একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। রাজপথ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মূলধারার গণমাধ্যমসহ সবক্ষেত্রে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন মানুষ। করোনা মহামারীর সময়ে প্রতিটি সচেতন মানুষ যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করছেন। ইতোমধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে অপরাধীদের। এই পর্যন্ত চিত্রটি আমাদের পরিচিত। ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি বা কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের পরও একইভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন মানুষ। সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নুসরাত হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হলেও, তনু হত্যাকাণ্ডের কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি নুসরাত হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়ন কবে হবে— তা-ও আমাদের জানা নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক অপরাধের সংখ্যা এবং এই অপরাধের বিচারের অনুপাত কেবল হতাশাব্যঞ্জকই নয়, আতঙ্কিত হবার মতো। পাহাড়ে আদিবাসী নারীদের ওপর এই নির্মম নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে কিন্তু বিচার তো দূরের কথা, অনেক সময় মামলা পর্যন্তই হয় না। সমতলে, গ্রামে-গঞ্জে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবখানেই চিত্রটি প্রায় একই রকম। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধীদের ছবি ও পরিচয় ভাইরাল হয়ে গেলে, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা যে পুলিশের দায়িত্ব, অপরাধীদের হিংস্রতা থেকে জনগণকে রক্ষা করাই যে পুলিশের কাজ এবং এই কাজে পুলিশ প্রশাসন প্রায় ব্যর্থ— এ ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট জবাবদিহিতা আমরা পুলিশের কাছে পাই না। একটি অপরাধের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। এতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দায়-দায়িত্বের উপরে জনগণের সংশয়-সন্দেহ তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, জনগণের প্রতিবাদও ক্ষণস্থায়ী। একটি অপরাধ সংঘটিত হলে সচেতন মানুষজন তার প্রতিবাদ করেন বটে কিন্তু আরেকটি ঘটনা ঘটলেই আগের প্রতিবাদ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। একটি প্রতিবাদের যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক চিন্তাধারা থাকা প্রয়োজন, তা থাকে না বলেই অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিবাদ ‘মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়’- এ পরিণত হয়। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি সমাজে ধর্ষকামী মনস্তত্ত্বেরও চিকিৎসা প্রয়োজন। আইন স্বাধীন ও সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে যেমন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে, তেমনি এটাও মানতে হবে যে, কেবল আইন প্রয়োগ করে কোনো অপরাধের নির্মূল সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনার পর আমরা নতুনভাবে সেটা উপলব্ধি করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মূলধারার গণমাধ্যমের খবরের মন্তব্য ঘরে যে মন্তব্যগুলো পাই, তার অধিকাংশের সারমর্ম অনুধাবন করলেই বোঝা যায়, কতোখানি পৈশাচিক মনোবৃত্তি নিয়ে লোকে এইসব সংবাদ পাঠ করে থাকে। সুতরাং এই নৃশংস অপরাধ দমনে বিচারব্যবস্থার স্বাধীন প্রয়োগ যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি সমাজের মনোচিকিৎসাও জরুরী।
দুই
ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতিবাদে সচেতন মানুষের কাছ থেকে আমরা যতোটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাই, ততোটা সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা পাই না। অথচ, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি, যা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ অন্যান্য শাখার গবেষকদের গবেষণা করা প্রয়োজন ছিলো। গত কুড়ি বছরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধর্ষণ অপরাধের বিষয়ে কতোগুলো গবেষণা হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কিনা— এ বিষয়ক কোনো তথ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে পাইনি। অথচ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণার বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের পাকিস্তানি বয়ান যদি আমরা পাঠ করি, তবে দেখতে পাবো, কীভাবে পাকিস্তান ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধে নারীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ যুদ্ধের একটি অপ-কৌশল হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বই বা পাকিস্তানি রাজনীতির খোঁজ-খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেই নয়, পাকিস্তানের রাজনীতিতেও ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিস্কারভাবে বললে, ধর্ষণ একটি আধিপত্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন, যা নারীকে শারীরিক, ‘নৈতিক’ ও ‘সামাজিকভাবে’ নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য ব্যবহূত হয়। পাঠক হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, ‘নৈতিক’ ও ‘সামাজিক’ শব্দ দুটোকে আমি উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রেখেছি; কারণ, ধর্ষণের মাধ্যমে কাউকে নৈতিক বা সামাজিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। ধর্ষণ একজন মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত শারীরিক ও মানসিক অপরাধ কিন্তু এতে অপরাধের শিকার ব্যক্তির কোনো লজ্জা নেই, কেননা তিনি অপরাধী নন, বরং অপরাধের শিকার। কিন্তু যুগে যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অশিক্ষা কুশিক্ষাগত ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর সুযোগ পাকিস্তানও নিয়েছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। নির্মম নির্যাতনের শিকার নারীরা স্বাধীন দেশে সামাজিক ও লোকলজ্জার শিকার হয়েছিলেন। অনেকে পরিবারহারা হয়েছেন। আশ্রয়চ্যুত এই নারীদের দুর্দশার কোনো অন্ত ছিলো না। অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য বিভৎস নিপীড়ন সহ্য করেও স্বাধীন রাষ্ট্রের সুফল তাঁরা পাননি। কারণ, ভূ-খণ্ড বা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও, বোধের প্রশ্নে সেখানে তখনও জীবিত ছিলো পাকিস্তানি অপ-দর্শন। ফলে বীরাঙ্গনাদের যে জীবনকাহিনী আমরা পড়েছি বা এখনও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দেখি, তা মানবেতর। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ মনস্তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যেমন হারিয়েছি, তেমনি হারিয়েছি আমাদের লড়াইয়ের অভিঘাত। সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে আমরা উল্টোপথে হেঁটেছি এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে খানিকটা ধর্মের সঙ্গে খানিকটা রাজনীতি মিশিয়ে একটি জগাখিচুড়িমার্কা হঠকারি শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে। এর প্রভাব নিশ্চিতভাবে পড়েছে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে। প্রায় তিনটি প্রজন্ম বড়ো হয়েছে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে আত্ম-পরিচয়হীন হয়ে। তাদের মগজের দখল নিয়েছে ‘সংখ্যাগুরুর রাজনীতি’ অর্থাৎ বল প্রয়োগের কুৎসিত আধিপত্যবাদী মানসিকতা।
তিন
পাঠক হয়তো ভাবছেন, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই আলোচনার সম্পর্ক কী? আমি সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ সংঘটিত হলেই একটি পক্ষ ধর্ষণের শিকার নারীর দিকে আঙুল তোলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর পোশাক বা চরিত্র নিয়ে আলোচনা করে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই বিশেষ পক্ষটিকে অনেকেই বিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে দেখে এসেছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরের অপরাধের সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, এই বিশেষ পক্ষটি এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং অনেক বেশি উচ্চকিত। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সংঘটিত অপরাধের পর সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব বাবুনগরী ‘পর্দাকে বাধ্যতামূলক করার’ যে হাস্যকর ফতোয়া দিয়েছে, তা-ও ভিকটিম ব্লেমিং। মাদরাসাগুলোতে সংঘটিত নারকীয় নির্যাতনের যে সংবাদগুলো আমরা গণমাধ্যমে পাই, সেগুলোর কারণ তবে কী?
বিচারহীনতা যেমন অপরাধ বৃদ্ধির একটি কারণ, তেমনি সমাজের কিছু ঘটনা অপরাধ-মনস্তত্ত্ব তৈরির প্রভাবক। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুকে ওয়াজের নামে নারীর বিরুদ্ধে তীব্র অবমাননাকর বক্তব্য। ওয়াজের নামে নারীর বিরুদ্ধে বিষাদগার করার অপ-কৌশলটি ছিলো যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওয়াজের নামে এই যুদ্ধাপরাধী নারীর বিরুদ্ধে যে ধরনের অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছে, তারই ধারাবাহিকতা আমরা পাই আজকের ইউটিউবে পাওয়া ওয়াজগুলোতে। কুশীলব বদলেছে কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। সেই পাকিস্তানি মনস্তত্ত্ব, যেখানে নারীকে আক্রমণ করে পুরুষের মধ্যে নারীবিদ্বেষী একটি ধর্মীয় আগ্রাসন তৈরি করা হয়। এই আগ্রাসন, এই মনস্তত্ত্ব একটি ধর্ষকামী মনোকাঠামো তৈরি করে— যার ফলাফল হলো খাগড়াছড়ি, সিলেট বা নোয়াখালীর ধর্ষকরা।
আইন করে যে অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়— এ কথা আইনের দার্শনিকরাই বলে গেছেন। আজকের আক্রান্ত বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, এর মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রয়োজন। একটি সাম্প্রদায়িক, নারীবিদ্বেষী, অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতার প্রজন্মের বেড়ে ওঠা ঠেকাতে কেবল শিক্ষাব্যবস্থা বদলালে হবে না, পারিবারিক মানসকাঠামোটাও বদলাতে হবে। শীতকালে দেশজুড়ে ওয়াজের নামে নারীর বিরুদ্ধে যা তা বলার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে কেবল আইন করলেই ধর্ষণের মতো বিভৎস অপরাধ ঠেকানো যাবে না। এই অপরাধ সংঘটনের পিছনে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি মনস্তত্ত্ব কাজ করে। ‘সংখ্যাগুরু’, ‘সংখ্যায় বেশি’, ‘দলের লোক’, ‘পুরুষ’ ইত্যাদি বিষয়গুলো অপরাধীদের মানসিক কাঠামো তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একটি কথা আরও একবার মনে করিয়ে দিতে চাই— আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ছিলো ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার’- এর বাংলাদেশ। এই দর্শন থেকে আমাদের স্খলনই আমাদের অমানুষ করে তুলছে।