প্রকৃতিতে তখন শরতের ছোঁয়া, চারিদিকে কাশবনের অবাধ্যতা। আমরা চারজন হেঁটে চলছি; গন্তব্য কান্তনগর মন্দির। স্থানীয় লোকজন অবশ্য একে কান্তজির মন্দির নামেই চেনেন। ইটের তৈরি অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দিরের সামনে এস অবশেষে আমরা দাঁড়ালাম। দূরত্ব হিসেবে দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতুলিয় সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর অপর পাড়ে নিভৃত গ্রামে এ মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের ঐতিহাসিক গভীরতার সঙ্গে গ্রামীণ নির্জনতা যেনো এক ছত্রে বাঁধা পড়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় এ মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হলো পৌরাণিক কাহিনীর পোড়ামাটির অলঙ্করণ। এ ‘নবরত্ন’ বা ‘নয় শিখর’যুক্ত মন্দিরটির চূড়া হতে আদি নয়টি শিখর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
মন্দিরের নির্মাণ তারিখ নিয়ে যে সন্দেহ ছিলো তা দূর হয় মন্দিরের পূর্বকোণের ভিত্তি দেয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত সংস্কৃত ভাষায় লেখা কালানুক্রম জ্ঞাপক একটি শিলালিপি থেকে। জানা যায় দিনাজপুরের মহারাজ প্রাণনাথ ১৭২২ সালে এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তার পুত্র মহারাজ রামনাথ ১৬৬৪ শকাব্দে (১৭৫২ সালে) মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া মন্দিরটির পুনর্গঠনের জন্য কাজ করেন মহারাজা গিরিজানাথ বাহাদুর।
বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণের উপর স্থাপিত। এর চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান। বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারত নির্মিত হয়েছে। পাথরের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো মন্দিরটির উচ্চতা ৫০ ফুটের চেয়েও বেশি। মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আমরা খুঁজে পাই কানাইলাল সেনকে, যিনি মূলত এ মন্দিরটির সামগ্রিক দেখাশোনা করে থাকেন। কথা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলাম, মন্দিরের গায়ের পৌরাণিক কাহিনী প্রসঙ্গে। তিনি জানালেন, ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে সমগ্রটা। তার সঙ্গেই হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের পৌরাণিক গল্প শুনতে লাগলাম। মূলত তিনটি পর্যায়ের পৌরাণিক গল্প এখানে স্থান করে নিয়েছে। এর অবলম্বনে মনুষ্য মূর্তি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলী বিস্ময়করভাবে ফুটে উঠেছে। মহাভারত ও রামায়ণের বিস্তৃত কাহিনী এবং অসংখ্য পাত্র-পাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে। কৃষ্ণের নানা কাহিনী এবং সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবির মূর্ত প্রকাশ এখানে চোখে পড়ে। পোড়ামাটির এ শিল্পগুলোর বিস্ময়কর প্রাচুর্য এখানে চোখে পড়ার মতো। মন্দিরের বাইরের দেয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণের যে সাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে চারিদিকের ভিত্তিস্তরের নিম্নাংশের কাজগুলো সমান্তরালে প্রকাশ ঘটেছে। এ ধরনের টেরাকোটা কর্ম উপমহাদেশে এটাই একমাত্র।
সমগ্র মন্দিরটি ঘুরে দেখলে এবং গভীরভাবে চিন্তা করলে পুরো মন্দির থেকে পৌরাণিক সমাজবাস্তবতার একটি ধারণা পাওয়া যায়। ছোটো ছোটো সৈন্যদলের গায়ে ইউরোপীয় পোষাক, খোলা তলোয়ার ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় এগিয়ে আসা, কৃষ্ণমূর্তির লৌকিক অবয়ব, কবল্লপীড়ার ধ্বংস, অশোক বনে সীতার বন্দি জীবন- এ সবকিছু মূলত একটি দৃশ্যপটে ফুটে ওঠা ইতিহাসের নৈবেদ্য। তবে মন্দিরের দক্ষিণমুখে কিছু বিভ্রান্তিকর দৃশ্যসহ রামায়ণের কাহিনী বিধৃত রয়েছে। এ মন্দিরের আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এতে কামদ দৃশ্যাবলীর সংযোজন ঘটানো হয়নি, যেমনটি দেখা যায় উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ ভারতের মন্দিরসমূহে। কান্তজীর দেয়ালে যে পোড়ামাটির অলঙ্করণ তার অধিকাংশই তৈরি হয়েছে হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটিতে লালিত শক্তির ভেতর থেকেই। তাই এ দেশের ইতিহাস ও ঐশ্বর্যের বিকাশ ছিলো কান্তজীর মন্দিরের সকল শিল্পে।
মন্দির প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানোর সময় একটি ফলক চোখে পড়লো, তাতে লেখা ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এ মন্দিরের উন্নয়ন কর্ম। কিন্তু সে উন্নয়ন কর্মের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না আমরা। যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা করুণ এবং এতোসব কষ্ট সহ্য করেও যারা মন্দির দর্শনে আসছেন, তাদের কেবল মন্দিরের স্থাপত্য নিদর্শনেই সন্তোষ্ট থাকতে হচ্ছে, কেননা এখানে মন্দিরের এ মূল্যবান ইতিহাস সমৃদ্ধ কোনো গ্রন্থ নেই, নেই কোনো স্মৃতি ফলক। কেবল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানা ঘোষণার নির্লজ্জ ফলক আর চারদিকে তার ব্যর্থতার ছাপচিত্র।
মন্দির ভ্রমণ শেষে আমরা যখন ফিরে আসছিলাম, তখন কানাইলাল সেন বেশ কাতর নয়নে তাকিয়ে রইলেন। বুঝতে বাকি থাকলো না, তিনি কী চাইছেন। জানতে চাইলাম, তিনি কেনো এখানে থাকেন। উত্তরে বললেন, কোনো বেতন বা ভাতা তিনি পান না, কেবল মানুষ, যারা মন্দির দেখতে আসে, তারা খুশি হয়ে কিছু দেন, তা দিয়েই তার চলতে হয়। ফিরে আসার পথে শেষবারের জন্য যখন পেছন ফিরে তাকালাম, তখন মনে হলো, বিস্তৃত ইতিহাসে সমৃদ্ধ মন্দিরটি যেনো এখন ঐতিহ্যের ভারে ন্যুজ্জ্ব আর তার শীর্ণ কাঠামোর ভেতরের যে ক্ষীণ আলো তাতে দেখা যায়, “১৯৬০ সালে ইহার উন্নয়ন কাজ বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত হইল”।