বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার লড়াই

মানবসভ্যতার ইতিহাসে পড়েছি— লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, প্রস্তর যুগ, নব্যপ্রস্তর যুগ— গোটা পৃথিবীতে এখন চলছে বিপন্নতার যুগ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ…সব, সবটাই যেন বিপন্নতার কালো স্কার্ফে মুড়িয়ে দিয়েছে কোনো এক অন্ধ জাদুকর। সে নিজে অন্ধকার দেখতে পায় না বলে স্বীকার করে না আলোর অস্তিত্ব। ফলে বিপন্নতার রাত্রি ক্রমাগত গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বিপন্নতার এই অভয়ারণ্যে তবুও কিছু মানুষ আঙুল তাক করে আছেন সূর্যের দিকে; সুতরাং তাঁদের অস্তিত্ব মানেই লড়াইয়ের সূর্যমুখী পঙক্তিসমগ্র এবং যেহেতু এই মানুষগুলোর আজকের প্রতিটি পদ-বিক্ষেপে নথিভুক্ত আছে আগামী দিনের একটি নতুন সকাল, সেহেতু সংখ্যায় কম হলেও তাঁরাই দ্রষ্টব্য; আর সে কারণেই তাঁদের ভালোবাসায় আজও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সহযোদ্ধাদের নামের তালিকা।

সময়টি রাজনৈতিক; বলা ভালো— সময়ের শুরু এবং শেষ এবং এর অন্তবর্তী প্রতিটি মুহূর্ত রাজনৈতিক, মানুষ রাজনৈতিক, মানুষের দুর্দশা-দুঃখ-ক্রোধ-বিদ্রোহ-প্রেম রাজনৈতিক; সুতরাং পৃথিবীর যাবতীয় বিপন্নতাও রাজনৈতিক নিশ্চিতভাবেই। বস্তুত অরাজনৈতিক বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। বিপন্নতার এই কালো স্কার্ফকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে আমরা দেখতে পাই এটি সন্ত্রাসবাদের তন্তুতে বোনা এবং এই সন্ত্রাসবাদ ভূ-রাজনৈতিক সংজ্ঞায় নির্ধারিত। আবার এর শ্রেণিকরণ আছে, আছে শ্রেণিকরণের উপযোগিতাও। কোথাও কোথাও এমন হয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদের একটি সামাজিকীকরণ ঘটানো হয়েছে— অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের জনগোষ্ঠী সুনির্ধারিত একটি ঘটনা ও তার পরম্পরাকে সন্ত্রাসবাদ মনে করে। এই যে ‘সন্ত্রাসবাদ’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদ মনে করা’— দ্বন্দ্বের দু’টো বিন্দু— রাজনীতি এখানেই ক্রিয়াশীল। সুতরাং পৃথিবী নামের ছোট্ট গ্রহটিকে বিপন্ন করে তোলা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটি আমরা যতটা সরল ভাবি, ততটা সরল নয়। মানবতাবাদ একটি ব্যাপ্ত ধারণা, মানবিক দর্শনের উদ্বোধন নিঃসন্দেহে জরুরি— কিন্তু লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে পৃথিবীব্যাপি ‘মানবতাবাদ’-কে একটি অরাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। ফলে সুযোগ পাচ্ছে সন্ত্রাসবাদের মদদদাতারা, ছড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসবাদের বিষবাষ্প।

আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বনাম আন্তর্জাতিক মানবতাবাদ

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের উদ্বোধন নিঃসন্দেহে একটি কার্যকর লড়াই। কিন্তু রাজনৈতিক চোখে দেখলে এই সত্যটিকে এত সহজে মেনে নেয়া যায় না। কারণ রাজনীতি সন্ত্রাসবাদকে যতটা আঞ্চলিক করে তুলেছে, মানবতাবাদকে ততটাই আন্তর্জাতিক করে রেখেছে। এর কারণটা খুঁজতে যাবার আগে সন্ত্রাসবাদের আঞ্চলিক শ্রেণিকরণ ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার সামাজিকীকরণের স্বরূপটি দেখা প্রয়োজন। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে কিউবা কিংবা রাশিয়া সন্ত্রাসবাদের আকর। এই ধারণার একটি সামাজিক রূপও তারা দিতে পেরেছে। ফলে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে যাবতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের চোখে চেগুয়েভারা বা ফিদেল কাস্ত্রো একজন সন্ত্রাসী। প্রায় একইরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যাবে পাকিস্তানেও। গোটা পাকিস্তানের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম যা ভারতীয় ষড়যন্ত্রে ঘটেছে এবং বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা তাদের চোখে একজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। আবার বাঙলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রেই ‘নকশালবাড়ি’ বা ‘সর্বহারা পার্টির আন্দোলন’ প্রসঙ্গে একটি সন্ত্রাসবাদী বয়ান রয়েছে, যদিও সামাজিকভাবে এই বয়ানগুলো খুব একটা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি।

সন্ত্রাসবাদের এই আঞ্চলিক শ্রেণিবিভাজন মোকাবেলায় আমাদের কাছে কোনো পাল্টা তত্ত্ব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের ঘটনা মোকাবেলার প্রশ্নে আমরা বৃহৎ অর্থে মানবিকতার কথা বলি অর্থাৎ একটি রাজনীতি বিবর্জিত বক্তব্য দেই, যা আদতে কোনো কাজে লাগে না। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে অসংখ্য নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। নাফ নদীর ওপারেই এরা সন্ত্রাসী আর এপারে তারা উদ্বাস্তু। এখন মানবিকতার প্রশ্নে এদের আশ্রয় দেয়া, তাদের সাহায্য করার চেয়ে বড় কোনো দাবি নেই। কিন্তু যদি এই ঘটনার আভ্যন্তরীণ রাজনীতি তলিয়ে দেখতে যাই তবে বোঝা যাবে— ঘটনা যতটা সরল ভাবছি, ততটা নয়। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ইন্টারনেটে একটু খুঁজলেই পাঠক জানতে পারবেন। আবার মায়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের রাজনীতিও কারও অজানা নয়। বাঙলাদেশে এসে রোহিঙ্গারা নানাবিধ অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে, সবচেয়ে বড় কথা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে— এ তো বাঙলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাহলে ‘মানবতার কোনো সিলেবাস নেই’ টাইপের বায়বীয় ও অসাড় বক্তব্য দিয়ে কি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব? একই ঘটনা ১৯৭১ সালে ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রেও সত্য ছিলো। সুতরাং মানবতার যে আন্তর্জাতিকতাবাদ, তা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের এই জার্গনগুলো মোকাবেলা করা সহজ হবে না। এজন্য আঞ্চলিক পর্যায়েও মানবতাবাদের একটি পরিকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, এ বিষয়ে রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলে কেমন হয়। নেবে না— কেনো নেবে না, সেটা জানানোর আগে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদের চাষাবাদ হয়। এতে রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত রাজনীতির অনেক সুবিধা হয়। ভূ-রাজনীতির যে তত্ত্বগুলো আমরা এতোকাল ধরে পড়ছি জানছি, তার একটি নতুন রূপ তৈরি হয়েছে আজকাল— ‘রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র’, যা ভূগোল নিরপেক্ষ। যেমন: মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বললে মোটা দাগে যা যা মনে হবার কথা, তার কোনোটাই সৌদি আরবের ক্ষেত্রে খাটে না। সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞাও মধ্যপ্রাচ্যের সকল রাষ্ট্রের কাছে এক নয়, যেমন এক নয় দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে। যেমন বাঙলাদেশ দক্ষিণ এশীয়ভুক্ত রাষ্ট্র হলেও ইসরাইলের সঙ্গে তার কোনো রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক-সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ নেই; অথচ সৌদি আরবের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা আছে ইসরাইলের সঙ্গে। বাঙলাদেশের চোখে ইসরাইল এতো বড়ো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যে, তার পাসপোর্টে লেখা থাকে ‘অল কান্ট্রিস অ্যাকসেপ্ট ইসরাইল’। কিন্তু ইসলামের জিম্মাদার সৌদি আরবের কাছে ইসরাইল হলো ব্যবসায়িক পার্টনার।

সন্ত্রাসবাদের আগ্রাসন: বিশ্ব ও ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব

‘গোটা বিশ্ব এখন সন্ত্রাসবাদের কবলে’— এই বাক্যটি আমার কাছে ততটা মারাত্মক মনে হয় না যতটা মনে হয় এই বাক্যটি শুনলে— ‘বিশ্বের মানুষ এখন মগজে সন্ত্রাসকে লালন করে’। বস্তুত সন্ত্রাসবাদের আধিপত্য এখন ব্যক্তির মগজে; মানুষ মননে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদকে লালন করছে যা আগামী পৃথিবীর জন্য একটি ভয়াবহ ঘটনা। একজন ফিলিস্তিনী শিশু এইটা জেনে বড় হয় যে, তারই সঙ্গে বড় হওয়া ইসরাইলী শিশুটি সন্ত্রাসী; একই কথা ইসরাইলী শিশুটির জন্যও প্রযোজ্য।

সন্ত্রাসবাদের সাংগঠনিক রূপ মূলত ব্যক্তিমানসে বিদ্যমান সন্ত্রাসবাদের প্রলম্বিত রূপায়ন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যতটা তৎপর হয়েছে, তার চেয়ে বেশি তৎপরতা লক্ষ করা গেছে ইসরাইলবিরোধী মানসিকতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জঙ্গীগোষ্ঠীর মধ্যে। আশির দশক থেকে গোটা পৃথিবীতে ইসলামের নামে পাশ্চিমাবিরোধী তকমা ঝুলিয়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সূচনা ঘটেছে। এর সূচনা যারা করেছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা বা তাদের প্রতিনিধিদের দোসর হিশেবেই কাজ করেছে।

আন্তর্জাতিক ইসলাম ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের একটি বঙ্গীয়রূপ প্রত্যক্ষ করা যায় বাঙলাদেশে। ‘হিন্দুবিরোধীতা’-কে পুঁজি করে সেই সাতচল্লিশ থেকেই এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলমান। একাত্তরে বাঙলাদেশ যখন রাষ্ট্র হয়ে উঠছে, তখন ‘হিন্দুত্ববাদ’ ‘ভারতীয় আগ্রাসনবাদ’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো। বাঙলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান এই তিন দেশের রাজনৈতিক তিনটি গ্রাফ খুব মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই— পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবর্তিত হয় ‘ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ’-কে পুঁজি করে, বাঙলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবর্তিত হয় ‘ভারতীয় আগ্রাসনবাদ’-কে পুঁজি করে (এখানে কিন্তু হিন্দুত্ববাদ প্রাধান্য পায় না) এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবর্তিত হয় জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে বর্তমানে যেটি হিন্দুত্ববাদেরই নামান্তর। এই জটিল অবস্থা কেবল রাজনীতিতেই বিদ্যমান নয়, তা ক্রমে ক্রমে ঠাঁই নিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রজন্মের মগজে। কারণ এর ওপর ভিত্তি করে রাজনীতিও চলছে পুরোদমে। বাঙলাদেশে বিএনপি-জামাতের রাজনীতির মূলকথাই হলো ভারত বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগানো। সুতরাং তাদের শকুন সময়ে বাঙলাদেশে বিপুলভাবে সাম্প্রদায়িকতার চাষ হয়েছে, সেখানে জল ঢেলেছে এদেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা একদল মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাব।

মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাঙলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা খুব বেশিদিন হয়নি। শাসনব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা শুরু হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকেই। একে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি গড়ে উঠেছে (মূলত তা ছিলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতি) তা জন্ম দিয়েছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের।

সুতরাং মগজের কোষে কোষে সন্ত্রাসবাদের বিষ চালান করে দেবার যে কূটচাল, তাকে প্রতিহত করার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। সেটা না করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধই আমরা ঘোষণা করি না কেনো, সেগুলো ফলপ্রসূ হবে না। এখন ক্রিয়াশীল রাজনীতি এ কাজটি করছে না, তা তো আর আমাদের অজানা নয়। তাহলে প্রয়োজন হচ্ছে রাজনীতির পরিবর্তন। কিন্তু পাঠক লক্ষ্য করুন— যে মুহূর্তে আমি লিখছি ‘রাজনীতির পরিবর্তন প্রয়োজন’, সেই মুহূর্তেই আপনি মনে করছেন— এ তো পুরোনো কথা। সুতরাং সন্ত্রাসবাদ দমনে ‘রাজনীতির পরিবর্তন’ প্রসঙ্গে একটি সম্প্রসারণমূলক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো প্রয়োজন বলে মনে করছি।

রাজনীতিতে সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ

‘পুনর্জাগরণ’ বলছি, কেননা রাজনীতিতে সংস্কৃতির যে একটি বড় প্রভাব ছিলো, তা গোটা উনিশ শতক ও বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজনৈতিক পাঠ থেকে যে কোনো পাঠকের কাছেই পরিস্কার হবে। দু’টো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যাবার পরও লালন, রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, নজরুল থেকে পল রবসন, জোয়ান বায়েজ, বব ডিলান, বিটল্স বা ব্রেখট বিশ্ব রাজনীতির পট-পরিবর্তণ করেছেন। আমি যদি ভুল না করি তবে বিনির্মাণবাদ ষাটের দশক থেকে বেহাত হতে শুরু করে এবং নব্বইয়ের দশকে তা মুৎসুদ্দির কব্জাগত হয়। ফলে রাজনীতিতে শিল্প নয়, শিল্পপতিদের প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং রাজনীতির চেহারা বদলে যায়।

এই বদলের বর্তমান রূপটি কেমন তার একটি উদাহরণ দাঁড় করানো যেতে পারে। ১৯৯০ সালে অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বরের প্রথম দিকে বারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই সংবাদ ছড়িয়ে বাঙলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নারকীয় নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতনে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ মৌলবাদী ও জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো অংশ গ্রহণ করেছিলো। ধর্মীয় উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে সেদিন ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো মৌলবাদী গোষ্ঠী। একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেদিন সাম্প্রদায়িক মুসলিমরা যে অপকর্ম করেছিলো, তা নজিরবিহীন।

ঠিক ২৮ বছর পরে আরেকটি খবর আমাদের সামনে আসে। ১৯৯০ সালে কোনো ইন্টারনেট ছিলো না, কিন্তু এখন তো সব খবর বাতাসের আগে এসে পৌঁছায়। সম্প্রতি আসামের নাগরিকত্ব সংকটের যে সংবাদ আমরা পাচ্ছি, সে বিষয়ে বাঙলাদেশের মানুষের মনোভাব কী? ফেসবুক-টুইটার বা বিভিন্ন ব্লগ খুঁজলেই পাঠক এর উত্তর পাবেন। ভাষার প্রশ্নে, সংস্কৃতির প্রশ্নে, নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে যেখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থাকা উচিৎ ছিলো, সেখানেই আমরা পাথরসম নিশ্চুপ। বরং কিছু কিছু মধ্যমেধার অতিবুদ্ধিজীবীরা ‘আসামের বাঙালিরা বাঙলাদেশে আসলে কী হবে?’ টাইপের কলামও লিখছেন। এখন তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করা হোক রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে, লিটমাস টেস্ট হয়ে যাবে। একসময় বাঙলা ব্লগে একটি কথা খুব প্রচলিত ছিলো— ‘ল্যাঞ্জা (লেজ) ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড’। তো এইসব মধ্যমেধার অতিবুদ্ধিজীবীদের ল্যাঞ্জা বেড়িয়ে যায়; তারা বলে— রোহিঙ্গারা তো মুসলিম।

অর্থাৎ যেকানে সাংস্কৃতিকভাবে সাড়া দেয়া উচিৎ ছিলো, সেখানে আপনি ধর্মীয়ভাবে সাড়া দিতে চাইছেন, এমনকি অন্যদেরও সে পথে হাঁটার পরামর্শ দিচ্ছেন— আপনার এই সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের সবচেয়ে বড় কারণ এবং আপনার এই মানসিকতা নির্মাণের কারণ হলো সংস্কৃতি বিবর্জিত বর্তমানের ক্রিয়াশীল রাজনীতি।

এখন প্রশ্ন হলো, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার জন্য রাজনীতিতে সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব কীভাবে? বহুবছর যাবৎ আমরা সংস্কৃতি বলতে একটি ‘পারফর্মিং আর্ট’ বুঝে আসছি, যেটা একই সঙ্গে একটি গিমিক এবং একটি মহাভুল। ফলে সংস্কৃতির দর্শন আড়ালে পড়ে গেছে। আমাদের চর্চায় রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে কিন্তু যাপনে রবীন্দ্র-দর্শন নেই। আমাদের উদযাপনে লালনের গান আছে কিন্তু বেঁচে থাকায় লালনের দর্শন নেই। সুতরাং চর্চা ও উদযাপন খুব ভালো হচ্ছে কিন্তু যাপন ও বেঁচে থাকা হচ্ছে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের চর্চায় সন্ত্রাসবাদ নেই, আমরা কেউ সন্ত্রাসবাদের চর্ছা করি না; আমাদের উদযাপনেও সন্ত্রাসবাদ নেই, বরং আমরা সন্ত্রাসবাদবিরোধী নানা উদযাপন করে থাকি কিন্তু আমাদের যাপন ও বেঁচে থাকার পুরোটাই সন্ত্রাসবাদের টানেলে, কেননা সেই স্থানটি আমরা সংস্কৃতির দর্শনবিবর্জিত একটি শূন্য ভাগাড় বানিয়ে রেখেছি। সংস্কৃতির দর্শনে যদি এই শূন্যস্থানটুকু পূরণ হয়, তাহলে আমাদের চিন্তা-প্রসূত পথই নির্মাণ করবে সংস্কৃতি নির্ভর রাজনীতির ইশতেহার। আর সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ের পথই হবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক প্রবল হাতিয়ার।

ফুটনোটে সন্ত্রাসবাদের একটি আধুনিক প্রপঞ্চ

মনে হতেই পারে, সন্ত্রাসবাদের নানা প্রকরণ ও প্রক্রিয়া থাকার পরও কেনো একটি আলাদা প্রপঞ্চ সম্বন্ধে পৃথকভাবে আলোচনার প্রয়োজন হলো। হলো কারণ— আমার ব্যক্তিগত পর্যালোচনা হলো, সন্ত্রাসবাদের ধরন যেভাবে বদলেছে, তাকে প্রতিহত করার রাজনীতি সেভাবে বদলায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসবাদের নানা ধরণের মধ্যে বহুল আলোচিত ও ভয়াবহ একটি প্রকার হচ্ছে ‘সাইবার সন্ত্রাস’। বিশ্বব্যাপি সাইবার সন্ত্রাসবাদ এখন রীতিমতো এক যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে। তবে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে ‘সাইবার সন্ত্রাসবাদ’-কে যতোটা নতুন মনে করা হচ্ছে, ব্যাপারটি আদতে তা নয়। নব্বই দশকের একেবারে মদ্যভাগ থেকেই এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ দেখা দিতে থাকে। ব্যারি সি কলিনের দেয়া ঈুনবৎ ঞবৎৎড়ৎরংস নামটি তখন থেকেই সারা পৃথিবীতে আলোচিত হতে থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একবিংশ শতাব্দী আমরা শুরু করেছি সাইবার সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা ‘মিলিনিয়াম বাগ’- এর মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ সাইবার সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করা শুরু করলেন মূলত ২০০০ সাল থেকে, যখন এর সঙ্গে রাজনৈতিক মতবাদ যুক্ত হতে লাগলো। কিন্তু ১৯৬৩ সাল থেকে নানাভাবে রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গোপন নথি ফাঁস হবার ঘটনাগুলোও সাইবার সন্ত্রাসবাদ হিশেবে বিবেচিত হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুনভাবে সংঘটিত এই সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে আমাদের ভাবনা কী? এই ধরনের সন্ত্রাসবাদ দমনে আজ অব্দি যতগুলো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হযেছে, তার সবগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে (যেহেতু সাইবার সন্ত্রাসবাদের প্রধান টার্গেট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম)। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের আধিপত্যবাদকে কায়েম রাখার জন্যই সাইবার সন্ত্রাসবাদকে দমন করতে চাইছে কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে একইসঙ্গে সে এই সন্ত্রাসবাদকে কাজে লাগাচ্ছে নিজের প্রতিপক্ষ দমনে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশীয়াসহ আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো কতোটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আছে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ক্যামব্রিজ অ্যানালেটিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন তো বটেই ভারত-শ্রীলঙ্কা এমনকি বাঙলাদেশের আসন্ন নির্বাচনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অবৈধভাবে তথ্যচুরির মাধ্যমে জনমনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এই বিশ্লেষণ কাজে লাগানো হচ্ছে উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন নির্বাচনে। ফলে গণ-মানুষের ভোটের অধিকার এক ধরনের প্রহসনের শিকার হচ্ছে। বস্তুত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কারা থাকবে বা থাকবে না, কোন আদর্শের প্রতিফলন ঘটবে বা ঘটবে না— তা নির্ভর করছে কতোগুলো তথ্য বিশ্লেষক দানব কোম্পানির ওপর।

সাইবার সন্ত্রাসবাদ কেনো সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত একটি প্রকরণ; তার ব্যাখ্যা হলো— সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, বর্ণগত বা লৈঙ্গিক সন্ত্রাসবাদ এক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ রাজনীতি এখানে মাতৃকোষ হিশেবে কাজ করে। কিন্তু সাইবার সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সে রাজনীতির ডিএনএ কোড পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখছে। ফলে সাইবার সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক মাতৃকোষকে পরিবর্তন করা সম্ভব। বাঙলাদেশে জামাত-বিএনপি বা ভারতে বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক উগ্রগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসলে কী কী সন্ত্রাসবাদের বিস্তার হতে পারে তার একটি ঐতিহাসিক দলিল এই রাষ্ট্রের জনগণের কাছে আছে। কিন্তু সাইবার সন্ত্রাসবাদ চাইলে জনমানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে এমন একটি ধারায় প্রভাবিত করতে পারে, যাতে করে বিজেপি বা জামাতের মতো সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মানুষ ঘৃণা করলেও ভোটের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। ২০০৫-২০১৩ সাল পর্যন্ত বাঙলাদেশে জামাত-শিবিরের সাইবার সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ আমরা দেখেছি। সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারণার কৌশলগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃষ্টি রাখলেই বোঝা যাচ্ছে। বাঙলাদেশে জামাত-শিবির কর্তৃক পরিচালিত সাইবার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা যুদ্ধ করতে হয়েছিলো শাহাবাগকে ২০১৩ সালে। সাইবার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি সাইবার রাজনীতি। যদিও তা পরিপূর্ণভাবে করা যায়নি কিন্তু বলাইবাহুল্য, তা থেকে এ বিষয়ে এক ধরনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দাঁড় করানো যেতে পারে। ভবিষ্যতের গবেষকগণ নিশ্চয়ই এ নিয়ে কাজ করবেন।

সন্ত্রাসবাদ কথাটি শুনলে এককালে যেমন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, বাহিনীর বিরুদ্ধে বাহিনী— এমন মনে হতো, এখন আর তেমন মনে হবার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপি নারীর বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চলছে, বিভিন্ন জাতির ওপর যে নিপীড়ন চলছে, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ যেভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে— সেগুলো থেকে সন্ত্রাসবাদ এখন এক ‘মাইক্রো ফরম্যাটে’ রূপ লাভ করেছে। ফলে পারিবারিক নির্যাতন বা ব্যক্তিগত আক্রোশ বা শিশু নিপীড়নের ঘটনাগুলোও এক ধরনের আধিপত্যবাদপ্রসূত সন্ত্রাসবাদ। একে মোকাবেলা করার জন্য তাই ব্যক্তিগত শোবার ঘর থেকে জাতিসংঘের অধিবেশন কক্ষ অব্দি কাজ করা চাই। রাজনৈতিক চোখে ব্যক্তিগত ঘটনার বিশ্লেষণগুলোও জরুরি।

পৃথিবীটা ছোটো হয়ে আসছে— তা আসুক; কিন্তু পৃথিবীটা যেনো একা না হয়ে যায়।

২০ অগ্রহায়ন ১৪২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *