শিরোনামটি শুনে কিছুটা সিদ্ধান্তমূলক মনে হলেও, এই লেখাটি মূলত প্রশ্নমূলক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট। বাঙালির জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে কলঙ্কজনক কোনো অধ্যায় নেই। বাঙালি জাতি যে একটি অকৃতজ্ঞ জাতি পনেরোই আগস্ট তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। এই লেখাটি মূলত সংকলনধর্মী। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই নৃশংসতম রাত্রির প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে কী কী ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিলো, তথ্যসূত্রসহ সেগুলো খুঁজে বের করে লিপিবদ্ধ করাই মূলত এই লেখার পরিশ্রম। পরিশ্রমটি সামান্য, কেননা সবগুলো তথ্যই কোনো না কোনো গ্রন্থে আছে, কোনো না কোনো সংবাদপত্রে বা কূটনৈতিক দলিলে আছে। মূল কাজগুলো করেছেন সে-ই লেখক-গবেষক ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা, যাঁরা বহু বছর ধরে এগুলো খুঁজে বের করেছেন বিভিন্ন উৎস থেকে। আমি কেবল সেগুলো সন্নিবেশপূর্বক একটি ঘটনা পরম্পরা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতের কোনো গবেষক এগুলো নিয়ে আরও কাজ করবেন নিশ্চয়ই; কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ষড়যন্ত্রের মুখোশগুলো ঐতিহাসিকভাবেই উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটনাপ্রবাহ: একটি ছোট্ট অবলোকন
মার্কিন ষড়যন্ত্র
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার একটি ঢাউস আকৃতির বই লিখেছিলো দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ার্স (১৯৭৯) নামে। বইটির একুশতম অধ্যায়ের শিরোনাম: “দ্য টিন্ট: দ্য ইন্ডিয়া পাকিস্তান ক্রাইসিস অব ১৯৭১”। এই শিরোনামের মধ্যে ৮৬৯-৮৭৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত একটি অধ্যায়ের নাম: “কনটাক্ট উইথ দ্য বাঙলাদেশ একজাইলস”। এখানে কিসিঞ্জার যা লিখেছিলো তার সার-সংক্ষেপ হলো—
১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই প্রবাসী সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য জনাব কাইউম কলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসে দেখা করে বলেন— তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য প্রবাসী সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পেয়েছেন। ইসলামাবাদের এই গোপন সংযোগ প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাদের জন্য মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে; তা সত্ত্বেও বিষয়টি প্রেসিডেন্ট নিকসনকে অবহিত করে সংযোগ স্থাপন করা হয়। কাজী জহিরুল কাইউমের প্রস্তাব ছিলো— ছয় দফার ভিত্তিতে স্বাধীনতার কিছু কমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে তারা রাজি আছে। দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মি. কাইউম জানান— ভারত বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলে এই ধরনের ‘ফেস সেভিং’ প্রস্তাব অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ২৭ আগস্ট জনাব কাইউম হোয়াইট হাউজের সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুততর করতে চাইলে নিকসন প্রশাসন আরও এক পা এগিয়ে আসে। কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর কাইউম দূতাবাসকে বলেন— পররাষ্ট্র মন্ত্রী দেখা করতে অপারগ।১
এই কাইউমই হলো কাজী জহিরুল কাইউম২। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের দেখা করতে না পারার কারণ হলো— মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে কাজী জহিরুল কাইউমের এই সংযোগ মুজিবনগর সরকার জেনে যায় এবং তখন থেকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে নজরবন্দি রাখা হয়।
কিসিঞ্জার ও মার্কিন প্রশাসন সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবার জন্য আমরা দেখতে পারি ‘দ্য কারেঞ্জি পেপারস (The Carnegie Papers)’৩– এ উল্লিখিত কিছু তথ্য। সেখানে বলা আছে— মার্কিন সরকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তারা ‘এফেকটিভ’ ছিলো না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আরও জানায়— সে সময় সেখানে আটটি কনট্যাক্ট সোর্স কাজ করছিলো। মজার বিষয় হলো— শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন আওয়ামী লীগের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ‘এফেকটিভ’ লোকটিকে খুঁজে পায়, যার নাম খন্দকার মোশতাক এবং সে ছিলো মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মোশতাকের উদ্দেশ্য ছিলো বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকে আটকে দেয়া। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগদান করতে যাবে মোশতাকের নেতৃত্বে একটি দল। সব যখন ঠিকঠাক প্রায়, তখনই ষড়যন্ত্রগুলো একে একে প্রকাশিত হয়ে পড়লো। ষড়যন্ত্রের মূল কথা ছিলো— পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক নিউইয়র্ক যাবে এবং অকস্মাৎ মার্কিন নীতির কাছাকাছি একটি ঘোষণা দিবে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার বিকল্প হিশেবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে বাঙলাদেশের মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং পাল্টা সরকার গঠন করবে৪।
চিনের ষড়যন্ত্র
বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিষয়ে চিনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল পিপলস ডেইলিতে এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ-এন-লাইয়ের চিঠির মাধ্যমে। পিপলস ডেইলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করা হয় বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য। চৌ এন-লাই পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব’ রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানায়।৫
বাঙলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরও চিনের শত্রুতা শেষ হয়নি। বাঙলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই ঢাকাস্থ চিনা কনস্যুল অফিস বন্ধের কথা চিন পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট চিন বাঙলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে চৌ এন-লাই “এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনামাত্র”৬ উল্লেখ করেছিলো। তারই প্রেক্ষাপটে চীন বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে ত্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল অবস্থা অব্যাহত রাখার অপ-কৌশল গ্রহণ করে।
স্বাধীন বাঙলাদেশে অব্যাহত বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র
রাজনৈতিক নেতা ও দলসমূহ
মওলানা ভাসানীর দু’টো বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন—
প্রথমত: ১৯৭২ সালে স্বদেশে ফেরার সময় আসামের ফকিরগঞ্জের একটি জনসভায় তিনি বলেন—
মিসেস গান্ধীর মতো দয়ালু মহিলা হয় না। ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা ভুলবো না। স্বাধীন বাঙলাদেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।৭
দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গৃহীত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত বাঙলাদেশের শাসনতন্ত্র বাতিলের দাবি জানিয়ে ০৭ অক্টোবর. ১৯৭২ সালে তিনি বলেন—
বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে প্রণীত হবে।৮
মাত্র ২৬৬ দিনে মওলানা ভাসানীর মতো অতো বড়ো নেতার আদর্শের প্রশ্নে এই যে ইউ-টার্ন, তার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো—
- তিনি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত চৈনিকপন্থীদের ‘মহান নেতা’ বনে গেলেন।
- মোহাম্মদ তোহা, আবদুল হক, আবদুল মতিন, দেবেন শিকদার, আলাউদ্দিন, শান্তি সেন প্রমুখ চিনপন্থী নেতাদের নেতা সেজে মওলানা ভাসানী ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের ঘোষণা দিলেন।
- ১৯৭২ সালের ০৮ জুলাই পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফরে যান। ভুট্টো লন্ডন হয়ে বিশেষ দূত মারফৎ মওলানা ভাসানীকে একটি পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে ‘মুসলিম বাঙলা’ (এই স্লোগানটি ভুট্টো প্রদত্ত, যা সে সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচারিত হতো) প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করা হয়েছে৯।
- যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে যেখানে প্রয়োজন ছিলো সহযোগিতা, সেখানে প্রকাশ্য জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা দিলেন—
আমি এদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবো১০।
তদানীন্তন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র উত্তরণের হুংকার; অন্যদিকে আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হুঙ্কার— এ দুয়ের টানাপোড়েনে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের ২১ জুলাই একই দিনে বঙ্গবন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকী আহুত ছাত্রলীগের সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হন। অন্যদিকে পল্টন ময়দানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সশস্ত্র সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেয়া হয়। ছাত্রলীগের এই ভাঙন অচিরেই শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ভাঙন তৈরি হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘বিপ্লবে পরিপূর্ণতা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্লোগানে জাসদের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।
চিনপন্থী দলগুলো কখনও ‘স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’ কখনও ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ আবার কখনও ‘মুসলিম বাঙলা’র স্লোগান তুলে চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকে দেশের নানা প্রান্তে১১।
দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের জন্যও ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। দেশের জাতীয় সম্পদ পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক নির্মিত ঘোড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোল রুমটি উগ্রবাদীরা বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। এতে ক্ষতি হয় বৈদেশিক মুদ্রায় ১৫০ মিলিয়ন টাকা। দশমাস পর্যন্ত এই কারখানা উৎপাদনে অক্ষম থাকে। এক লক্ষ টন সারের ঘাটতি তৈরি হলো। এর প্রভাব পড়লো খাদ্য উৎপাদনে১২।
এছাড়া দলের ভেতরেও ক্ষমতার কোন্দল তৈরি হতে থাকে। পাকিস্তানপন্থী ও আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত চর গমিরুদ্দিন প্রধানের ছেলে সফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের সভাপতি হলো। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে সাতজন শিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো।
ষড়যন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার ছিলো গুজব ও মিথ্যাচার
এনায়েতুল্লাহ খানের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে (The Holiday) তখন নানা ধরনের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছিলো। পত্রিকাটির তৎকালীন সংখ্যাগুলো থেকে এমন ছয়টি মিথ্যা সংবাদ ও গুজব তুলে ধরা হলো—
প্রকাশিত সংবাদ: পাকিস্তানের নোট অচল ঘোষণায় মাত্র ৫ দিন সময় দেয়া হলো। আর ভারতীয় নোট প্রত্যাহারের জন্য ১ মাস ১৫ দিন!
প্রকৃত চিত্র: হলিডে মারফৎ গুজব রটে গেলো যে, বঙ্গবন্ধু সরকার ভারত সরকারকে যে পরিমাণ নোট ছাপাতে দিয়েছিলো ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেবার জন্য তার দ্বিগুণ নোট ছাপিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতীয় নোট প্রত্যাহারের জন্য এক মাস সময় দিলেন। হলিডের এই মিথ্যাচারের জবাব তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দিয়েছিলেন—
পাকিস্তানের টাকার ব্যাপারটা হলো ডিমনিটাইজেশন আর ভারতের টাকার ব্যাপারটা হলো উইথড্রয়াল। প্রথমটা হলো নির্দিষ্ট তারিখের পর অচল ঘোষণা আর পরেরটা হলো ভারতীয় নোট প্রত্যাহার করে নেয়া। ভারত থেকে ৩৫০ কোটি টাকার নোট ছাপানো হয়েছে। সত্যিই ভারত এর বেশি ছেপেছে কি না, আমরা জানতে চাই। লম্বা সময় দিলাম, যেনো সমস্ত নোট জমা হতে পারে। তাহলে প্রকৃত অবস্থাটি বুঝতে পারবো১৩।
১৯৭৩ সালের ৩১ মে ভারতের মুদ্রিত টাকা জমাদানের তারিখ অতিবাহিত হবার পর দেখা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মূলত ইস্যুকৃত মোট অঙ্কের চাইতে ৫৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৪৮০ টাকা কম জমা পড়েছে। দ্বিগুণ নোট ছাপা তো দূর কী বাত!
প্রকাশিত সংবাদ: মওলানা ভাসানীর বরাত দিয়ে হলিডে অভিযোগ করে বাঙলাদেশের সব গাড়িকে পাচার করা হয়েছে। কারণ কোলকাতার রাস্তায় বাঙলাদেশের মটরযানে ভর্তি হয়ে গেছে।
প্রকৃত চিত্র: স্বাধীনতা যুদ্ধে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। এই সকল গাড়িকে সনাক্ত করে কোলকাতা পুলিশ WJB সংকেতে পৃথক নম্বর দিয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হলে ওই গাড়িগুলো তারা সঙ্গে করেই নিয়ে আসে।
প্রকাশিত সংবাদ: ভারতের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করে বঙ্গবন্ধু সরকার বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছেন । এই গুজবটি এতো বেশি আলোচিত ছিলো যে, নব্বই দশকেও বিএনপি-জামাত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই বক্তব্য নির্বাচনী বক্তব্য হিশেবে প্রচার করেছে।
প্রকৃত চিত্র: ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাঙলাদেশ সফরে এলে ২৫ বছরের ‘বাঙলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহায়তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রকাশ্য চুক্তিকে ‘গোপন চুক্তি’ বলে চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে।
১৯৭৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস মাখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন—
পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আসলাম এখন কোথায়?
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুট্টো তার পিপলস পার্টি গঠনের সময় ‘আসলাম’ নামের এক উর্দুভাষী সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটে। যুদ্ধকালে সে বাঙলাদেশেই ছিলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল পার্লামেন্টে জানালেন যে— ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে সে বাঙলাদেশ ত্যাগ করে। বলাইবাহুল্য, এই পাকিস্তানি এজেন্টটি ছিলো হলিডের নির্বাহি সম্পাদক। কেননা, পার্লামেন্টে এই বিতর্ক উত্থাপনের দু দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর এনায়েতুল্লাহ খান “পার্লামেন্টে এসব ননসেন্স থামানোর জন্য” প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করে একটি লেখা লেখে। লেখায় অবশ্য সে স্বীকার করে যে— আসলাম একজন পাকিস্তানি এবং তার পত্রিকায় কর্মরত ছিলো১৪।
দৈনিক ইত্তেফাক প্রসঙ্গ
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ভস্মীভূত হয়েছিলো দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অফিস। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো— জেনারেল ইয়াহিয়া ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই ১২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলো। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র সে টাকা গ্রহণ করে ইংল্যান্ড-জার্মান সফর করলো অফসেট রোটারি মেশিন ক্রয়ের জন্য। দেশে ফিরে এসে দৈনিক পকিস্তানের মুদ্রণালয় থেকে ইত্তেফাক ছাপাতে শুরু করলো। স্বাধীনতার পর মঈনুল হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পূর্বেকার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলো এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই হানাদার কবলিত বাঙলাদেশে ছাপানো ইত্তেফাকের বকেয়া বিজ্ঞাপনের বিল আদায় করতে সমর্থ হলো। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অত্যন্ত পরীক্ষিত নেতা নূরুল ইসলাম ভাণ্ডারীকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিলো ব্যরিস্টার মঈনুল হোসেনকে।
এ সময়ের আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। খন্দকার আব্দুল হামিদ ছিলো আইউব আমলে মৌলিক গণতন্ত্রী, মুসলিম লীগ ও মোনায়েম খানের সমর্থক। ইয়াহিয়াকেও সমর্থন দিয়েছিলো সে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় সে গ্রেফতার হলেও মঈনুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর তদবিরে বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করে দেন। কারাগার থেকে বের হয়ে সে ‘স্পষ্টভাষী’ ছদ্মনাম নিয়ে ইত্তেফাকে এবং ‘মর্দে মুমীন’ নামে দৈনিক আজাদে কলামের নামে সাম্প্রদায়িক গরল উদ্গীরণ শুরু করে১৫।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে এই ব্যক্তিটি বাঙালি জাতিসত্তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য জিয়ার আমলে ‘বাঙালি’র পরিবর্তে ‘বাঙলাদেশী’ তত্ত্বের উদ্গাতা১৬।
ব্যরিস্টার মঈনুল হোসেন পাকিস্তানের এতোটাই আস্থাভাজন ছিলো যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বইয়ে মঈনুল হোসেনকে তার পিতার ‘যোগ্যপুত্র’ হিশেবে প্রশংসা করা হয়েছে১৭।
১৯৭৪ সালের খাদ্য সংকট
১৯৭৪ সালে বাঙলাদেশে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বিশ্বে তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ১৯৭৪ সালের আগেই মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছিলো। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় বাঙলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিঃশেষিত। এ সময় বাঙলাদেশের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন খাদ্য সাহায্য করেছিলো কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিলো নগন্য।
এই দুর্ভিক্ষপীড়িত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যে জঘন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কাউন্সিল অফ ফরেন রিলেশন্স (নিউইয়র্ক)- এর জার্নাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স– এর ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। ‘ফুড পলিটিক্স’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন এমারথ চাইল্ড। তিনি সি.আই.এ উদ্ভাবিত ‘খাদ্যই শক্তি’ এই মতবাদকে সামনে রেখে বিশ্বজুড়ে তার প্রভাব বিস্তারের কৌশল অবলম্বন শুরু করে, যার নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছিলো বাঙলাদেশ। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বাঙলাদেশ বাণিজ্যিক বাজার থেকে আমেরিকান খাদ্য কেনে। ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বাঙলাদেশ সরকার খাদ্যঘাটতি পূরণের জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু মার্কিন খাদ্যশস্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাঙলাদেশে পৌঁছানোর জন্য স্থিরকৃত দুটো বড়ো চালানের বিক্রয় বাতিল করে দেয়। এর কারণ হিশেবে দেখানো হয়েছিলো— যেহেতু বাঙলাদেশ কিউবার কাছে পাট বিক্রি করেছে, তাই এই রাষ্ট্রটি সাহায্য পাবার যোগ্য কি না, তা নির্ধারণ করতে হবে। যদিও ঐ একই সময় মিশর কিউবায় তুলা রপ্তানী করছিলো কিন্তু মিশরের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন এমন কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখেছেন—
কেন যে পাটের থলে কাঁচা তুলার চেয়ে অধিকতর বিপজ্জনক ‘অস্ত্র’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল অথবা কেন মিশরের ক্ষেত্রে যে বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা হয়েছিল, তা বাঙলাদেশের ক্ষেত্রেও হলো না— এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই১৮।
রাষ্ট্রযন্ত্রে স্বাধীনতাবিরোধীদের অবস্থান
বেসামরিক প্রশাসন
জেনারেল টিক্কা খান আর পাকিস্তান আমলের গভর্নর ডা. মালেকের স্টেনোগ্রাফার রোজারিও গণভবনে বহাল থাকলো। ফলে দেশের আভ্যন্তরীণ নানা খবর বিদেশে অতিরঞ্জিত হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। ঠিক মতো তথ্যসমৃদ্ধ খবর পরিবেশিত হচ্ছে না— এজন্য বঙ্গবন্ধু একজন যোগ্য লোককে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিভাগে নিয়োগ দিতে বললেন। দায়িত্ব দিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে। তার সুপারিশে ‘যোগ্য লোক’ হিশেবে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিভাগের মহাপরিচালক হিশেবে নিয়োগ পেলো নাজিমুদ্দিন হাশিম।
নাজিমুদ্দিন হাশিমের পরিচয়
আইয়ুব খানের Friends not Masters: A Political Autobiography (1967) গ্রন্থের মূল প্রণেতা এবং রাওয়ালপিণ্ডির পাকিস্তান কাউন্সিলের সাবেক ডিরেক্টর।
স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন বাঙালি সি.এস.পি অফিসারের সংখ্যা ছিলো ১৮০ জন এবং ই.পি.সি.এস অফিসারের সংখ্যা ছিলো ৯৫০ জন। বাঙালি ১৮০ জন সি.এস.পি অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৩ জন মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগদান করেছেন। অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত অফিসারদের মধ্যে পি.এস.পি’র দুইজন অফিসার এবং ই.পি.সি.এস-এর হাতে গোনা কয়েকজন অফিসারসহ সর্বস্তরের মাত্র ৫০০ জন সরকারি কর্মচারী বাঙলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
কিন্তু স্বাধীন বাঙলাদেশে প্রবাসী সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে অলিখিত প্রশাসনিক সংকট শুরু হয়। তবুও পাকিস্তানের সার্ভিস রুল নাকচ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এতে পাকিস্তানের আনুগত্য স্বীকার করে চাকুরি করা বাঙালি অফিসাররা ক্ষুব্ধ হতে থাকে এবং নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে।
ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রশাসন ও চাকুরির পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রাক্তন সি.এস.পি সিস্টেমকে ‘আর্টিফিশিয়াল ইনিস্টিটিউশন’ নামে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী সরকারি অফিসারদের বড়ো বড়ো পদ প্রাপ্তির প্রথা ও নিয়ম বাতিল করে দেয়। এতে তারা ১৯৭২ সাল থেকেই নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু করে১৯।
সি.এস.পি অফিসারদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি আস্থা রেখেছিলেন রুহুল কুদ্দুসের ওপর। তাকে সেক্রেটারি জেনারেল হিশেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু তার কাছে ফাইল পাঠানো বন্ধ করে দেন। ১৯৭৪ সালে যখন সারা দেশ দুর্ভিক্ষে কবলিত, গুলশানে তখন রুহুল কুদ্দুসের প্রাসাদ নির্মিত হচ্ছে২০।
স্বাধীন বাঙলাদেশে কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানপন্থী আমলাদের মূল পরামর্শদাতা হিশেবে আবির্ভূত হয়েছিলো শফিউল আযম। সি.এস.পি অফিসার হিশেবে তার বেশ নামডাক ছিলো। ১৯৪৯ সালে সি.এস.পি পরীক্ষায় সে সমস্ত পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম হয়েছিলো। চাকুরি না পেয়ে সে বঙ্গবন্ধু ও বাঙলাদেশ বিরোধী সি.এস.পি অফিসারদের গোপনে সংগঠিত করতে থাকে২১।
সামরিক প্রশাসন
১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট বাঙলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানদের সংখ্যা ছিলো ৫৫ হাজার। এর মধ্যে পাকিস্তানের প্রত্যাগত জওয়ানদের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন করে রিক্রুটদের মিলিয়ে সর্বমোট সংখ্যা ছিলো ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারের সংখ্যা ছিলো ১১০০। পাকিস্তান প্রত্যাগত জওয়ানরা ছিলো ভারত বিদ্বেষী এবং মুক্তিযুদ্ধ-বৈরী মুসলিম বিশ্বের প্রতি অনুরক্ত২২।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙলাদেশের পুনর্গঠন, উন্নয়নশীল কার্যক্রমের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রতিরক্ষা খাতে সমগ্র বাজেটের শতকরা ১৩ ভাগের বেশি বরাদ্দ করা জাতীয় নীতির সহায়ক নয় বলে বিবেচিত হয়েছিলো। কিন্তু সাধারণ জোয়ানদের পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা পাকিস্তানে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আর স্বাধীন বাঙলাদেশে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে তুলনামূলক বিচার করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের ‘ভারত-বিদ্বেষ’-কে কাজে লাগিয়ে এই মনোভাব তৈরি করে যে— ভারতের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু সরকার সেনাবাহিনীকে দুর্বল করছে। ফলে সেনাবাহিনীর ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব ক্রমেই মুজিব-বিরোধী মনোভাবে রূপ নিতে শুরু করে।
আরেকটি বড়ো কারণ হলো— পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও জওয়ানরা পাক কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে যে ১৮ মাস আটক ছিলো, তার বেতন দাবি করে। বলাইবাহুল্য, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এই দাবি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া কোনো উপায়ই ছিলো না। নিজেদের স্বার্থহানী হওয়ায় তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
শিল্পপতি ও ব্যবসায়িদের ক্ষোভ
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌল লক্ষ ছিলো শোষণ ও বৈষম্যহীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠা, তাই সরকার গঠনের পর পরই বঙ্গবন্ধু বাঙালি শিল্পপতিদের শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে পাট, বস্ত্র, চিনি ও ভারি শিল্প জাতীয়করণ করেন। ফলে বাঙালি শিল্পপতি ও ব্যবসায়িরা বঙ্গবন্ধুর ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হয়। এরা বঙ্গবন্ধুবিরোধী শিবিরে নিয়মিত চাঁদাও সরবরাহ করতে থাকে২৩।
তৎকালীন শিল্পপতিদের অন্যতম ছিলো এ. কে. খান। সে জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের মন্ত্রীও হয়েছিলো। তার ভাই এম.এস.খানের দুই কন্যাকে বিয়ে করে কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুক।
পুলিশ প্রশাসন
বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্স বা এন.এস.আই নামে বাঙলাদেশের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নামকরণ করলেন এবং এর পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োগ করলেন এ. বি. এস সফদরকে।
এ.বি.এস সফদরের পরিচয়
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনের আমেরিকান পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য গমন করে। পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে প্রবাসে যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই দেশে ফিরে না এসে প্রবাসেই আন্দোলন করেন। এদের মধ্যে দু জন দেশে ফিরে আসে এবং পাকিস্তান সামরিক জান্তার অধীনে চাকুরিতে যোগদান করে। এদের একজন হলো এ.বি.এস. সফদর, আরেকজন আবদুর রহিম। সফদর পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিশেবে ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় ইনটেলিজেন্সির পূর্ব-পাকিস্তানের দায়িত্ব পেয়েছিলো২৪।
আবদুর রহিম স্বাধীন বাঙলাদেশে প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েট প্রধান হিশেবে নিয়োগ পায় ও দায়িত্ব পালন করে!
আবদুর রহিমের পরিচয়
সফদরের সঙ্গে সে-ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের অদীনে চাকুরিতে যোগদান করে। তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় ছিলো— সে রাজাকার বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো২৫।
পুলিশ ক্যাডারে কর্মরত আমির খসরুকে সে সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে নিযুক্ত করা হয়।
আমির খসরুর পরিচয়
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকারের অধীনে কর্মরত পাকিস্তান প্রশাসনের বিশ্বস্ত ক্যাডার২৬।
পনেরোই আগস্টের আগে ও পরে বিভিন্ন ব্যক্তির পদ
মন্ত্রীসভা
পনেরোই আগস্টের পর গঠিত হলো নতুন মন্ত্রীসভা। রাষ্ট্রপতি হলো খুনি খন্দকার মোশতাক। উপরাষ্ট্রপতি হলো বাকশাল গঠনের পূর্বে যে ছিলো রাষ্ট্রপতি— মোহাম্মদ উল্লাহ। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার যারা যারা এই মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়ে খুনিদের সঙ্গে হাত মিলালো, তারা হলো—
- আবু সাঈদ চৌধুরী: পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিশেবে শপথ গ্রহণ। ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিশেবে পুনঃনির্বাচিত। একই বছর পদত্যাগ করে একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষ দূত হিশেবে নিযুক্ত। ১৯৭৫ সালের ০৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় বন্দর ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী। ১৯৭৫ সালের ০৭ নভেম্বর পর্যন্ত (মোশতাক মন্ত্রীসভার শেষদিন) খুনি মোশতাকের মন্ত্রীসভায় দায়িত্বপালন। এরপর জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন।
- অধ্যাপক ইউসুফ আলী: পরিকল্পনা মন্ত্রী
বাঙলাদেশ গণ-পরিষদের স্পিকার হিশেবে ‘মহান স্বাধীনতার সনদ’ পাঠ করেন। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীগণকে তিনিই শপথ বাক্য পাঠ করান। বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। খুনি মোশতাক সরকার, জিয়াউর রহমান সরকার ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হিশেবে শপথ গ্রহণ।
- ফণীভূষণ মজুমদার: স্বায়ত্তশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, বেঙ্গল ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্পাদক (১৯৩৮), হলওয়েল মুভমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ (১৯৪০), ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-২ আঞ্চলিক কাউন্সিলের (যশোর-ফরিদপুর) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন। ১৯৭৭ সালের সামরিক শাসনামলে গ্রেফতার।
- মনোরঞ্জন ধর: আইনমন্ত্রী
অরবিন্দ ঘোষের যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন (১৯১৭-১৯৩৮)। ভাষা আন্দোলনে আইন পরিষদের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে গঠিত মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য। জাপানে বাঙলাদেশের রাষ্ট্রদূত (১৯৭২)। বঙ্গবন্ধু সরকারের আইনমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষার্থে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মোশতাক কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ উত্থাপনকারী আইনমন্ত্রী। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ছিলেন এম.এইচ রহমান। দি বাঙলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথারিটি লেখা দায়মুক্তির অধ্যাদেশে মোশতাকের পরই এম.এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে।
- আবদুল মমিন: কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ও (০৮-০৭-১৯৭৪) একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
- আসাদুজ্জামান খান: নৌ-পরিবহন মন্ত্রী
১৯৪১-৪৫ সাল অব্দি সরকারি চাকুরি করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সত্তরের নির্বাচনে ময়মনসিংহ থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার পাটমন্ত্রী হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত এবং ১৯৮২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।
- আজিজুর রহমান মল্লিক (এ.আর মল্লিক): অর্থমন্ত্রী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, বাঙলাদেশের প্রথম শিক্ষা সচিব, বাঙলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত (ভারত, নেপাল ও ভূটানে নিযুক্ত), দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। ১৯৭৪ সালের শেষ ভাগে অর্থমন্ত্রী হিশেবে তাজউদ্দীন আহমেদের স্থলাভিষিক্ত হন।
- ড. মোজাফ্ফর আহম্মদ চৌধুরী: শিক্ষামন্ত্রী
ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের প্রধান হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৭২), মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৭৩)। বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিশেবে দায়িত্ব পালন করেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে মন্ত্রী পরিষদ থেকে অপসারিত হন।
- আবদুল মান্নান: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ছয়দফা আন্দোলন (১৯৬৬), গণ-অভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও মুক্তিযুদ্ধে (১৯৭১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রথম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১২ জানুয়ারি, ১৯৭২), এরপর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী (১৬ মার্চ, ১৯৭৩ ও ২৬ জানুয়ারি, ১৯৭৫)। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ি কমিটির সভাপতি।
- সোহরাব হোসেন: গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী
স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রথম মন্ত্রী পরিষদের বন, মৎস ও পশু পালন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
প্রতিমন্ত্রীসভা
- শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: ভূমি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী
- দেওয়ান ফরিদ গাজী: প্রতিমন্ত্রী২৭
- তাহের উদ্দিন ঠাকুর: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
- নুরুল ইসলাম চৌধুরী: শিল্প প্রতিমন্ত্রী
- নূরুল ইসলাম মঞ্জুর: রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী
- কে. এম. ওবায়দুর রহমান: ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।
- মোসলেম উদ্দিন খান: প্রতিমন্ত্রী২৮
- ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল: ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী
- রিয়াজ উদ্দিন আহমদ: পশু ও মৎস প্রতিমন্ত্রী
- সৈয়দ আলতাফ হোসেন: যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী
পুলিশ, বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসন
- বঙ্গবন্ধুর সরকারে এন.এস.আই-এর পরিচালক হিশেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এ.বি.এস সফদরকে মোশতাক মহাপরিচালক পদে উন্নীত করে।
- বঙ্গবন্ধুর প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের প্রধান হিশেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আবদুর রহিম মোশতাকের সময়ও একই পদে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বহাল থাকে। জিয়াউর রহমান তাকে পদোন্নতি দিয়ে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিশেবে নিয়োগ দেয়।
- ১৯৬৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমির গ্র্যাজুয়েট এ. এম. আমিনুর রহমানের সখ্য ছিলো আল-বদর বাহিনীর কমান্ড কাউন্সিলের মওলানা মান্নানের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও পঁচাত্তরের পর মোশতাক তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ফোর্সের কমিশনার নিযুক্ত করে২৯।
- এন.এস.আইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর মুসা মিয়া চৌধুরীকে প্যারামিলিটারি আর্মস ব্যাটেলিয়ান সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
- আইয়ুব-মোমেনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন ও ঐ সময়ের শ্রমিক আন্দোলন দমনের কুখ্যাত নাম সালাউদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।
- ১৯৪৯ সালে সি.এস.পি পরীক্ষায় সমস্ত পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম হওয়া ‘মেধাবী’ আমলা শফিউল আযম পাক-বাহিনীর আদেশ-নির্দেশের আজ্ঞাবহ হবার দরুণ বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে চাকুরিতে বহাল রাখেনি। পঁচাত্তরের পর মোশতাক সরকার তাকে ‘নিয়ম বিরুদ্ধ পদোন্নতি সম্পর্কিত রিভিউ কমিটি’র প্রধান হিশেবে নিয়োগ দেয়। প্রশাসন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ধুলিস্যাৎ হতে শুরু করে এরই হাত দিয়ে। ‘ক্লিন এডমিনিস্ট্রেশন’- এর ধুয়া তুলে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অফিসারদের উঁচু পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই কাজে ষোলো আনা সাহায্য করে সংস্থাপন সচিব হিশেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কেরামত আলী।
- বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় মোশতাক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র সচিব। পঁচাত্তরের পর খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট এবং মাহবুব আলম চাষী প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। পররাষ্ট্র সচিব হিশেবে নিয়োগ পেলো আইএসআইয়ের আস্থাভাজন তোবারক হোসেন।
- ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টে মন্ত্রী পরিষদের সচিব ছিলো এইচ. টি. ইমাম। খুনি মোশতাক চক্রের মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের শপথ পাঠ করানোর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে অবশ্য গ্রেফতারও হন।
- পনেরোই আগস্টের হত্যকাণ্ডের পর খুনি খন্দকার মোশতাকের প্রতি একে একে আনুগত্য প্রকাশ করলো সেনাবাহিনীর প্রধান কে. এম. শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনীর প্রধান এ. কে. খন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান এম.এইচ. খান, বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নূরুল ইসলাম এবং রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান লে. কর্নেল আবুল হাসান।
- অবশ্য এই আনুগত্য প্রকাশেও কোনো লাভ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিশেবে দায়িত্ব নেয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৬ অক্টোবর বিমানবাহিনীর প্রধান করা হয় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থানরত ন্যাটোর এয়ারফোর্স স্কুলের ইনস্ট্রাক্টর এবং সি.আই.এর নথিতে উল্লিখিত ‘Pro-American even for Pakistan’৩০ এম.জি তোয়াবকে বাঙলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান করা হয়।
- মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি ওসমানী প্রেসিডেন্ট মোশতাকের প্রধান সেনাপতি হিশেবে নিযুক্ত হন।
- জিয়াউর রহমানের পরে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো জেনারেল এরশাদ। ১৯৭৩ সালে সে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে প্রমোশন নিয়ে ভারতের দেরাদুনে স্টাফ ট্রেনিং-এ যায় এবং আগস্ট মাসে রাতারাতি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়।
- বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেতারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। সবুর খান, মওলানা রহিম, আখতার ফারুকসহ সব সাম্প্রদায়িক দলের নেতারাই মোশতাক সরকারকে অভিনন্দন জানায়।
- স্বাধীন বাঙলাদেশের স্বীকৃতি দেয় তিনটি দেশ। ১৬ আগস্টে সৌদি আরব ও সুদান; ৩১ আগস্টে চিন।
কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন
আমি এ প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর পাইনি, তাই আমার কাছে অমীমাংসিত। কেউ যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর জেনে থাকেন, তাহলে দয়া করে জানাবেন। আমার বিবেচনায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলে পনেরোই আগস্টের ষড়যন্ত্রের প্রায় পুরোটা ছকই উদ্ধার করা যাবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খুলে ফেলা যাবে।
১৯৭৫- এর পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশিদ ছিলো টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার। ১৯৭৪ সালের প্রথমার্ধে রশিদ ১৪ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য বোম্বের দিয়োলালীতে গানারি স্টাফ কোর্সে (Gunnery Staff Course) যোগদানের জন্য ভারতে যায়। ১৯৭৫ এর মধ্য মার্চে কোর্স সমাপ্ত করে ঢাকায় ফিরে আসে। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর স্বাভাবিকভাবেই তার পোস্টিং ছিলো যশোরের গানারি স্কুলে। সেখানেই তার যোগদান ছিলো পূর্ব-নির্ধারিত। কিন্তু সে যোগদান না করে একমাসের ছুটি নেয়। যশোরে তার নির্ধারিত পদে যোগদানের অর্থই হলো আর্টিলারি বাহিনীর কমান্ড থেকে দূরে সরে যাওয়া। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে সে টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং পোস্ট দখল করে।
সুতরাং প্রথম প্রশ্ন
যশোরে যোগদান অবশ্যম্ভাবী হওয়া সত্ত্বেও, কাদের সাহায্যে সেনাবাহিনীর বিধি-নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে ঢাকায় রাখা হলো?
এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন
রশিদের পূর্বতন বদলির অর্ডার কে এবং কেনো বাতিল করেছিলো?
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং যুক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে— বৃহত্তর অর্থে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুবিধার্থে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার সময়ের চেয়ে ট্যাংক রেজিমেন্ট ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব নেবার পরই ফারুক রাষ্ট্রপতিকে হত্যার সুযোগ নিয়েছে। সঙ্গে পেয়েছে তার ভায়রা ভাই টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার কর্নেল রশিদকে৩১। এই তথ্যের সূত্র ধরে একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে— ট্যাংক রেজিমেন্ট ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল আবদুল মোমেন। ১৪ আগস্ট রাতে নাইট ট্রেনিং- এ যাবার সময় দেখা গেলো লে. কর্নেল আবদুল মোমেন ছুটিতে বাইরে আছেন। সুতরাং দায়িত্ব অর্পিত হলো— ফারুক রহমানের ওপর।
সুতরাং প্রথম প্রশ্ন
এটা কি কাকতালীয় যে ওইদিন রাতেই দুটো গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডিং- এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় দুই ভায়রা ভাই?
এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন
কোন উধ্বর্তন অফিসারের নির্দেশে এই দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিলো?
সে সময়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স সম্পর্কিত একটি কোর্সে প্রশিক্ষণের আমন্ত্রণ নিয়ে তিনি ১২ আগস্ট রওনা হন। পথে লন্ডনে জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। ব্রিগিডিয়ার নুরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিশেবে দায়িত্ব নেয় পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার লে. কর্নেল আবুল হাসান।
সুতরাং প্রশ্ন হলো
মার্কিন প্রশাসনের এই আমন্ত্রণ কি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলো? (এ প্রসঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে নুরুজ্জামানকে দায়ি করা যাচ্ছে না কারণ ০২ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যখন খুনি মেজরদের হটানো হচ্ছিলো, তখন নুরুজ্জামান সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন)।
খুনি ফারুক বলেছিলো—
আমার ট্যাংক নিয়ে বিমান বন্দরের সীমান্ত প্রাচীর ভেঙে কয়েকটি গাছকে দুমড়িয়ে আমি যখন রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের নিকটে চলে এলাম তিন হাজার রক্ষীবাহিনীর একটি ব্রিগেড লাইন-আপ হয়ে আছে। তারা যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত, হেলমেট পরিহিত৩২।
এ সময় কিন্তু ট্যাংকে ফারুক আর ট্যাংক চালক ছাড়া কেউ ছিলো না। ট্যাংকে গোলাও ছিলো না, এমনকি ছোটো কোনো অস্ত্রের গুলিও তাদের কাছে ছিলো না। কারণ ‘নাইট প্যারেড’- এর মহড়ায় কোনো লাইভ অ্যামুনিশন থাকে না।
সুতরাং প্রশ্ন হলো
নাক বরাবর ব্যারেল তাক করার পরও তিনহাজার রক্ষীবাহিনীর বিগ্রেড কেনো নিশ্চুপ ছিলো?
সে রাতে সেনাপ্রধান ও রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে বারবার ফোন করছিলেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক ও বঙ্গবন্ধুর স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট তোফায়েল আহমদ। রক্ষীবাহিনীর একটি গাড়ি এসে তাঁকে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তরে নিয়ে যায়৩৩।
সুতরাং প্রথম প্রশ্ন
প্রেসিডেন্ট হত্যার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্টকে রেখে রক্ষীবাহিনী কেনো তাঁর স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট তোফায়েল আহমেদকে সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলো?
এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন
তোফায়েল আহমেদ সেখানে রক্ষীবাহিনী বা সামরিক কোনো নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন কি? কী কথা-বার্তা হয়েছিলো সেখানে?
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমদ এ প্রশ্নগুলোর কোনো পরিষ্কার উত্তর দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
পনেরোই আগস্টে প্রেসিডেন্টের সামরিক গার্ডবাহিনী কোনো বাধা প্রদান করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৭ নম্বর সাক্ষী ক্যাপ্টেন বাশার জানান— ১৯৭৫ সালের ১-২ আগস্ট তার নেতৃত্বে কুমিল্লার ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির ১০৫ জনের একটি কোম্পানি (মেজর ফারুকের) ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু গণভবনে জায়গা না থাকায় তিনি (ক্যাপ্টেন বাশার) থাকতেন আজিমপুরের চায়না বিল্ডিং- এ৩৪। তাকে এই অনুমতি প্রদান করে প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশরুরুল। এই মাশরুরুলই প্রেসিডেন্টের বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডদের নিয়োগ করতো। পাকিস্তান আমলে মাশরুরুল ছিলো মোনায়েম খানের মিলিটারি সেক্রেটারি। উল্লিখিত সাক্ষী জানায়— পনেরোই আগস্টে ৩২ নম্বরে তিনি গিয়েছিলেন দুপুর বারোটার পর। নিরাপত্তার কী বেহাল অবস্থা!
সুতরাং প্রশ্ন হলো
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কি একবারও মাশরুরুলের পেশাগত ট্র্যাক রেকর্ড চেক করেনি প্রেসিডেন্টের বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেবার আগে?
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে জঘন্য কলঙ্কময় একটি দিন। দীর্ঘ একটি সময় ধরে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে ‘কতিপয় সেনা অফিসারের’ কাজ বলেই চালিয়ে দিয়েছে আমাদের রাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে সাক্ষীদের জবানবন্দী, তৎকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসূহের প্রতিবেদন, সে সময়কার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা লোকজনের সাক্ষাৎকার এবং রাষ্ট্রীয় নথিপত্রগুলো ঠিকঠাক মতো পর্যবেক্ষণ করতে পারলে এই বিভৎস হত্যাকাণ্ডের পিছনের ষড়যন্ত্রের পুরো নকশাটি পাওয়া যেতে পারে।
এই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ— কেননা, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে, তার পক্ষে যে কোনো জঘন্য কাজ করাটা অসম্ভব কিছু না। অতএব, তার মুখোশটা টেনে তুলতে হবে। নিশ্চয়ই আগামী দিনের গবেষকগণ এই ব্যাপারে ব্রতী হবেন।
তথ্যসূত্র
১. Kissinger, Henry, “Contacts with the Bangladesh Exiles”, White House Years, Little, Brown and Company, 1979, New York, pp. 869-73.
২. এই কথা তিনি নিজে স্বীকার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর গ্রন্থের সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রশাসন সংশ্লিষ্ট আলোচনায় কিসিঞ্জার কথিত মি. কাইউম যে তিনিই, তা স্বীকার করেছেন।
৩. লরেন্স লিফশুলজ তাঁর বাঙলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন (১৯৭৯) গ্রন্থে The Canegie Papers নামে একটি পরিশিষ্ট যোগ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি কমিশন অনুসন্ধান ও গবেষণা চালায়। এর মূল লক্ষ্য ছিলো— কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতি ব্যর্থ হয়েছিলো। হাজার হাজার পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে গবেষকবৃন্দ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ১০০-এর অধিক উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সি.আই.এ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, গোয়াইট হাউজের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলসহ বহু প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
৪. The Carnegie Papers, Winston Lord, Kissinger’s Director of Planning, National Security Council.
৫. South Asian Crisis, Appendix 5. page: 173
৬. Khatib, A. L., Who Killed Mujib?, Vikas Publishing House, 1982, New Delhi, p.169.
৭. P.T.I Report, 22 January 1972.
৮. Morning News, Dhaka, 08 October 1972.
৯. The Statesman, Calcutta, 15 July 1972.
১০. দৈনিক বাংলা, ২৪ আগস্ট ১৯৭২।
১১. Blackburn, Robin (ed.), Explosion in Sub Continent: India, Pakistan, Bangladesh and Ceylon, Penguin Books, 1975, London, p. 316.
১২. Khatib, A. L., ibid, p. 20.
১৩. মোহাইমেন, মোঃ আব্দুল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৮৪, ঢাকা, পৃ. ৯-১০।
১৪. Holiday, September 30 1972.
১৫. সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু, ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, চারুলিপি, ১৯৮৬, ঢাকা, পৃ. ৭০-৭১।
১৬. সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু, “বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট”, রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, পৃ. ৪০।
১৭. Salik, Siddiq, Witness to Surrender, UPL, 1997, Dhaka, p. 5.
১৮. সোবহান, রেহমান, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট: বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধাবলী। এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৩৬-৬৫ পর্যন্ত ‘খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের রাজনীতি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ আছে। সেখান থেকেই উদ্ধৃত অংশটুকু নেয়া হয়েছে।
১৯. Maniruzzaman, Talukder, Group Interests and Political Changes Studies of Pakistan and Bangladesh, Sucheepatra, 1982, p. 203.
২০. সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০।
২১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১।
২২. Maniruzzaman, Talukder, ibid, pp. 236-37.
২৩. জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ.স.ম. রবের সাক্ষাৎকার, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৯৮৪।
২৪. করিম, জাওয়াদুল, “মুক্তিযোদ্ধাদের না বলা কথা”, সাপ্তাহিক ছুটি, ২২ মার্চ ১৯৮৫, পৃ. ০৭।
২৫. Bikramaditya, Confidential Dairy, Cosmos, 1981, Calcutta, p. 54.
২৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।
২৭. তিনি কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, সেটা আমি পাইনি। কেউ জানালে উপকৃত হবো।
২৮. মন্ত্রণালয় অজানা।
২৯. Lifschultz, Lawrence, Bangladesh: The Unfinished Revolution, Zed Press, 1979, London, p. 126.
৩০. Asia Week, 13 March 1986.
৩১. খান, জাহিদ নেওয়াজ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল, শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১৬, ঢাকা, পৃ. ১৪-১৫।
৩২. অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে আইটিভির জন্যে দেয়া ফারুক-রশিদের সাক্ষাৎকার; আগস্ট, ১৯৭৬।
৩৩. শাহজাহান, মোহাম্মদ (সম্পাদিত), পলাশী থেকে ধানমন্ডি, পৃষ্ঠা: ৬৭-৬৮। বিকল্প তথ্যসূত্র: সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু, ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, চারুলিপি, ১৯৮৬, ঢাকা, পৃ. ১২৬।
৩৪. খান, জাহিদ নেওয়াজ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২৯-৩০।