সম্প্রতি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল–জাজিরায় প্রচারিত একটি ডকুড্রামা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই ডকুড্রামাতে প্রধানমন্ত্রীকেও যুক্ত করা হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মূলধারার গণমাধ্যমেও আল–জাজিরার নির্মিত এই ডকুড্রামার নানা মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তির সমালোচনা হচ্ছে তথ্য-প্রমাণসহ। যদিও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে কোনো গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের কপিরাইট উক্ত গণমাধ্যমের হয়ে থাকে এবং সেগুলো চাইলেই নিজ নিজ ইউটিউব বা ফেসবুক পেইজে আপলোড দেয়া যায় না; তবুও আল–জাজিরার বানানো এই ডকুড্রামাটি বিভিন্ন নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে আপলোড হচ্ছে। এসব ব্যাপারে না তারা কপিরাইট ক্লেইম করছে, না ইউটিউব সেটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। ফেসবুকে সংবাদমাধ্যমটির অফিসিয়াল পেইজ থেকে এটি স্পন্সর পোস্ট হিসেবে চালানো হচ্ছে। প্রচারণার এমন বেপোরোয়া নীতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে গোটা ঘটনার পিছনের রাজনীতিটি খুব শক্তিশালী। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এই ডকুড্রামাটি বেশ কদর পেয়েছে। যে সকল রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকরা মিয়ানমারের ঘটনা দেখে বেশ নড়েচড়ে বসেছিলেন, তাদের জন্য এ যেনো এক বিরাট ‘খোরাক’। অবশ্য আল–জাজিরার উদ্দেশ্যও অনেকটা তাই ছিলো। মিয়ানমারের সেনা-অভ্যুত্থান যেদিন ঘটলো, সেদিনই সম্প্রচার করা হলো এই ডকুড্রামাটি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তবে এইটুকু বললে কেবল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের শর্তটুকু বলা হয়। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কথা বললে অনেক গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দায়িত্বশীলতাও তেমনি জরুরী। এখন প্রশ্ন হতে পারে, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা কে নির্ধারণ করবে? একজন সংবাদভোক্তা হিসেবে আমি যেটুকু বুঝি, এটি নির্ধারণের দায়িত্ব গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষেরই। রাষ্ট্র দিক-নির্দেশনা দিতে পারে কিন্তু চাপিয়ে দিতে পারে না। তবে এই মর্মে রাষ্ট্রের দিকে যদি আঙুল তুলতে চাই, তাহলে এটিও বিবেচনায় আনতে হবে যে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনো সংবাদের বিষয়ে যে কোনো নাগরিক আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। রাষ্ট্রীয় বিষয় হলে সেটি তদন্তও হতে পারে। সুতরাং কোনো গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি যদি হয় তথ্য বা ইতিহাস বিকৃতি করা তবে আর সেটা গণমাধ্যম থাকে না, সংবাদ-মুখোশের আড়ালে সেটা হয়ে উঠে দুর্বৃত্ত। যেমন আছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামরিক দুর্বৃত্ত, তেমনি গণমাধ্যমও দুর্বৃত্ত হয়ে উঠতে পারে। এমন অনেক নজির আছে পৃথিবীর ইতিহাসে, বাংলাদেশেও কম নেই।
দুই
সংবাদমাধ্যম হিসেবে আল–জাজিরাকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ তৈরি হয় ২০০৯ সালের শেষের দিকে। যখন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হচ্ছে আর আল–জাজিরা বিষয়টিকে ‘বিরোধী মত’ দমন হিসেবে প্রচার করছে। বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে যে কোনো গণমাধ্যমের ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করে ফেলা সম্ভব। ফলে কাজের প্রয়োজনেই যখন আল–জাজিরা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম, তখন তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটি পরিস্কার বোঝা গেলো। কাতারের রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত এই গণমাধ্যমটির সংবাদ পরিবেশন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে বিশেষ বিশেষ ডকুড্রামা বা তাদের আয়োজিত নানা টক-শোর বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়— অন্তত চারটি ইস্যুকে সামনে রেখে তারা সংবাদ পরিবেশন করে। এক, উপসাগরীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরাজমান অন্তর্দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে কাতারের আধিপত্য তৈরি; দুই, জঙ্গী-মনস্তত্ত্বের প্রসার ঘটানো এবং জঙ্গীবাদকে কেবলই একটি মার্কিন-ইসরায়িল ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা; তিন, মুসলিম ব্রাদারহুডের নামে বিশ্বব্যাপী ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার যে অপরাজনীতি তাকে মদদ দেয়া এবং চার, সুন্নীপন্থী ভাবাদর্শকে ধারণ করে শিয়াবিরোধী প্রচারণা চালানো।
তাদের সংবাদ পরিবেশন ও বিশ্লেষণের যাবতীয় প্রমাণ দেখলে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়। জঙ্গীনেতা ও সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনের ভিডিওবার্তা প্রকাশ থেকে শুরু করে, আরব বসন্তের সমর্থনে লিবিয়া ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রে আইএসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা বা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস— এ সবই আল–জাজিরার রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। এখন প্রশ্ন হতেই পারে, গণমাধ্যম কি রাজনীতির বাইরে? নিশ্চয়ই না, কিন্তু সেই রাজনীতির স্বরূপটি আমাদের জানা প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাও রাজনৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনোসাইডকে সমর্থন করেছে। কিন্তু সেই রাজনীতি বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতি, মানবতাবিরোধী রাজনীতি। কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষেই এই রাজনীতিকে সমর্থন করা সম্ভব নয়।
আল–জাজিরার রাজনৈতিক ধারাটিও তাই। নাহলে ২০০৪ সালে কীভাবে তারা একজন লেবানিজ সন্ত্রাসী আমির কুন্তারের জন্মদিনের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেছিলো? কীভাবে ইসলাম ধর্মের নামে ছড়িয়ে পড়া উগ্রবাদকে সমর্থন করে গোটা পৃথিবীকে জঙ্গীবাদের বার্তা দিয়েছিলো? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে শুরু করলেই আল–জাজিরার চরিত্রটি আমরা বুঝতে পারি।
তিন
প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশের বিষয়ে আল–জাজিরার আগ্রহটি কখন প্রকট হয়ে উঠলো? আগে-পরে বাংলাদেশকে নিয়ে তারা সংবাদ প্রচার করেনি, এমন নয়; কিন্তু সম্প্রচারের ধরণ দেখলে তো সংবাদের গুরুত্ব বোঝা যায়। বাংলাদেশ আল–জাজিরার টার্গেটে পরিণত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হলে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করতে নানা ধরণের সংবাদ প্রকাশ করেছিলো তারা। অবশ্য তখন বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমও এই ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত ছিলো। এ কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারক একাধিকবার কয়েকটি গণমাধ্যম ও একজন সাংবাদিককে তিরস্কারও করেছে। ২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লঘুদণ্ড হলে যখন সারাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, তখন আল–জাজিরা নতুনভাবে ষড়যন্ত্রের ছক কষে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ও আল–জাজিরার সংবাদভাষ্য ছিলো বিতর্কিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যখন আইন পরিবর্তন হলো, বিচারের রায় হলো এবং সেই রায় কার্যকর হওয়া শুরু হলো, তখন আমরা দেখলাম আদালত-স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের আল–জাজিরা ‘বিরোধী দলের নেতা’, ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’ ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত করা শুরু করলো। তাদের ইতর-মনস্তত্ত্বের স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় ২০১৩ সালের ০৫ মে, যখন শাপলা চত্বরে উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। আল–জাজিরা সাম্প্রতিক ডকুড্রামাটির মতোই সেদিন জানিয়েছিলো হাজার হাজার লাশ গুম করা হয়েছে! বাংলাদেশের গণমাধ্যম তাদের এই মিথ্যাচারের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিলো। একাত্তর টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলো আল–জাজিরার মিথ্যাচার। কিন্তু এই বিকৃত তথ্য উপস্থাপন ও মিথ্যাচারের জন্য আল–জাজিরার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও অপরাধীকে বিচারের আওতায় না আনলে অপরাধী সেটাকে দুর্বলতাই ভাবে।
২০১৭ সালের ২৭ জুন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক সাময়িকী The Diplomat একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিলো ‘Qatar-Gulf Crisis: Impact on Bangladesh’। ওই বছরের ০৫ জুন সৌদী আরব, বাহারাইন, মিশর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সরকার, ইয়েমেন ও মালদ্বীপসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে কাতারের ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কাতারের পাশে অবশ্য পাকিস্তান এসে দাঁড়িয়েছিলো। এই প্রেক্ষিতে কাতার বাংলাদেশের সমর্থন চেয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ কাতার বা সৌদীজোট কারও বিষয়েই কোনো সরকারি বক্তব্য দেয়নি। বস্তুত এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সঠিক পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে বলেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষকগণ তখন মত দিয়েছিলেন। সম্প্রতি (০৫ জানুয়ারি ২০২১) ‘আল-উলা ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে এই সংকটের অবসান ঘটেছে। ২০১৭ সালের এই ঘটনায় বাংলাদেশের বিষয়ে প্রায়শই সংবাদ ছাপা হতো কাতারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতি, প্রবাসীদের কাজের নিরাপত্তা, ঢাকা-দোহা ফ্লাইট ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদগুলোতে বাংলাদেশের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকতো। আল–জাজিরার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে সেটা বলছি না, ডকুড্রামাটি দেখার পর কাতারের তৎকালীন সংবাদ-ভাষ্যগুলো আমার মনে পড়ছিলো।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের বক্তব্য জানালেও এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। আল জাজিরা যেভাবে মিথ্যাচার করে ইসরাইলের প্রসঙ্গ এনে দেশের ধর্মীয় মনোবৃত্তিকে উস্কে দিতে চেয়েছিলো, এতে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের আভাস নিহিত আছে। ডকুড্রামাতে যাদের চেহারা দেখা গেছে তারা তো পুরোনো পাপী, এদের ষড়যন্ত্র আর মিথ্যাচারের নজির আগেও পেয়েছি; কিন্তু যারা আড়ালে বসে কলকাঠিটা নাড়লো— সরকারের উচিৎ তাদের খুঁজে বের করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই এই ডকুড্রামাটির বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি।