চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধের হিসাব অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন। এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে কোনো একটি প্ল্যাটফর্মে ক্রমাগত সক্রিয় রাখার ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসে আর নেই। হয়তো ডিজিটাল দুনিয়ায় ভবিষ্যতে এমন পরিসংখ্যান আরও তৈরি হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আজকের পৃথিবীতে এসব যোগাযোগমাধ্যম সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নানা স্তরে বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করছে। এ প্রভাব এতটাই প্রবল এবং দিন দিন এমনই প্রবলতর হয়ে উঠছে যে, কোনো রাষ্ট্রের সামরিক নীতি থেকে সরকার পরিবর্তন- সবকিছুরই অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে তারা ক্রিয়াশীল। এর ইতিবাচক দিক যে নেই- এ কথা বলা যাবে না। তবে তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বর্তমানের বিবেচনায় তুলনামূলক বেশি। যেহেতু প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে পরিচালিত হয়, সেহেতু সব রাষ্ট্র-সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তার কার্যকারিতা সমান নয়, এমনকি প্রাসঙ্গিকও নয়। তা ছাড়া রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীভেদে তাদের জনপ্রিয়তাও এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে টুইটার যতটা জনপ্রিয়, বাংলাদেশে ততটা নয়। ভুটানে উইচ্যাট যতটা প্রভাব বিস্তারকারী, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় ততটা নয়।
এই জনপ্রিয়তাই তাদের শক্তির মূল উৎস। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দিনশেষে তাদের ব্যবহারকারীর তথ্যগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজে লাগায় বা বিক্রিও করে। গোটা পদ্ধতিকে ‘গবেষণার’ নাম দিয়ে চালানো হলেও এ কাজ গবেষণার গণ্ডি পেরিয়ে গেছে আরও প্রায় এক দশক আগে। ২০১৩ সাল থেকে চলমান ফেসবুক ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ এনালেটিকার যৌথ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হলে আমরা জানতে পারি- ফেসবুকে শেয়ার করা আমাদের ব্যক্তিগত ছবি, পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক মতাদর্শ সবকিছু বেহাত হয়ে গেছে। কেবল তাই নয়, ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও ব্রিটেনের ব্রেক্সিট গণভোটে সংশ্নিষ্ট ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করেই প্রভাব বিস্তার করা হয়েছিল। এই ঘটনার পরই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ফেসবুককে পাঁচশ কোটি ডলার জরিমানা করেছিল।
বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৪ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবসাও জনসংখ্যার অনুপাতে বেশ রমরমা। তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা বিষয়। গত এক দশকে বাংলাদেশে যে ক’টি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটিই ঘটানো হয়েছে ফেসবুক ব্যবহার করে। তা ছাড়া গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের উদাহরণ তো আমাদের জানাই। এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই ফেসবুকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার প্রসঙ্গটি সামনে আসে। কিন্তু সে আলোচনা যে সার্বিকভাবে সফল হচ্ছে না, তা তো আমরা পরতে পরতে টের পাই। উল্টো কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, ফেসবুক তার কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিভাগে ব্লগার, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অমি রহমান পিয়াল ফেসবুকের স্বেচ্ছাচার নীতির প্রমাণসহ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর জেনোসাইডের ছবি আপলোড করলেই ফেসবুক তা সরিয়ে দিচ্ছে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ছবি আপলোড করলেই ফেসবুক তাকে ‘ভায়োলেন্স প্রদর্শন’ আখ্যা দিয়ে মুছে ফেলছে। এই দুস্কর্ম যে কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে হচ্ছে- এমন নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও লোক-সংস্কৃতির শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষকরাও একই ধরনের অভিযোগ তুলে ধরেছেন ফেসবুকের বিরুদ্ধে। ভিয়েতনাম, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া, নানকিং, রুয়ান্ডা জেনোসাইডের মতো বাংলাদেশ জেনোসাইডের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, এমনকি সেটা যদি তৎকালীন সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে থাকে এবং একজন ব্যবহারকারী সেই সংবাদপত্রের পাতাটি আপলোড করেন তাহলেও ফেসবুক ছবিটি হয় সরিয়ে দিচ্ছে, নাহলে ঢেকে দিচ্ছে। ঐতিহাসিক আলোকচিত্র হিসেবে রেড ইন্ডিয়ানদের জীবনযাত্রার কোনো ছবি প্রকাশ করলে তাকে ‘ন্যুডিটি’ আখ্যা দিয়ে মুছে দিচ্ছে। তাহলে ফেসবুক কি ইতিহাসের সঙ্গে ‘সহিংসতা’ বা ‘নগ্নতা’ গুলিয়ে ফেলে?
এ সমস্যা সমাধানে আমরা যদি এখনই উদ্যোগী না হই, তাহলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদরদের অপকর্মের কোনো নজিরই আমরা ফেসবুকে উপস্থাপন করতে পারছি না। প্রশ্ন হতে পারে, উদ্যোগটি কী হওয়া উচিত। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র এ বিষয়ে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। ইতিহাসবিষয়ক গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ যেখানে ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করছে, সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষগুলোকে আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের সঠিক চিত্রটি বোঝাতে না পারি, তবে লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
অমি রহমান পিয়াল তার লেখায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন, যাকে আমার কাছে ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দ্বিচারিতা মনে হয়। তারা একদিকে মুক্তিযুদ্ধে জেনোসাইডের ছবি মুছে দিচ্ছে কিংবা ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির যৌক্তিক সমালোচনা করলেও সে বিষয়ে কঠোরতা প্রদর্শন করছে; কিন্তু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা যখন প্রকাশ্য পোস্টে কাউকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে কিংবা ওয়াজের নামে নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর বক্তব্য দিচ্ছে আর সেগুলো যখন ফেসবুকের বিধান মেনে আমরা রিপোর্ট করছি, ফেসবুক তখন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, এটা তার কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ করেনি। স্ট্যান্ডার্ডের বলিহারি! প্রকাশ্যে কাউকে জবাই করার হুমকিকে তারা সহিংসতা মনে করছে না! আমার বিশ্বাস, যে কোনো সচেতন ব্যবহারকারীই এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আচরণের কারণ কি কেবলই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা বা এলগোরিদমের ফাঁকি? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়- না। কেননা, যদি ধরেও নিই এটা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের (এনএলপি) দুর্বলতা, তাহলে দুই ক্ষেত্রে একই রকম ফলাফল আসার কথা। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। ফলে ফেসবুকে বাংলা ভাষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত চিন্তাধারা ও আদর্শ আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমেরও একটি জরুরি ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও বর্তমানে ফেসবুকে তাদের শক্ত অবস্থান রেখেছে। দেশের প্রথম সারির প্রায় সকল সংবাদমাধ্যমেরই ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ আছে। এসব পেজে শেয়ারকৃত সংবাদের কোনো কোনোটির নিচে যে মন্তব্যগুলো আসে, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেগুলো অবশ্যই ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিপন্থি। এখন সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষ যদি এসব কমেন্ট রিপোর্ট করেন, তাহলে ফেসবুকের একটি দাপ্তরিক দায়বদ্ধতা তৈরি হওয়ার কথা। অনেক সংবাদের নিচে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া থাকে। কিন্তু সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেন না। যদি প্রচলিত আইনেও তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলেও সরকার অন্তত আইডিটি নিষ্ফ্ক্রিয় করার বিষয়ে ফেসবুকের শরণাপন্ন হবে। এটাও বাংলাদেশ প্রশ্নে ফেসবুকের দ্বিমুখী নীতি পরিবর্তনে কাজে আসবে বলে আমার মনে হয়।
অনেকের কাছেই হয়তো মনে হতে পারে, দেশের নানা সমস্যার মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই নয়। তাদের কাছে বিনীতভাবে জানাতে চাই, সমস্যাটি চিহ্নিত হয়েছে মাত্র। ফেসবুকে যারা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইয়ে সচেতনভাবে সক্রিয়, তারাই এখন পর্যন্ত এর ভুক্তভোগী। সমাধানকল্পে এখনই উদ্যোগী না হলে ভবিষ্যতে হয়তো ‘ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’ কথাটি লিখলেও ফেসবুক কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে বলবে- ‘রক্ত’ শব্দটি সহিংস, অতএব পোস্টটি ডিলিট করা হলো।
তখন কপাল চাপড়ালেও কোনো লাভ হবে না।