা যেমনই হোক- লিখতে পারাটা এবং নিয়মিত লেখাটা- এ দুই এক কথা নয়। আমাদের দেশে অনেক মানুষই আছেন ভালো লিখতে পারেন, কিন্তু নিয়মিত লেখেন না। তাতে কি খুব লাভ হলো? ভালো কিছু লেখার সুন্দর নির্যাস থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম; আবার যারা নিয়মিত লেখেন- তারা তো না চাইতেও সাধকের মর্যাদা পান- ফলে গড়ের মাঠে তারাই গোল দিয়ে বেড়ান। এই ধরুন, জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কথাই ধরা যাক- তিনি যেমন জানতেন, তেমনি বলতেন- কিন্তু লিখতেন না। তাই তাঁকে পেতে হলো আহমদ ছফা এবং হুমায়ূন আজাদের হাত ধরে। আর ব্যক্তি মাত্রেই চিন্তার ক্ষেত্রে না-চাইলেও নিজানুগামী। ফলে চাইলেও পুরো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে আমরা পেলাম না। তাঁকে পুরোটাই পেতে হবে- এমন কথাও আমি বলছি না। তবুও তো সিকি আনা পাই- তা-ও তো পেলাম না।
আবার হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনের কথাই যদি ধরি। সাহিত্য মান বিচারে যদিও দুজনে এক নয়, তবুও কিন্তু তাদের উভয়ের সাহিত্য সাধনায় মিল আছে। আর সেই মিলটি হলো- দুজনের সাহিত্যমানই জনপ্রিয় ধারার। এই দুজনকেই যদি তাঁদের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে বলা হয়- তাহলে দুজনেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে- তাঁদের সাহিত্য জনপ্রিয় ধারার। এখন জনপ্রিয় হলেই যে সাহিত্যমান নেমে যাবে, এমন কথা নেই; আবার জনপ্রিয় নয় বলেই একটি সাহিত্য বিরাট মাপের- সেটাও বলা অনুচিত। তাই যে কোনো বিচারে লেখা এবং লেখার অভ্যাস থাকাটা একটি অসাধারণ গুণ। সবার মধ্যে যদিও অভ্যেসটা নেই- তবুও সবার মধ্যেই রয়েছে এর আগুন।
লেখা কেমন হয়? এই আমাকে দেখলেই বোঝা যায়- লেখা কেমন হয়। একটি বিকেল, শ্রেষ্ঠ বিকেল কিংবা বিকেলের হাজার প্রতিরূপে খুঁজে পাওয়া কল্পনার মানুষী কেমন হবে- এ নিয়ে কতো দীর্ঘ এক ফিরিস্তিই না দিতে হলো আমাকে। এতোটা ফিরিস্তি কী সব লেখাতেই দিতে হয়? নাকি লেখা ভেদে লেখার ফিরিস্তি নির্ভর করে। হয়তো। কিন্তু এর মাঝেও একটি দূরদর্শিতা আছে। এই দূরদর্শিতার উপর জীবনের অনেক কিছুই নির্ভর করে। জীবনের রঙ, আলো, ছায়া, কায়া কিংবা বিলাপ অথবা বিলাপের বিলোপ- সবকিছু এ দূরদর্শিতার মাঝেই নাকি নিহিত। তাই তো মানুষ লেখেন মানুষের আত্মতৃপ্তির জন্যই কেবল নয়- তার বলিষ্ঠ আগামীর জন্যেও । মানুষ স্মৃতি রোমন্থন করেন, নস্টালজিক হয়ে উঠেন অথবা জীবন যাপনের পঙক্তিমালায় খুঁজে নেন এক দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। এই ব্যবস্থা থেকেই আমরা পেয়েছি আমাদের সাহিত্যের অনেকগুলো পথ। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি, কিংবা অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে-প্রবাসে– এসবই সেই স্মৃতিকে মনের মণিকোঠায় তুলে রাখবার জন্য। লেখা তাই ভালোলাগার যতোটুকু, ভালোবাসার ততোটুকু- এবং নিঃসন্দেহে তা আপনার বৃত্তে নানা মাত্রায় পর্যবসিত।
‘একটি বিকেল’- আমি কী জানি সে বিকেলের রঙ কী? এ্যালেন পো জানতেন- তার সময়ের শ্রেষ্ঠ বিকেলের রঙ? কিংবা জীবনানন্দ? যিনি পথের দু ধার থেকে তুলে নিতেন সৌন্দর্যের টুকরো টুকরো সেলুলয়েড- তাঁরা কেউ কী জানতেন- তাঁদের শ্রেষ্ঠ বিকেলের রঙটি কী?
জানতেন না। অথচ কী নিবিড় তাঁদের উপলব্ধি, কী অসীম তাঁদের ভালোলাগা, কী অসামান্য তাঁদের স্বপ্ন গাথা। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি তাঁদের মতো, তাই শ্রেষ্ঠ কোনো বিকেলের সন্ধান আজও মেলেনি আমার। কথাটি শুনে কি চমকে উঠলেন সবাই? বা আমি নিজেও? আমার কী মনে হলো আমি মিথ্যে বলছি?
বিকেলের কোন রঙে আমি ভালোবাসবো বিকেলকে? যেখানে আমার স্বপ্ন সাধনার প্রতিটি উপখ্যান হয় বিসর্জিত, যেখানে আমার ভালোলাগার ক্যানভাসে পড়ে শকুনের ছায়া, সেখানে আমি কী অচেনা নই? সেখানে আমি কী অপাঙতেয় নই? আমার সবটুকু ভালোলাগার ভেতরে পুঞ্জীভূত আছে আমার স্বপ্ন সাধনার বিলাপ। আমি চাইলেও তাকে অতিক্রম করে যেতে পারছি না। আমি পারছি না একটি শ্রেষ্ঠ বিকেলের স্বর্গ-কুঠুরিতে নিজেকে আটকে রাখতে। আমি কেবলই পেছনে পড়ে রয়েছি। পেছনে, খুব পেছনে।
কিন্তু কেনো? ভেবে পাই না আমি তার একটি কণাও। মনে পড়ে কতো হাজার বছরের মানব সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছি আমি। ‘সভ্যতা’! উচ্চারণ করতেই কোথায় যেনো রণদুন্দভি বেজে উঠলো। কারা কারা যেনো প্রতিবাদের আক্রোশে ফেটে পড়লো, কে কে যেনো চিৎকারে স্লোগানে আলোড়িত করলো দশদিক- ‘সভ্যতা’ মানি না, মানবো না। আমিও ভেঙে পড়ে রইলাম; একবার সচকিত হয়ে শুনতে চাইলাম কে কী বলে- তারপর আবার পড়ে রইলাম- নিতান্ত অবহেলে- নিজের কাছেই যে অবহেলার কোনো জবাবদিহিতা নেই।
সভ্যতা আজ কোথায়? অন্তত আমি তো কোথাও সভ্যতার কানাকড়িও দেখি না। কেবল শয়তান দেখি, নেমেসিস দেখি। দেখি নেমেসিসের সুন্দর বিনাশী আগ্রাসী জিভ। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই, আমি আহত হই। আমার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি যেনো রুদ্ধ হয়ে আসে। কে বা কারা যেনো আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরে। আমি কোনো শব্দ করতে পারি না, কেবল গোঙানির মতো শোনায় সবকিছু।
তবুও লিখতে হবে শ্রেষ্ঠ বিকেল নিয়ে। স্বপ্ন না থাকুক- কেবল হতাশা থাকুক, সাধ না থাকুক, কেবল অপ্রাপ্তি থাকুক, প্রত্যয় না থাকুক, কেবল প্রতারণা থাকুক- তবুও এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। সামনে কোথায়! সেখানেও তো অন্ধকার।
হঠাৎ আলো এসে কড়া নাড়ে দরজায়। নষ্ট পুঁজ আর রক্তের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে আমিও ক্লান্ত। আলোর ইশারায় সাড়া দেইনি কতোবার, কতো দূর থেকে আলো এসে কড়া নেড়ে গেছে- আমি ফিরেও তাকাইনি একবার। আজ হঠাৎ আলো এসে ডাকছে আমায়। আমায় ডাকছে। আমি তারে পারি না এড়াতে।
একটি শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প শোনাতে গিয়ে আমি এ কি শোনালাম আপনাদের। আমি তো আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রীদের মতো বহু অন্ধকার পার হয়ে আসিনি, আমি কেবল অন্ধকারে পড়ে ছিলাম- স্থির, নিথর, পাথর হয়ে।
ওল্ড ট্যাস্টমিনের পাতা থেকে হঠাৎ ডাক আসলো। লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট। আমি প্রস্তুত হলাম স্বপ্ন পথের আলো সাজাবার জন্য। পেলামও। আমি শ্রেষ্ঠ বিকেলের জন্য তৈরি হলাম। হাতে হাত রাখলাম সময়ের। দূর থেকে ভেসে আসা কোনো এক সস্নিগ্ধ কণ্ঠে কান পাতলাম। সেখানে ঘুম জাগানিয়া গান। শত-সহস্র মানুষের মিলিত কলস্বর। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ের তলায় তখন হাজার বছরের পলিমাটি। আমি দাঁড়িয়ে আছি এক প্রত্যয়দীপ্ত সাহসী ব-দ্বীপে। চারদিকে সবুজ- মাঝখানে আমার স্বপ্নের লালফুল।
একটি শ্রেষ্ঠ বিকেল কী আশ্চর্য মহিমান্বিত সৌরভে ঠাঁই করে নিয়েছে এক সংগ্রামমুখর ব-দ্বীপে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ক্ষুদ্র পলিমাটির ব-দ্বীপটির নাম বাঙলাদেশ।
আমি শ্রেষ্ঠ বিকেলটি খুঁজে পেয়েছি। এবার তার গল্প শুনবে তোমরা?
ফিরে যাও একাত্তরে। ফিরে যাও একাত্তরে। ফিরে যাও একাত্তরে।