চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর যখন প্রতিটি গণমাধ্যমে উঠে আসছে তখন বারবার মনে পড়ছে গত ৩০ জানুয়ারি সচিবালয়ে এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদের বক্তব্য। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে মাননীয় মন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন— ‘তারা (প্রশ্নফাঁসকারীরা) এখন প্রশ্ন ফাঁস করতে সক্ষম না। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রশ্ন বানিয়ে ফাঁস করে। গত চার বছর ধরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে প্রশ্ন ফাঁস হয় না…’। মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যটি কেবল অসাড়ের গর্জনই নয়, গত চার বছরের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে যারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন, গণমাধ্যমে যারা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছেন- তাদের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকার পরও শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের নানা পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিষয়টি অস্বীকার করে যাচ্ছেন। তারা সমস্যার সমাধান করবেন কী, সমস্যাটি স্বীকারই করছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই জেগে ঘুমানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রই বছর বছর পালন করে যাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে, নানা রকম অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত আবারও আরেকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছেন, পরীক্ষার খাতায় মুড়ি মুড়কি সব এক মানে বিচার হচ্ছে এবং ফলাফল ঘোষণার পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় গিয়ে দেখা যাচ্ছে ফলাফলের ধস। এতে কেবল যে শিক্ষা ব্যবস্থাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কেবল তা-ই নয়; শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বড়ো ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা। আর ডিনায়াল সিনড্রোমে আক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসির ক্ষেত্রে অপরাধীদের খুঁটির জোর প্রমাণিত হচ্ছে। অপরাধ করেও প্রকৃত অপরাধীরা যখন গা বাঁচিয়ে চলতে পারে, তখন আদতে সে নতুন অপরাধের নীল নকশা তৈরি করতে থাকে।
প্রতি বছরই কেন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হচ্ছে? এর সহজ এবং গ্রহণযোগ্য অনেকগুলো উত্তর থাকলেও বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এর কতোগুলো রাজনৈতিক এজেন্ডা-নির্ভর আর কতোগুলো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়নেরই জন্য। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মহাজোট সরকার শুরু থেকেই একটি লঘু রাজনৈতিক চাল চেলে যাচ্ছে। আমরা যদি গত সাত বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করি, তাহলেই বোঝা যাবে ‘ভালো ফলাফল’কে মুলো বানিয়ে বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময় সরকার পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল-কেন্দ্রীক রাজনীতিটা করে আসছে। ২০১০-২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও পাসের হারের পরিসংখ্যান দেখলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে যথাক্রমে ৬২ হাজার ১৩৪ জন (২০১০: পাসের হার ৭৮.১৯%), ৬২ হাজার ২৮৮ জন (২০১১: পাসের হার ৮২.১৬%), ৮২ হাজার ২১২ জন (২০১২: পাসের হার ৮৬.৩২%), ৯১ হাজার ২২৬ জন (২০১৩: পাসের হার ৮৯.২৮%), ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন (২০১৪: পাসের হার ৯২.৬৭%), ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন (২০১৫: পাসের হার ৮৭.০৪%) এবং ১ লাখ ০৯ হাজার ৭৬১ জন (২০১৬: পাসের হার ৮৮.২৯%)। লক্ষ্যণীয় ২০১০ সাল থেকে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ হয় এবং তারপর আবার কমতে থাকে। ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষাটি শুরুই হয়েছিলো প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে। তৎকালীন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো পড়লেই বোঝা যায়, পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের নানা রকমের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। এই প্রশ্নফাঁস সে বছরের ফলাফলে লাগাম ছাড়া প্রভাব রেখেছিলো। পাসের হার এবং জিপিএ ৫ উভয়ক্ষেত্রই রেকর্ডের খাতা ছুঁয়েছিলো। তার পরের বছরগুলোতে এই হিসেব তুলনামূলক কমে আসে, তবে সেটা আগের বছরের বিতর্কের কারণেই। লেখাপড়া, প্রশ্নপত্রের মান বা উত্তরপত্র মূল্যায়নের পদ্ধতি এখানে কোনও প্রভাব ফেলেনি।
দুই
একটা সময় ছিলো পাবলিক পরীক্ষার সময় প্রায়শই সংবাদপত্রের খবর হতো ‘স্মরণকালের কঠিন প্রশ্ন’ শিরোনামে। অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে পাস করানোর ব্যাপারেও কলাম লেখা হতো খবরের কাগজে। সে-ই তুলনায় এখন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নের ধরনই বদলে গেছে। উত্তরপত্র মূল্যায়নের যে সকল নমুনা মাঝে মাঝে গণমাধ্যম মারফৎ শুনতে পাই, তাতে মনে হয়, শিক্ষার্থী চাইলেও আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাউকে অকৃতকার্য হতে দেবেন না। তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে কেন? কারণ ঢিলেঢালাভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে বেশি নম্বর প্রদানের নির্দেশনা থাকায় জিপিএ-৫ এর সংখ্যা এখন আকাশছোঁয়া। ফলাফল নির্ধারণের বাদবাকি গ্রেড পয়েন্টগুলোর কোনও মূল্যই যেনো নেই। সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট শিক্ষার্থীকে নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে অর্জন করতে হবে না, এটা সরকারের পক্ষ থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য ‘ছোট্ট উপহার’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অতএব, এ প্লাস এখন ছেলের হাতের মোয়া। তা মোয়াই যখন হবে, তখন সেটা আরও সহজে পেতে দোষ কী! এ অবস্থায় আগে যারা সারা বছর না পড়েও পরীক্ষার আগে অন্তত টেস্ট পেপার বা বিগত বছরের প্রশ্নগুলোও সমাধানের চেষ্টা করতো, তারা এখন সেটাও করছে না। কারণ তারা জানে, প্রশ্ন পাওয়া যাবে। বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন সমাধানের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া কয়েক সেট প্রশ্ন সমাধান বেশি কার্যকর হয়েছে গত কয়েক বছরে। সরকার পাবলিক পরীক্ষাগুলোর মান নষ্ট করে এ প্লাসের রাজনীতি করেছে; অতএব শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরাও পিছিয়ে থাকবেন কেন? সরকারের বিভিন্ন মহল প্রায়ই বলে থাকেন, শিক্ষা গ্রহণের চাপে শিশুর মানসিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে তারা যত্নবান। সুতরাং আরেকটি মহল ভাবছে প্রশ্নটা ফাঁস করে সরকারকে আরও যত্নবান হিসেবে প্রমাণ করা যাক! সরকারি মহল একবারও বোঝার চেষ্টা করছেন না যে, শিক্ষা গ্রহণে শিশুর মানসিক কোনও চাপ হয় না; চাপ সৃষ্টি হয় কোচিং সেন্টারে হন্যে হয়ে দৌড়ানোর প্রতিযোগিতায়। কোচিং সেন্টার বন্ধের মেরুদণ্ড সরকারের নেই। তারা পড়াশুনার মান নামিয়ে শিশুর মানসিক বিকাশের নামে আদতে তাদের বড়ো বড়ো প্রতারকচক্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
এই রাজনীতির একটি বড়ো প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত ভর্তি কার্যক্রমে। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের দুটো পক্ষ তৈরি হয়। একপক্ষ, যারা নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে সর্বোচ্চ ফলাফল করেছেন; অন্যপক্ষ, যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে ওই একই ফলাফল করেছে। সুতরাং প্রথম পক্ষের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে তার নিষ্ঠার সাক্ষর রাখার। দ্বিতীয় পক্ষও এখানে নীরব থাকে না। প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়ে গেছে; অতএব, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও প্রশ্ন ফাঁস বা ডিজিটাল জালিয়াতি চক্রান্তের অংশ হয় তারা। এই চক্রান্তেও তারা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। ফলে যারা প্রতিবাদ করছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তারাও নিজেদের প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন ফাঁসের কারণে বিব্রত হচ্ছেন। ফলে প্রতিবাদের উত্তাপও কমে আসছে।
তিন
প্রতিবারই প্রশ্ন ফাঁস হলে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী নির্লজ্জের মতো সংবাদ সম্মেলন করে তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এইসব গ্রেফতার আসলে কোনও কার্যকর পরিবর্তন আনছে না। প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো পড়লে বোঝা যায়, এর সঙ্গে তিনটি শ্রেণি জড়িত। এক, যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপা বা এ সংক্রান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজি প্রেস ও বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরাই মূলত প্রশ্নটাকে সিক্রেট জোন থেকে বাইরে চালান করে। দুই, যারা এই চালান হওয়া প্রশ্নের বিভিন্ন সেট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নীতিহীন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে পৌঁছায় টাকার মাধ্যমে। এরা মূলত সারকুলেশন আর খদ্দর জোগাড়ের কাজটি করে। তিন, অসৎ পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবক, যারা যে কোনও মূল্যে সরকার কর্তৃক উপকৃত ছেলের হাতের মোয়াটি পেতে চায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে, তখন মূলত দ্বিতীয় শ্রেণিটির চেহারা গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখতে পাই। প্রথম শ্রেণিটি থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আরেকটি পাবলিক পরীক্ষায় তারা আবার একটি দ্বিতীয় শ্রেণি তৈরি করে এবং একই কাজের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। আজ পর্যন্ত শুনলাম না প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে সঠিক তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয় তার নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে কোনও অনুসন্ধান চালিয়েছে। শিক্ষা বোর্ড বা বিজি প্রেসের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভূত যে সর্ষের মধ্যে, এটা মাননীয় মন্ত্রী বুঝতে চাইছেন না। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এ প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পারবেন না কারণ খলের ছলের কোনও অভাব নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত যে মন্ত্রী একের পর এক প্রশ্ন ফাঁসের পরও আজ পর্যন্ত স্বীকার করলেন না যে এটা তার এবং তার মন্ত্রণালয়ের নির্লজ্জ ব্যর্থতা, তার কাছ থেকে প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কষ্ট করেও আর আশা করতে পারছি না।
তবে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের একটি অংশের সঙ্গে আমি একমত। ‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে’— বক্তব্যের এই অংশ সঠিক। বছরের পর বছর প্রশ্ন ফাঁস হলে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা চললে, লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বরটুকুও না পেলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না, শূন্য হয়ে যাওয়ার কথা। অবশ্য তাতেই বা কী যায় আসে! ক্ষমতায় থেকে কে কবে নিজের নৈতিকতা আর মেরুদণ্ড হারানোর বিজ্ঞপ্তি লিখেছিলেন?