কী অপূর্ব এই স্মরণমুহূর্ত! চারপাশের বেকায়দা সময়ে আমাদের হাবা যৌবন যখন গতপ্রায়, তখনই পৌরাণিক ফেরেশতার মতো ক্যালেন্ডারে নেমে আসে তেসরা মে—শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী—আমাদের স্থানাঙ্ক খুঁজে পাওয়ার দিন। কতগুলো নিবিড় বিষন্নতা আমাদের অলৌকিক শুভকামনার সঙ্গে উড়ে যায় তাঁর দিকে—তিনি গ্রহণ করেন, অথবা করেন না; কারণ তিনি তো জানেন—শহিদ রুমীর মতো আসমুদ্রহিমাচল হৃদয় আমাদের নেই। তাই ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো তিনিও যন্ত্রণাকে বরণ করেন ক্ষমার আদরে। তাঁর চশমার কাচে তাই যুগপৎ লেপ্টে থাকে মায়েদের স্বভাবজাত বিষাদ ও বিদ্রোহ। যে বাংলাদেশকে জন্মলগ্নে তিনি দেখেছিলেন, সন্তানের জীবনের বিনিময়ে যে দেশের স্বাধীনতাকে তিনি স্পর্শ করেছিলেন পরম যত্নে, স্বাধীন বাংলাদেশে জীবিত সন্তানদের হাতে যে আদর্শকে তিনি রেখে গিয়েছিলেন আদর্শলিপি হিসেবে—স্বীকারে লজ্জা থাকলেও বলতে দ্বিধা নেই—আজ তার কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমরা যারা তাঁকে ‘শহিদ জননী’ বলে নত হচ্ছি, বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাঁকে স্মরণ করছি, কী আশ্চর্য, রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদ আস্ফালনে আমাদের সিংহভাগই বিব্রত হচ্ছি না। রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি কিংবা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাগৃহে একের পর এক শয়তানভাষ্যের চিত্রনাট্য প্রদর্শিত হচ্ছে, অথচ আমরা নির্বিকার! আজ আমাদের সব পথ এসে মিলে গেছে শেষে অনলাইনের কুয়াশায়। অফলাইনের রুটে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে আর কোনো গাড়ি নেই। গুগল আমাদের ইতিহাস শেখাচ্ছে, ফেসবুক আমাদের যাবতীয় প্রতিক্রিয়ার ঠিকাদারি নিয়েছে, রাজনীতি ততটুকুই—মোবাইলের স্ক্রিনে যতটুকু আঁটে। আমরা ভেবে অবাক হই, কোনো রকম সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াই রুমী কী করে খুঁজে পেয়েছিলেন লিওন উরিসকে? অবশ্য মাইলা-১৮ আমরাও পড়ি—ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি আপলোড হতে যতক্ষণ লাগে—ততক্ষণ।
কিন্তু জীবন শুকিয়ে গেলেই তো মানুষ করুণাধারা খোঁজ করে—তাই আমরাও ক্রমশ জড়ো হয়ে ঘন হয়ে আসি শহিদ জননীকে ঘিরে। জিব্রানের আলমুস্তাফা যেমন অর্ফালেসের জনগণকে শিখিয়েছিলেন জীবনের পাঠ, তেমনি আমরাও আমাদের হারানো আদর্শলিপিটি ফিরে পাওয়ার জন্য হাত পাতি শহিদ জননীর কাছে। আমাদের হাতে উঠে আসে একাত্তরের দিনগুলি । এ কেবল মুক্তিযুদ্ধকে জানার ইতিহাসপাঠ্য নয়, এই বই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় এমন একটি প্রজন্মের সঙ্গে যাঁরা প্রণয়-প্রলয়-প্রতিভায় অনন্য। তাই কেবল দিন-তারিখ ধরে কতগুলো ঘটনার সমাবেশ নয়, শহিদ জননী প্রকৃতপ্রস্তাবে আমাদের সামনে একটি প্রজন্মের তারুণ্যকে তুলে ধরেছেন—যাঁরা ধ্যানস্থ হতে জানতেন, প্রতিবাদী হতে জানতেন, দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন; যাঁদের বাংলা বলতে ইংরেজি হাতড়াতে হয়নি আবার ইংরেজি বলতে বাংলা ভুলতেও হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এই প্রজন্মই নব্বইয়ের দশকে শহিদ জননীকে ঘিরে রচনা করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নব্বইয়ের তারুণ্য। এই যে উত্তর প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মেলবন্ধন—আমরা যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তবে স্বীকার করতেই হবে—এ যুগলবন্দী থেকেই জন্ম নিয়েছিল ২০১৩ সালের পারাবারপ্রতিম শাহাবাগ আন্দোলন। লক্ষ জনতার স্রোতে সেদিন শহিদ জননী ছিলেন এমন এক মোহনা—যেখানে এসে মিশেছিল মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী প্রতিটি প্রজন্ম। আদর্শকে তিনি চিনতে শিখিয়েছিলেন আতশকাচ দিয়ে। কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই নয়, একটি অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য জনমানসিকতায় যে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন ঘড়ির বয়স্ক কারিগরের মতো জাহানারা ইমাম তা শনাক্ত করেছিলেন। শহিদ জননীর সিলেবাস হাতে নিয়ে শাহাবাগ আন্দোলনকে পড়তে বসলে আমরা আবিষ্কার করি—ইতিহাস কার্যত সরল নয়, বরং জটিল; এবং ইতিহাসবোধ না থাকলে সেই জটিলতার সমাধান করা যায় না। এই যে দিন-তারিখ-ঘটনার সমাবেশে সাজানো ইতিহাসের ডালিতে ‘বোধ’ নথিভুক্ত হলো, অন্তত আমাদের প্রজন্মের কৈশোর-মানসে একাত্তরের দিনগুলিই তার প্রধান কারণ। বইটির প্রথমদিকে জাহানারা ইমামের বয়ানেই আমরা জানতে পারি, রুমী চিনপন্থি কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর মাও সেতুং পাঠের সংবাদও আমাদের জানিয়েছেন জাহানারা ইমাম। কিন্তু পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর জেনোসাইডকে চিন যখন সমর্থন দিল, চিন্তার দেয়াল ভাঙতে একমুহূর্ত সময়ও নেননি রুমী। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন।
এই যে দেশের মাটির গন্ধে, দেশের মানুষের ভাষায় তত্ত্বকে অনুবাদ করতে পারার সক্ষমতা—আমরা কি তা অর্জন করতে পেরেছি? আমরা লোকালি বিবৃতি দিয়ে গ্লোবালি ঢেঁকুর তুলি। না বুঝতে পারি জাতীয়তাবাদ, না বুঝতে পারি আন্তর্জাতিকতাবাদ। তাই আমাদের মননধর্মে কোনো সর্বতত্ত্ব-সমন্বয় নেই। আমরা হয় এসপার, নাহয় ওসপার। আমাদের ধর্ম, আমাদের মত, আমাদের জীবনাচরণের বাইরেও যে সুন্দর একটি পৃথিবী আছে—তা স্বীকার তো দূরের কথা, সহ্যই করতে পারি না। এ কারণেই আমাদের সহিষ্ণুতা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আমরা এখন অনুভূতির রাজনীতি শুরু করেছি; যেহেতু আমরা জেনে গেছি, আমাদের অনুভূতিসমগ্র কার্যত অর্থহীন। অনুভূতি অর্থহীন হলেই আধিপত্যবাদ চাগাড় দিয়ে ওঠে। কোনো-না-কোনোভাবে নিজেকে জানান দিতে হবে তো! রাষ্ট্র যেমন জানান দেয় লালনের গানের দু পঙক্তি শেয়ারকারীকে গ্রেফতার করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যেমন জানান দেয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন করে কিংবা আহমদীয় সম্প্রদায়ের জলসায় আক্রমণ করে, বাঙালি যেমন জানান দেয় আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন করে।
এই বদ্ধ নিদাঘের সময়ে যখন শহিদ জননীর জন্মদিন আসে তখন আমরা ধন্দে পড়ে যাই—আনন্দ হচ্ছে, নাকি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি? কী খতিয়ান নিয়ে দাঁড়াবো তাঁর সামনে? শহিদ রুমী তো জীবনের বিনিময়ে তাঁকে স্বাধীনতা উপহার দিয়ে গেছেন, আর আমরা, কেবল নিজেদের আত্ম-পরিচয়ের সংকটের প্রকট রূপটি তুলে ধরার জন্য প্রতিদিন সেই স্বাধীনতার গলা টিপছি। মায়ের সামনে একজন অপরাধী এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
তবুও এই সকল মূঢ়তা নিয়ে যখন সর্বনাশের আশায় বসে থাকি, তখনও শহিদ জননীই হাত বাড়িয়ে দেন—যেন মধুসূদনের বিলাপ—‘যদিও অধম পুত্র, মা কি ভুলে তারে?’ আমাদের মনে করিয়ে দেন—স্বর্গারোহনের জন্য যুধিষ্ঠিরকেও নরক ভ্রমণ করতে হয়েছিল। আমাদের যাপিত নরকযাত্রায় প্রতিবছর তেসরা মে নেমে এলে শহিদ জননী তাঁর চশমাটি আমাদের দান করেন; প্রত্যাশা করেন আমাদের চৈতন্য-চোখের মায়োপিয়া রোগটি সেরে যাবে। তাঁকে ‘শুভ জন্মদিন’ বলার মতো যোগ্যতা একদিন আমাদের হবে।