আমার কী নাম?
নামফলক দেখে হয়তো বলে দিতে পারবে অনেকেই। কেউ কেউ কপাল কুঁচকে বলবেন- পাথরের আবার নাম! জড় পদার্থের নামের কী দরকার?
কিন্তু আমি কি কেবলই জড় পদার্থ? কেবলই কি এক অসাড় চলৎশক্তিহীন পাথর আমি? কেউ কী কখনো আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার ফিরে তাকিয়েছো? একবার ভেবে দেখেছো- আমি আসলে কথা কইতে জানি, আমিও ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’।
তোমরা হাসছো? হেসো না। আমার মনেও অনেক কথা জমে আছে। আমি তোমাদেরই নিত্য সঙ্গী- তোমাদের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া, আড্ডা আর ভালোবাসার নিত্য সহচর।
আমার কিন্তু দুইটি নাম। এক অংশের নাম মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি- অন্য অংশের নাম একাত্তরের গণহত্যা। এই দুই অংশ মিলে আমি এক নিটোল অহঙ্কার। আমায় গড়েছেন ভাস্কর রাশা। কেনো গড়েছেন জানো?
এর এক ইতিহাস আছে। সুদূরবর্তী এক অলোকসামান্য ইতিহাস। আমার ইতিহাসের নাম একাত্তর- প্রেক্ষণে তাঁর বাঙালির অনির্বাণ অগ্নিশিখা।
তোমাদের অভিধানে ভয়, আর্তনাদ, হত্যা- এই শব্দগুলো আছে? তোমরা কী জানো- কেমন করে একটি নিবিড় সভ্যতাকে গলা টিপে হত্যা করতে হয়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা পড়েছো তোমরা? তোমাদের শান বাঁধানো মেধার ঘাটে যে জ্ঞানের বহর এসে ঠেকে এতে জেনোসাইডের কী অর্থ ধরা পড়ে- আমি জানি না; কারণ জেনোসাইড শব্দটিকে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে উননিশশো একাত্তর সালে। খুঁজে আনতে হবে পঁচিশে মার্চের কালো রাতকে- বিভৎসতার অভিধান ঘেঁটে খুঁজে আনতে হবে পৃথিবীর এক জঘন্যতম শব্দ ইয়াহিয়া খানকে। এরপর তোমাদের গণহত্যার পাঠ শুরু। হিটলারের গ্যাস চেম্বারে তোমরা যে জেনোসাইডের বিবরণ পাও; কেবল ওটুকু নয় জেনে নাও একাত্তরের জেনোসাইডের ইতিহাস। হাজার হাজার নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো- কেবল স্বাধীনতা চেয়েছিলো বলে। আজ তোমাদের পদভারে মুখরিত যে ক্যাম্পাস- যেখানে বসে তোমরা তোমাদের স্বপ্নের সাতকাহন সাজাও; সেখানেই সেদিন নেমে এসেছিলো পাক হানাদারের বর্বরতা। তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো তারা। গুলিবিদ্ধ শরীরের মৃত্যু নিশ্চিত করেছিলো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রান্তরে তোমরা হেঁটে যাও; যেখানে তোমরা তারুণ্যের প্রাণচঞ্চলতায় মুখরিত করো দশদিক- সেইখানে সেদিন বয়ে গিয়েছিলো রক্তের ধারা। লাল রক্ত; কী গভীর লাল- কী নিবিড় রক্তিম; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি সেদিন রঞ্জিত হয়েছিলো সূর্য সন্তানদের উষ্ণ রুধিরে। একটি একটি করে প্রাণ চলে যাচ্ছে- বিদীর্ণ হচ্ছে মহাকাশ; মহাকালের বর্বরতায় পাকিস্তানি বাহিনী হয়ে উঠেছে অপ্রতিদ্বন্ধী। ছাব্বিশে মার্চ ভোরে যখন ফজরের আযান পড়লো, সবে মাত্র সূর্য উঠলো- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি তখন পিকাসোর ক্যানভাস। একেকটি মৃতদেহ যেনো একেকটি চেতনা- কোনো নাম নেই; শিরোনামহীন, অসংজ্ঞায়িত এবং নিশ্চিতভাবেই অপরাহত।
সেই ইতিহাস ধারণ করে আছি আমি- আমার বক্ষে। ভাস্কর রাশা আমার একাংশে সে-ই গণহত্যাকে তুলে ধরেছেন- তোমাদের জন্যে, তোমাদের চেতনার জন্যে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যে জাতির বোধের শিকড় প্রোথিত আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত সংসারে- সে জাতির আখ্যানে মৃত্যু কখনোই শেষ কথা নয়; কোনো দিন না। তাই আলোর বৃন্ত থেকে স্বাধীনতার বয়ে আনবার দুর্নিবার প্রত্যয়ে বাসা বেঁধেছিলো সে-ই অজেয় বাঙালি, দুর্মর যার পরিচয়, কেবল লড়াই তার শ্রেষ্ঠ এপিক- বাঙালি এ কথা জানিয়ে গেছে সারা পৃথিবীর সভ্যতাকে- একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে। তাইতো পঁচিশে মার্চের ক্র্যাক-ডাউনের পরও মাত্র নয় মাস, মাত্র দুইশত ছেষট্টি দিন- এতেই বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি। লড়াই কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলো- তা কিন্তু নয়; তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা সেদিন লড়াই করেছিলো দেশীয় দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের বিরুদ্ধেও। তাই সংগ্রামের গতিধারা ছিলো পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতোই খরস্রোতা, তীব্র আর আলোভিমুখী। সেই ইতিহাসও খুঁজে পাবে- আমার মাঝেই আছে তার গভীর প্রত্যয়। দেখো আমার আরেক অংশ- নাম তার ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’। এ যেনো এক অপূর্ব সনেট- অষ্টকে তার ভাবোন্মোচন; ষষ্ঠকে তার আলিঙ্গন।
আমার প্রত্যয় তাই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে প্রসারিত- নৈঃশব্দ নিবাসী বিপ্লবের মতো। আমার উপস্থিতি তাই এক অনিবার্য সত্য- সাত কোটি বিপন্ন কোকিলের কণ্ঠস্বরে যে সত্য উচ্চারিত হয়েছিলো, জর্জ হ্যারিসনের গিটারের মতো.. ..‘বাঙলাদেশ বাঙলাদেশ.. ..’ ধ্বনিতে-সুরে সে-ই মহার্ঘ চেতনা বাসা বেঁধেছিলো বাহাত্তরের সংবিধানে, নির্ধারণ করেছিলো জাতির মৌলিক অধিকার। অতএব তোমরা আমাকে যতোই পাথর ভাবো না কেনো; যতোই ভাবো না কেনো আমি কেবলই এক জড়বস্তু- কোনো উত্তাপ নেই আমার- এ তোমাদের এক ভুল ধারণা।
তবে আমিও কষ্ট পাই- ওই যে তোমরা সকলে মিলে পড়ো না- ট্র্যাজিডি; গ্রীক ট্র্যাজিডি, শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজিডি- আমি সে-ই ট্র্যাজিডি। উত্তাপ ধারণ করি, মাঝে মাঝে লজ্জিত হই- কিন্তু বলতে পারি না কিছুই। কেবলই শূন্যতার প্রতিরূপ।
নিজেকে অক্ষমও মনে হয় মাঝে মাঝে। যখন দেখি ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা চাপা পড়ে যায় সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাসে, যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নগ্ন উল্লাসে মাতে একাত্তরের পরাজিত হায়না, যখন বিদেশী বণিকের হাতে চলে যায় আমার রক্তস্নাত শিক্ষাব্যবস্থা- তখন লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে আসতে চায়; কিন্তু তবুও আমি চেয়ে থাকি- অবিচল চেয়ে থাকি; ভাস্কর রাশার হৃদয় নিকেতনের কাব্য আমি- অবিচল চেয়ে থাকি।
আমি তবুও মাথা নওয়াই না- কারণ সুকান্ত আমায় জানিয়ে গেছে- বাঙালি মাথা নোয়াবার নয়।