অনেক দিন ধরেই আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এই আইন কেবল যে চিন্তার প্রকাশের পথে প্রতিবন্ধক নয়, এর অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, আইসিটি আইনের এই ৫৭ ধারা যতটা না অন্যায়-অবিচার রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থে। আইনের নিজস্ব রাস্তা আছে এবং তার ওপর ভিত্তি করেই আইন চলবে—এমন দাবি আইনজ্ঞরা সব-সময়ই করে থাকেন। কিন্তু আইনের কোনও ধারা যখন ব্যক্তির হীন-উদ্দেশ্য হাসিলের রাস্তা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সমানভাবে অপমানিত হয় আইনও।
গত কয়েক বছরের প্রেক্ষাপটে আমরা লক্ষ করেছি, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ভয়াবহভাবে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা মতো কখনও রাষ্ট্র এটি ব্যবহার করেছে, কখনও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত উচ্চপদস্থরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যদিও ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি বহুদিন ধরে করে আসছেন রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিকরা ও আইনমন্ত্রীও বলেছেন, এই আইন থাকছে না। তারপরও আমরা দেখছি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের কারণে একের পর এক বলি হচ্ছেন লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, অনলাইন অ্যক্টিভিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীসহ অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেহেতু এখন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে, তাদের দমন করতে ৫৭ ধারা হয়ে উঠেছে মোক্ষম ছল। অনলাইনে কোনওঅন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হচ্ছে। কখনও ব্যক্তিগত কারণে, কখনও রাজনৈতিক কারণে এই ধারার সুযোগ নিচ্ছে সমাজের নানা স্তরের অপরাধীরাও। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তি বিষয়ক প্রপঞ্চ।
কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাঙামাটি জেলা শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক চায়না পাটোয়ারী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা শাওন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করে ছাত্রলীগকর্মী এহসান উদ্দিন। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে চায়নাকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণ হলো, তারা রাঙামাটির লংগদুতে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ করে ইন্টারনেট মাধ্যমে লেখালেখি করেছেন। যে ভয়াবহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়েছেন, তার কোনও প্রতিবিধান না করে উল্টো প্রতিবাদকারীদেরই গ্রেফতার করা হলো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এই আইনকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই আইনের প্রয়োগ কোথায় কোথায় করা হয়েছে, গণমাধ্যম থেকে তার একটি তথ্য-বিবরণী যদি তৈরি করা যায়, তবে দেখা যাবে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আইনটি প্রয়োগ করা হয়েছে মুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদকারীদের ওপর। ব্লগারদের বিরুদ্ধে এই আইনের প্রয়োগ চালিয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। এখন একের পর এক গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন মহলই কেবল নয়, এখন ব্যক্তি পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে অনুভূতি-আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। অন্যায়কারীর অন্যায়কে গণমাধ্যমকর্মীরা গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলেই অন্যায়কারীর অনুভূতি আক্রান্ত হয়। ‘অনুভূতি’, ‘ভাবমূর্তি’ ইত্যাদির বিষয়ে যারা স্পর্শকাতর, তারা অন্যায় কাজ না করলেই পারেন। কিন্তু তারা অন্যায় করবেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন, আর তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই ৫৭ ধারায় মামলা করবেন। যে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই দমন-পীড়নের সুযোগ করে দেয়, সে রাষ্ট্র কখনোই মানবিক মর্যাদার রাষ্ট্র হতে পারে না।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনসহ চার জনের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী হযরত আলী বেলাল। মামলায় অন্য যে তিন জনকে আসামি করা হয়, তারা হলেন—অথৈ আদিত্য, তারিখ রহমান ও নুশরাত জাহান ইশিতা। সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী যে অভিযোগ করেছেন, সেটা যদি অভিযোগ হয়, তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী প্রত্যেকেই, যারা বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তারা সবাই এমন অভিযোগের ভাগিদার। গত ২৮ জুন সাংবাদিক নাজমুল হোসেন ‘বিচারপতির লাল সিঁড়ি ও দেলোয়ারের ক্র্যাচ’ শিরোনামে যে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলেন, সবার মতো আমিও সেটি দেখেছি এবং পুনর্বার একজন গণমাধ্যমকর্মীর দায়িত্বশীল আচরণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছি। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সমাজের নানা স্তরের নানাবিধ বৈষম্যের মধ্যে যেটি তার সামনে ঘটছে, তা তিনি প্রকাশ করেছেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকর্মীদের এই ধরনের কাজ নতুন কিছু নয়। প্রতিটি গণমাধ্যমের যেহেতু নিজস্ব নীতিমালা থাকে, তাই অনেক সময়ই গণমাধ্যমে সামাজিক অন্যায়ের অনেক কিছু ওঠে আসে না বা এলেও তার সম্পূর্ণ রূপ আমরা পাই না। সেক্ষেত্রে‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ ধারণাটি সারা পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে দিনকে দিন। পৃথিবীর নানা খ্যাতনামা গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার তাৎক্ষণিক বিবরণ থেকে শুরু করে অনুসন্ধান পর্যন্ত নানা কিছু তুলে ধরেন। বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যমকর্মীর ফেসবুক টুইটার পোস্ট থেকেও আমরা অনেক ঘটনার তাৎক্ষণিক বিবরণ পাই। নাজমুল হোসেন তার ফেসবুকে যে পোস্টটি দিয়েছিলেন তিনি তার প্রত্যক্ষদর্শী। লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবিও তিনি যুক্ত করেছেন। ব্যাপারটি এমন নয় যে, তিনি কোনও ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন; তিনি যে শিরোনামটি দিয়েছেন, তার মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে মানবিকতার উদ্বোধনের প্রসঙ্গ রয়েছে। তাহলে তিনিসহ যে চারজনের নামে ৫৭ ধারায় মামলাটি হলো, সেটি কেন? তথ্যের ভুল ছিল না, বক্তব্যের কোথাও অপেশাদারসুলভ কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয়নি—তাহলে মামলা দায়ের কেন?
এর উত্তরটি পাওয়া যাবে, মামলার বাদীর উল্লিখিত বিবরণ থেকে। গণমাধ্যমসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মামলার বাদী বিবরণে উল্লেখ করেছেন যে—স্ট্যাটাসটিতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে বিচারপতি, বিচারক ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাশীল সচেতন বিবেকবান জনগণের মানহানি সংঘটিত হয়েছে (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন: জুলাই ০৫, ২০১৭)। কী অবলীলায় বাদী নিজেকে ‘সচেতন বিবেকবান জনগণের’ প্রতিনিধি বানিয়ে ফেললেন!
‘সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত বিচারপতিকে’ একজন ভিক্ষুকের সঙ্গে তুলনা করার অভিযোগও করেছেন মামলার বাদী। বাদীর এই বক্তব্য তো সরাসরিভাবে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) পরিপন্থী, কেননা সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট বিধান আছে—“কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।” যেখানে সংবিধান কোনও ধরনের বৈষম্যকে স্থান দেয়নি, সেখানে মামলার বাদী একজন আইনজীবী হয়েও কিভাবে তা লঙ্ঘন করেন?
এর আগেও বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারাতেই মামলা হয়েছিল।
এই ইঙ্গিতগুলো ক্ষতিকর। আমরা যেনো ভুলে না যাই, সভ্যতা যেমন আদালতের ন্যায়বিচারের ইতিহাসে ঋদ্ধ হয়েছে, তেমনি স্টার চেম্বারের নিপীড়নেও আক্রান্ত হয়েছে।