লেখার শিরোনামটি আসলে আমাদের বর্তমান অবস্থারই একটি প্রবচনিক রূপ, সাম্প্রতিক বাঙলাদেশের চালচিত্র। ‘কোথায় দাঁড়িয়ে বাঙলাদেশ?’— এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। মনে হচ্ছে, আমরা প্রত্যেকেই যেনো বাস করছি একটি দুঃস্বপ্নের মধ্যে, ভয়াল মেঘমালার নিচে আমাদের ত্রস্ত চলন। ২০১৫ সালের অর্ধেকও শেষ হয়নি, অথচ তিনজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করা হলো নৃশংসভাবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার সময় টিএসসি প্রাঙ্গনে লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু এবং সর্বশেষ ১২ মে লেখক-ব্লগার ও বিজ্ঞানমনষ্কতার ছোটো কাগজ যুক্তির সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাপাতির আঘাতে নিহত হন। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মে— এই পঁচাত্তর দিনে তিনজন ব্লগার-লেখক ও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে, একই পদ্ধতিতে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। অভিজিৎ রায়কে তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই হত্যা করা হয়। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামি জঙ্গীগোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ হত্যার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেবার জন্য অনলাইনে নানা অপগোষ্ঠীর অপতৎপরতা দেখা যায়, তারপরও রাষ্ট্র নামক কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙে না। গণমাধ্যম কয়েকদিন বিষয়টি নিয়ে তৎপর থাকে, তারপর অন্য আরেকটি ইস্যু সামনে এলে এ ঘটনাগুলো চলে যায় পর্দার আড়ালে। লক্ষ্যণীয়, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগুলো এক; প্রতিক্রিয়াগুলোও প্রায় এক। একটি বিভৎস হত্যাকাণ্ডের পর যেখানে প্রশ্ন উঠা উচিৎ ছিলো— হত্যাকারী কারা, তাদের কবে আইনের আইনের আওতায় আনা হবে— সেখানে প্রশ্ন উঠেছে, ‘এরপর কে?’ এই প্রশ্নটি কেবল একটি প্রশ্নই নয়, রাষ্ট্রের নাগরিক হিশেবে আমাদের সার্বিক হতাশা আর অসহায়ত্বেরই প্রকাশ।
আলোচনাটি ২০১৫ সাল দিয়ে শুরু হলেও, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে আরও আগেই। প্রথাবিরোধী লেখক ও বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয় ২০০৪ সালে, ফেব্রুয়ারি মাসেই, বইমেলার সময়েই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই। ওই বছরেই আগস্টে মৃত্যুবরণ করেন এই ক্ষুরধার লেখক। একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মোঃ ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হবার পর হত্যা করা হয় অগ্রনী ব্যাংকের লিফটম্যান জাফর মুন্সী; তাঁকে হত্যার একদিন পরই হিংস্র আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দারকে। একই বছর ০২ মার্চ সিলেটে জগেজ্যাতি তালুকদারকে হত্যা করা হয়। আরিফ রায়হান দ্বীপকেও হত্যা করা হয় ২০১৩ সালেই। এরপর ২০১৫ সালে মাত্র পাঁচ মাসে তিন তিনজন মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা। এ যেনো হত্যাকে উৎসব ভেবে মৌলবাদী আর জঙ্গী অপগোষ্ঠীর নিদারুণ বিভৎসতা আর সামগ্রিক বিষয়গুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা ভেবে রাষ্ট্রে ভয়াবহ নির্লিপ্ততা। এ হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনোটিরই কোনো সুরাহা এখনও হয়নি। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে চলতে পথ হারালো কি না, তাও আমরা জানি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আপোসহীন মুক্তচিন্তার এই মানুষগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে একে একে, আর ক্রমশ মেধাহীনতার দিকে পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা।
রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বিএনপি-রাজাকার জোট সরকার ক্ষমতায় ছিলো। আমাদের খুঁড়িয়ে চলা বাক-স্বাধীনতাকে লাশঘরে পাঠিয়ে তারা প্রগতিশীল ও মুক্তমনের চর্চার ওপর নামিয়ে আনলো চাপাতির অন্ধকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যুক্তিবাদী ও মুক্তমনের মানুষরা তখন ছিলেন প্রতিদিন মরে বেঁচে থাকার মতো। ২০০১ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে হাত-পা বেঁধে জবাই করার চেষ্টা করে মৌলবাদী হিংস্র নরপশুরা, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান আজিজুল হককে ‘সেক্যুলারিজম ও শিক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেয়ার জন্য ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে হত্যার হুমকি দেয় এই অসুস্থ কৃমিরা। মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদকে পুঁজি করে তৎকালীন বিএনপি-রাজাকার সরকার বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলো মানুষের মুক্তচিন্তার দুয়ার, স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলো দ্বিমত হওয়া কণ্ঠস্বর। কিন্তু যে মনন যুক্তি আর চিন্তার সুরসুতায় সাজানো, তার সামনে উধাও হয়ে যায় মগজের ব্যারিকেড। অচলায়তনের বদ্ধ পৃথিবীকে চিন্তাশীল মানুষই প্রশ্নের করাঘাতে মুক্ত করে। শাসক চাইলে রাষ্ট্রীয় ঘড়ির সময় বদলে যেতে পারে, কিন্তু লেখকের কলম, ব্যক্তির চিন্তা— কখনোই না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে নিশ্চিতভাবেই জনমানুষের মাঝে নানা কারণে আশার সঞ্চার হয়। বিশেষ করে মুক্তচিন্তার বহুমাত্রিকতায় যে যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজের স্বপ্ন দেখেন চিন্তাশীল মানুষেরা, তাঁদের মাঝে একটি স্বস্তি কাজ করে। আমরা আশাবাদী হই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে, জামাত-শিবির নিষিদ্ধের প্রসঙ্গে, হুমায়ুন আজাদের হত্যামামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে। সময় যেতে থাকে, আমাদের প্রত্যাশার যেটুকু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সমান্তরালে হাঁটে, সেটুকু কোনোমতে টিকে থাকে; আর বাকিটুকু লবডঙ্কা! সময়ের সঙ্গে পলেস্তার খসে পড়ে, ইতিহাস মুখ বের করে জানান দেয়— ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’- এর নাম একসময় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ছিলো। নাম বদলেছে, ধর্ম বদলেছে কি?
এই বছর মাত্র পঁচাত্তর দিনের মধ্যে তিনজন ব্লগারকে হত্যা করা হলো। অভিজিৎ রায় ও অনন্ত দাশ বিজয়ের ব্লগগুলো আমার পড়া। তাঁদের বইগুলোও পড়েছি প্রকাশ হবার পরপরই। অনিয়মিতভাবে যুক্তি পড়েছি যখন সুযোগ হয়েছে। চিন্তা আর যুক্তির মণিকাঞ্চনে তাঁরা তুলে ধরেছিলেন তাঁদের অভিমত। তাঁদের কোনো বক্তব্য জোর করে চাপিয়ে দেননি। নিশ্চিত সুযোগ ছিলো আলোচনা করার, হয়েছেও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চিন্তাশীল মত প্রকাশের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের এই যে বিভৎসতা, তার প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের অবস্থান কোথায়? এতো অষ্পষ্টতা কেনো? ব্লগারদের যখন গ্রেফতার করা হয়েছিলো, তখন তো বেশ আলুথালু মুখ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘ইসলাম রক্ষা’ করেছিলেন। তিন তিনজন ব্লগারকে হত্যা করা হলো একই কায়দায়, দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিলো জঙ্গীবাদী অপগোষ্ঠী; এখন তাদের তদন্ত কমিটি, গ্রেফতারি পরোয়ানা কোথায়? আম-কাঁঠালের ছুটিতে?
এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পর আরেকটি গোত্র চোখে পড়েছে অনলাইনে ও টক শোগুলোতে। অনেক বড়ো বড়ো মানুষদের ছোটো বড়ো কথাগুলোর সারমর্ম ছিলো অনেকটা ওই অন্ধের হাতি দেখার মতো। প্রত্যেকেই ধর্মানুভূতি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। ‘কী করিলে কী হইতো’ জাতীয় উপদেশ দিয়েছেন। ‘শুড ডু’ আর ‘শুড নট ডু’ শিখিয়েছেন। কিন্তু আদতে এসব ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ জাতীয় আলোচনায় পর্যবসিত হয়েছে। এতে কার হালে পানি পড়লো? মতের অমিল থাকলে সেটাও প্রকাশ করা যায়। আজকে যারা ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ জাতীয় স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, বুলি আওড়াচ্ছেন, তারাও অভিজিৎ রায়, অনন্ত দাশ বিজয়ের স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্ট দিয়েছেন। বাঙলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের দেশ— এই তত্ত্ব যারা প্রচার ও প্রকাশ করছেন, তারাই যখন আবার ‘অসাম্প্রদায়িক’ কথাটি উচ্চারণ করেন, নিজেদেরই হাসি পায় না? স্বীকার্য, মত প্রকাশের সঙ্গে দায়িত্ববোধের একটি গভীর সংযোগ আছে কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না, প্রকাশিত মতামতটির মুখোমুখি হবার জন্য পরমতসহিষ্ণুতারও গভীর সংযোগ আছে। আপনার মতের সঙ্গে না মিললেই যদি আপনি আমাকে ‘দায়িত্ববোধের’ কথা স্মরণ করিয়ে দেন, আপনাকেও তাহলে মনে রাখতে হবে আমার মতামতটির মুখোমুখি হবার মতো সহিষ্ণুতা আপনার থাকতে হবে— মেনে নেয়া বা না-নেয়াটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। সুতরাং এই বিভৎস হত্যাকাণ্ডের পর যারা এই বক্তব্যগুলো তুলে ধরছেন, ‘নাস্তিক’- এর মতপ্রকাশের ভঙ্গি নিয়ে কথা বলছেন, তারা যদি ‘আস্তিক’- এর পরমতসহিষ্ণুতা নিয়েও কথা বলতেন, তবে দেখাটা দু চোখ দিয়েই হতো। এক চোখে দেখে দেখে আমরা তো অনেক সম্ভাবনাময় মেধাবী মানুষদের হারালাম, এবার দু চোখ দিয়ে দেখি, না হলে একসময় অন্ধত্ব বরণ করে পঙ্গুত্বকেই নিয়তি মানতে শুরু করবো। তখন ঘোর নিয়তিবাদীরাও বলবেন, পঙ্গুত্বের পিছনের কারণ অন্ধত্ব, তার পেছনের কারণ— একদিন আমরা এক চোখ দিয়ে সব বিচার করতাম।
মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটি নিতান্ত ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ। সামান্য ভূমিকম্পেই দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো কেমন সহজে ভাঙে আমাদের যত্নে বানানো সভ্যতা। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন এসব কিছুর পেছনেই রয়েছেন একজন, আমি হয়তো মনে করি, কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। কিন্তু আমার আপনার বাইরে ওই ‘ওরা’— যারা নির্দয় হত্যালীলায় নিজেদের বেহেশত নিশ্চিতের আফিমে বুঁদ— তারা কিন্তু আমাকে হত্যা করার পর আপনাকেও খুঁজবে। কারণ, তারা ‘আস্তিক’ নয়, ‘নাস্তিক’নয়; তাদের পরিচয় একটাই, তারা হত্যাকারী। কেবলই হত্যাকারী। উন্মাদ ও বিকারগ্রস্থ। আপনি বিশ্বাসে স্থির, তারা ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে’ আক্রান্ত। সুতরাং আপনিও নিরাপদ নন তাদের হাতে। যাঁরা ভাবছেন, কদিন পরেই সব চুপচাপ হয়ে যাবে আগের মতো, নতুন ইস্যু নিয়ে আলোচনায় মত্ত হবে গণমাধ্যম; তাঁদের বলছি, এমনকি বলছি আমাকেও, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতিবাদ আমাদেরই করতে হবে। আমাদেরই, কারণ শেষ পর্যন্ত আমরাই ভিকটিম। রাজনীতিবিদরা দু একটা ইঁদুর ধরার গাঢ় সমাচার নিয়ে শোনাবে পেঁচার বাণী, উচ্ছিষ্টভোগীরা বগল বাজাবে পূর্বতন অভ্যেস মতো আর কতোগুলো অসুস্থ কৃমি একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ধ্বংস করবে আমাদের মেধা, টেনে হিঁচড়ে আমাদের নিয়ে যাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতায়।
হুমায়ন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত দাশ বিজয়েরা বারবার জন্মান না। সময় এখনও সভ্যতার প্রতি এতোটা সদয় হয়ে উঠেনি। কোনোদিন উঠবেও না।