একটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিতে ঐ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারিত হয়। দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাই একটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে। তবে বিগত ৫ বছরে সম্ভবত এ বিতর্কের সবচেয়ে নেতিবাচক রূপ পরিগৃহীত হয়েছে। বিষয়টি এমনভাবে আসছে যে এখন শিক্ষাব্যবস্থাতে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। তাই পরীক্ষাটি নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা থাকে। এ প্রত্যাশা যে কতোটা গভীরে তা বোঝা যায় তাদের ফলাফল প্রকাশের দিন। তারা এই দিন সম্ভবত তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটি করে। টেলিভিশন, পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিই তার প্রমাণ। কিন্তু বর্তমান সময়ে সে আনন্দের অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। তার একটাই কারণ, পছন্দানুযায়ী কলেজে ভর্তি হতে না পারা। কলেজ জীবন নিয়ে একজন শিক্ষার্থীর নানা ধরনের স্বপ্ন থাকে, ফলে একেক জনের পছন্দের তালিকাতেও থাকে দেশের নামকরা একেকটি কলেজ। কিন্তু কলেজে ভর্তিটা যখন মেধাভিত্তিক না হয়ে, বয়সভিত্তিক হয়, তখন একে কলেজ ভর্তি না বলে মেধাবীদের সঙ্গে উপহাস বলা যেতে পারে।
২০০৩ সালে জিপিএ এর ভিত্তিতে কলেজ ভর্তি করার সিধান্ত যখন নেয়া হয়েছিলো, তখনই এর প্রতিবাদ করেছিলেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বিভিন্ন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তৎকালীন সরকার ব্যবস্থায় থাকা অজ্ঞরা বিষয়টি যেহেতু বুঝতে পারেনি; ফলে মহামান্য আদালত রায় দিয়েছিলেন একটি অদূরদর্শি ও বিতর্কিত বিষয়ে, যা বর্তমানে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে এখন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জগদ্দল পাথর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে জিপিএ-৫.০০ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বয়স হয়ে উঠেছে পরিমাপক, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। বয়সের ভিত্তিতে কলেজ ভর্তির পক্ষে কোনো একটি কারণও দেখানো সম্ভব নয়; যা কিনা শিক্ষার্থীদের জন্য, দেশের জন্য ইতিবাচক।
সম্প্রতি বিভিন্ন খবরের মাধ্যমে জানা গেছে বয়সের ভিত্তিতে কলেজ ভর্তি করলে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসের শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজগুলোতে পড়বার সুযোগ পাবে, কিন্তু কম বয়সেও যারা একই ফলাফল করেছে, তাদের ঠাঁই হবে না নামকরা কলেজগুলোতে। ফলে একদিকে যেমন বাড়বে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের বেশি বয়েসের শিক্ষার্থীদের ভালো কলেজে আনাগোনা, যা কিনা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভব ছিলো না কখনো; অন্যদিকে প্রকৃত মেধাবীদের বিভিন্ন বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়তে হবে অধিক বেতন দিয়ে। এতে লাভ হচ্ছে দুইটি শ্রেণির। এক, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর এবং দুই, অবকাঠামোগত দিক থেকে দুর্বল বেসরকারি কলেজগুলোর।
এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বর্তমান যে নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থা, তা ধ্বংস হতে আর বেশিদিন লাগবে না। ফলে দেখা যাবে অধিক বয়সী, যারা কিনা নানাবিধ দুর্বলতার কারণে একই শ্রেণিতে একাধিকবার পড়েছে, শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজে থেকে সে কলেজগুলোকে ধ্বংস করছে, নষ্ট করছে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে; অন্যদিকে প্রকৃত মেধাবীরা কম বয়সে কিংবা সঠিক বয়সে ভালো ফলাফল করেও পছন্দ অনুযায়ী কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। তাই সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাবো, বিষয়টি বাতিল করে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বা মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজ ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। তা না হলে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দায় সরকার এড়াতে পারবে না।