লেখার শিরোনামটি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের দেয়া একটি সংবাদ শিরোনামের অংশ। ১৯৬৪ সালের ১৩ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবসে’ আওয়ামী লীগের জনসমাবেশের একটি ছবি। জনসমুদ্রের সামনে বক্তব্য রাখছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার ঠিক উপরেই উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে দুটো কমা ও দুটো হাইফেন সহযোগে শিরোনাম নির্ধারণ করেছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। জনসভায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটি অংশকেই শিরোনাম করা হয়েছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা থেকে ঘড়ির বয়স্ক কারিগরের মতো খুঁজে এনেছিলেন একটি নাতিদীর্ঘ বাক্য এবং তাতে যুক্ত করেছিলেন সম্পাদকীয় বিরামচিহ্ন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার এই শিরোনাম তাই কেবল নির্দিষ্ট একটি দিনের নিউজ হেডলাইন হিসেবেই আটকে থাকেনি; এর ব্যাপ্তি ঘটেছে বহুদূর। বস্তুত শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন নথিভুক্ত করেছেন ইতিহাস ও রাজনীতির মাঝখানে একজন সাংবাদিকের অবস্থান— প্রকৃত প্রস্তাবে যা বিরামচিহ্নের মতোই তীব্রভাবে সাড়া দেয়।
প্রায় ৫৬ বছর আগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের করা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার শিরোনামটির অংশ নিয়ে তাতে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন যোগ করা হলো। এই প্রশ্ন সরাসরি দৈনিক ইত্তেফাকের কাছেই, কেননা জাতি বিস্মৃতিপ্রবণ হলে আমরা তার সংশোধনকল্পে ব্যবস্থা নিতে পারি; কিন্তু গণমাধ্যম ইতিহাস ভুলতে শুরু করলে তার দাওয়াই কে দেবে? ইত্তেফাক কথাটি উচ্চারিত হলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব থেকে শুরু করে বাংলা ও বাঙালির দীর্ঘ দার্ঢ্য ইতিহাসের সেলুলয়েড— যার সঙ্গে ইত্তেফাক নামটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ফলে গত ২৪ ডিসেম্বর পত্রিকাটির ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যে সংখ্যাটি তারা প্রকাশ করেছেন, তার বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার আগ্রহ ছিল বিপুল। ফলে প্রথম পাতাতেই প্রণম্য গবেষক জনাব শামসুজ্জামান খানের বাংলাদেশের জন্ম ও ইত্তেফাক শিরোনামের নিবন্ধটি পড়ি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, গোটা লেখার কোথাও তিনি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের কথাটি লিখলেন না। এমন তো নয়, জনাব শামসুজ্জামান খান তৎকালীন আওয়ামী লীগ, ইত্তেফাক এবং সিরাজুদ্দীন হোসেনের রাজনৈতিক রসায়ন সম্বন্ধে অবগত নন। তাহলে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখায় তিনি এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে সাংবাদিক আসিফুর রহমান সাগরের লেখা ইতিহাসের আলোয় বর্তমানের পথচলা প্রতিবেদনটি মন দিয়ে পড়লাম। পাঠান্তে মনে হলো, ইতিহাসের যে আলোর কথা প্রতিবেদক লিখেছেন, সে আলো আসলে কর্তৃত্বের প্রিজমের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিভক্ত আলো। ইতিহাসের সাদা সত্য তাতে নেই। থাকলে প্রতিবেদনের সপ্তম বাক্যে “দৈনিক ইত্তেফাক গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে…” বলে যে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নাম প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, সেখানে অন্তত শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামটি থাকা উচিৎ ছিল। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করেছে ইত্তেফাক, কিন্তু পত্রিকাটির সবচেয়ে গৌরব ও সংগ্রামের যে অধ্যায় শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন— তার নামটি গোটা প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিবেদক লিখেছেন, “মানিক মিয়ার মানস দর্পন ছিল যেন ইত্তেফাকের প্রতিটি পৃষ্ঠা”; কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই প্রতিবেদক জানেন, মানস দর্পনকে পত্রিকার পৃষ্ঠায় পরিণত করার দক্ষ কারিগর ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। যে আপোসহীন আর মাথা নত না-করার সাংবাদিকতা ইত্তেফাক সে সময় করেছিল, তার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় রাজাকার, আল-বদর দোসরদের সহযোগিতায় সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেয়া হয়, কিন্তু তারপরও পত্রিকাটি তার নির্ভীক সংবাদভাষ্য জারি রেখেছিল। ইত্তেফাক আজকে স্বীকার না করলেও ইতিহাস জানে— এই সাহসী ভাষ্যের ভাষ্যকার ছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন; কারণ তিনিই সেই যুদ্ধকালীন চরম বৈরী পরিস্থিতিতে ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পত্রিকাটির মুক্তিযুদ্ধকালীন যে ভূমিকা নিয়ে আজ আমরা গর্ববোধ করি, তার মূল কাণ্ডারী ছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন।
সুতরাং ‘মোসাফির’ শিরোনামে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চ কলামের কথা যদি ঐতিহাসিক কারণেই লিপিবদ্ধ করা হয়, তবে ‘অনামী’ শিরোনামে সিরাজুদ্দীন হোসেনের মঞ্চে-নেপথ্যে কলামের কথাও লিপিবদ্ধ করতে হবে। না হলে, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস অর্ধেকটা বলা হয়, আদতে বিকৃত করা হয়। ইতিহাস বিকৃতির এই নির্লজ্জ চিহ্ন গত ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক তার ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সিংহভাগ পাতায় রেখে গেছে।
দুই
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইত্তেফাকের ভূমিকা শিরোনামের লেখাটিতে একটি মারাত্মক তথ্য-বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। লেখাটির শেষ দিকে তিনি লিখছেন, “কৌশলগত কারণেই মানিক মিয়া সম্পাদকীয় ছাড়াও ইত্তেফাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ ও পরবর্তী সময়ে ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ কলামে ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন”। একই তথ্য দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী লিখেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহসী ভূমিকা। এই নিবন্ধে অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকের নাম থাকলেও নেই শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নাম।
ড. কামাল হোসেনের দেয়া তথ্যের সঙ্গে কিন্তু একই পাতায় প্রকাশিত আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যারের লেখা মানিক মিয়া ও ইত্তেফাক নিবন্ধটির তথ্য মিলছে না। কারণ, আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার তার লেখাতে ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে রাজনৈতিক মঞ্চ কলামটির কথাই উল্লেখ করেছেন— যা প্রকৃত সত্য। মূল ইতিহাস হচ্ছে মঞ্চে-নেপথ্যে লিখতেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘অনামী’ ছদ্মনামে। বয়সের কারণে ড. কামাল হোসেন সাহেবের স্মৃতি বিভ্রাট হতে পারে কিন্তু ইত্তেফাকের সম্পাদনায় এই তথ্য বিভ্রাট ও বিকৃতি ধরা পড়ল না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে মঞ্চে-নেপথ্যে কলামটির ইতিহাস জানতে হবে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জীবনাবসান ঘটে ১৯৬৯ সালের ১ জুন। তার পরপরই সিরাজুদ্দীন হোসেন এই কলামটি লিখতে শুরু করেন জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনেই। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনকে সামনে রেখে একদিকে আওয়ামী লীগের প্রচারণা, অন্যদিকে রাজনৈতিক বাতাবরণে রাজনৈতিক মঞ্চের মতো কলামের প্রয়োজনীয়তা— এ দুটো লক্ষ্য সামনে রেখেই তিনি মঞ্চে-নেপথ্যে লিখতে শুরু করেন ‘অনামী’ ছদ্মনামে। কলামটি ইত্তেফাকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালের ৮ অগাস্ট। সে সময়েই পত্রিকায় যোগ দেন খন্দকার আবদুল হামিদ। তিনি সাংবাদিকতার নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই পত্রিকার মালিকপক্ষের যোগসাজশে ‘অনামী’ ছদ্মনামেই মঞ্চে-নেপথ্যে লেখা শুরু করলেন। কী লিখলেন, সেটা আর বুঝতে বাকি থাকে না, কারণ খন্দকার আবদুল হামিদ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দালালি করেছেন— এ কথা আমরা সবাই জানি। কাজটি তিনি করেছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেনের ঢাকায় অনুপস্থিতির সুযোগে। স্বাধীন বাংলাদেশে খন্দকার আবদুল হামিদই পরবর্তীতে ‘স্পষ্টভাষী’ শিরোনামে মঞ্চে-নেপথ্যে লিখেছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অপ-দর্শন প্রচার করেছেন। তখন অবশ্য ইত্তেফাকও তার এই ভূমিকায় সায় দিয়েছিল। কারণ পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ইত্তেফাকের ভূমিকা আমাদের জানা।
এই ইতিহাস থেকেই বোঝা যায়, কেন ড. কামাল হোসেনের দেয়া ভুল তথ্যটি সংশোধন না করেই ইত্তেফাক তাদের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যায় ছেপে দিলো। আসলে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতিই বোধ করি সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও তার অবদানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার বিষয়ে তৎপর। এই উদ্দেশ্য নিয়েই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাদের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যাটি ছাপিয়েছে।
একমাত্র জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর লেখা বাঙালির চেতনায় সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে ইত্তেফাক লেখাটিতে সে সময়ের নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন সাংবাদিকের নাম এসেছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন, আসাফ উদ্দৌলা রেজা, মাহমুদ উল্লাহ, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ যে ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন আদর্শিক লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন— এ কথা একমাত্র এই লেখাটিতেই উঠে এসেছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নেতৃত্বে থেকেও কীভাবে সিরাজুদ্দীন হোসেন তার স্বকীয়তা ও আদর্শিক সংগ্রামের অনন্যতা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন— এই লেখাতে তার একটি আভাস পাওয়া যায়।
জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর লেখার একটি ছোট্ট অংশে আছে— ১৯৬৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সিরাজুদ্দীন হোসেন তখন কাঠের হরফে আট কলামের শিরোনাম করেছিলেন— ‘পূর্ব-বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। সম্পাদক মানিক মিয়া তখন বার্তা-সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে শিরোনামটি বদলে দেবার ‘অনুরোধ’ করেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন কিন্তু সেদিন সম্পাদকের ফরমায়েশ মানেননি; বরং স্বভাবসুলভ হাসিতে জানিয়েছিলেন— ‘মানিক ভাই, এই মুহূর্তে হেডিং অথবা সিরাজুদ্দীন হোসেন— দুটোর একটাকে আপনার বেছে নিতে হবে। শিরোনাম আমি বদলে দেব কিন্তু আমি আর ইত্তেফাকে বসবো না’। মানিক মিয়া অকপটে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘শিরোনাম বদলানোর প্রয়োজন নাই, আমার সিরাজুদ্দীন হোসেনকেই প্রয়োজন’।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ইত্তেফাকে সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু বর্তমান ইত্তেফাকে যে নেই— এটা তো তারা ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যাতেই জানান দিলেন। সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ইতিহাস থেকে বাদ দেবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সম্পাদকীয় নীতি ইত্তেফাক গ্রহণ করতেই পারে— সেটা তাদের নিজস্ব রাজনীতি; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে অন্যায় পত্রিকাটি করছে, তার জবাব কিন্তু তাকে দিতেই হবে। ইতিহাস বিকৃতির এক ভয়াবহ সময় পার করেছে বাংলাদেশ। আমাদের প্রজন্ম তার নিষ্ঠুর শিকার। এখনও চারদিকে তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস জারি আছে। কিন্তু ইতিহাস নিজেই সাক্ষ্য দেয়, বিকৃতকারীরা প্রকৃত ইতিহাসকে সাময়িক আড়াল করতে পারলেও তার শাশ্বত আলোকে কখনও বিনষ্ট করতে পারেনি। প্রজন্মের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দৈনিক ইত্তেফাক এই সত্যটি যেন মনে রাখে।