অনেকের মতো আমিও জানি ফরিদুর রেজা সাগর একজন অসামান্য টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিশু সাহিত্যিক এবং দক্ষ সংগঠক। কিন্তু আমি বা আমার মতোন বুকপকেটে শৈশব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের দল যেটা জানে, সেটা অনেকেই জানেন না। ফরিদুর রেজা সাগর একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান। মধ্যবিত্ত স্কুলব্যাগ কাঁধে, মর্নিং শিফটের আধঘুমের ক্লাশে আমরা কতোবার তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গেছি। এজন্য আমাদের কোনো ট্রাভেল ট্যাক্স গুণতে হয়নি। ফরিদুর রেজা সাগরের সঙ্গে আমাদের ছিলো কুয়াশার বিনিময়। আমরা আমাদের বয়েজ স্কুলের দুষ্টুমিগুলো তাঁকে দিতাম, তিনি আমাদের ছোটকাকুকে পাইয়ে দিতেন। এখনও টেলিভিশনে বা অন্য কোথাও তাঁকে দেখলে আমি ভাবি— তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে আমার শৈশবের দুষ্টুমিগুলো রাখা আছে। বিনিময়ে আমি এখনও তাঁর ট্রাভেল এজেন্সির মাস্টার গাইড ছোটকাকুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই।
তো ছেলেবেলায় আমরা এমনই ছিলাম। কৈলাস, গ্যাংটক, কাশী বা বোম্বের আকর্ষণীয় ট্যুর অফার নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা; চল্লিশের দশকের কোলকাতা চেনার আবদার মেটাতে শরদিন্দুর ঘরের ছেলে ব্যোমকেশ বক্সী আর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া— পুরো বাঙলাদেশের গুগল ম্যাপ ছোটকাকু— কেয়ার অব ফরিদুর রেজা সাগর। মধ্যবিত্ত বাঙালি তো বেড়ানোর নাম শুনলেই ‘সিক’— মানে সিলেট আর কক্সবাজার। তো বড়োরা যখন ‘সিক’, ছোটোরা তখন না জেনে নারায়ণগঞ্জ ঘুরে বেড়াচ্ছে, রংপুরের রংধনু দেখছে, এমনকি বকা খেয়ে বগুড়ায় যাচ্ছে। তাই আমার কাছে ফরিদুর রেজা সাগর মানে ৮০ জনের ক্লাশরুমে বি.কে মণ্ডল স্যারের কড়া শাসনে চোখের সামনে টলেমির উপপাদ্য খোলা রেখেও ছোটকাকুর সঙ্গে বাঙলাদেশের ৬৪ জেলায় ঘুরে বেড়ানো। বুকের মধ্যে টম সয়ারকে রেখে ইডিপ্লাসের অতিথি হয়েও মায়ের সামনে বিদ্যাসাগর সাজবার সেই পবিত্রতম মিথ্যেটুকুতেও ফরিদুর রেজা সাগর জড়িয়ে আছেন।
দুই
একটা সময় ছিলো— ‘লাল’ বললে লাল বল বুঝতাম। ‘বাড়ি’ বললে মনে হতো কেউ ঘরের কথা জানতে চাইছে। তারপর বড়ো হতে হতে আমাদের চোখের জল কমে যায়। ‘লাল’- এর অর্থ বদলে যায়। ‘বাড়ি’ বললে মনে হয় নকশালবাড়ি। ফরিদুর রেজা সাগরের একটি বই আছে আমরা সবাই রাজা। এখনও বইমেলায় অনন্যার স্টলে দাঁড়ালে দেখি শিশুরা বইটি কিনছে; অথচ আমার চুরি হয়ে যাওয়া শৈশবে রাজার নীতি ঢুকে গেছে। তো কল্পনাশক্তির আয়ু ফুরোলেই তো লোকে বড়ো হয় আর বড়ো হলে রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি সম্বন্ধে সন্দেহ বাড়ে। জীবনানন্দকে ভাববাদী মনে হয়।
কিন্তু এই যাবতীয় সন্দেহবাতিকতার মধ্যেও ফরিদুর রেজা সাগর কেমন একটা টিক চিহ্ন আদায় করে নেন। এই যে ছোটকাকু সিরিজের মধ্য দিয়ে দেশটাকে চেনানো, এই যে লাল বেবিট্যাক্সি বইয়ের গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে মগজে মননে দেয়াল লিখনের পদ্ধতি— এ তো রাজনীতির আরেক পল্টন ময়দান। সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি কিচ্ছু নেই…কেবল সত্যটুকু আছে, আছে মননে সেঁটে দেয়া রাজনীতির পোস্টার। তাই ছেলেবেলায় যিনি তাঁর মাধবীর সঙ্গে আমাদের হ্যান্ডসেইক করিয়ে দিয়েছিলেন, বড়োবেলায় তাঁকেই আবিস্কার করলাম মেধাবী হিশেবে। কিন্তু এ আবিস্কারের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের বিনিময় শেষ হয় না। আমরা বড়ো হতে হতে গোলমেলে হয়ে গেছি, আমাদের শৈশবের সহজিয়াটুকু হারিয়ে গেছে এবং এই হারানো বিজ্ঞপ্তিতে ফেলুদা, ঋজুদা, ব্যোমকেশের সঙ্গে ছোটকাকুর স্বাক্ষরটিও আছে।
ছড়ানো রঙ পেন্সিল আর ড্রয়িং খাতা ফেলে আমরা বড়ো হয়ে গেছি। আমাদের হলদে বিকেল আর আলটুসে সন্ধ্যা জুড়ে এখন একগাদা নিঃসঙ্গতা। সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর আমাদের ফেলে আসা শৈশবটাকে গুছিয়ে রেখেছেন— মায়ের মতোন।
কেননা তিনি তো জানেন— শৈশবে ফেরার অক্ষম আর্তনাদই বয়স বেড়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষের একমাত্র অবলম্বন।