গত একুশে আগস্টে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় একটি চমৎকার আলাপচারিতার বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সব্যসাচী বসু রায়ের আলাপচারিতাই ঢাকার কোন প্রত্যাশাই পূরণ করেনি দিল্লী শিরোনামে উঠে এসেছে পত্রিকাটির পাতায়। নিঃসন্দেহে একটি প্রাণবন্ত আলাপচারিতার ছবি স্পষ্ট ভেসে ওঠে প্রকাশিত সংবাদটির মাধ্যমে। জানা যায়, এই আলাপচারিতাটি প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিলো কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়। তারই সূত্র ধরে দৈনিক জনকণ্ঠ তা প্রকাশ করে।
আলাপচারিতাটির শুরুতেই এসেছে গণজাগরণ মঞ্চের প্রসঙ্গ। শাহাবাগ আন্দোলন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও যে উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সে প্রসঙ্গেই প্রথম প্রশ্নটি করেন সব্যসাচী বসু রায়। তিনি প্রশ্ন করার ধাঁচেই জানতে চেয়েছেন- এ আন্দোলনের পরিণতি কী দাঁড়ালো। এখানে প্রথমেই বলে নিতে চাই, সব্যসাচী বসু রায়ের বক্তব্য বা আলোচনা আমার আগ্রহের বিষয় ছিলো না। এর দুটো কারণ- প্রথমত, গোটা আলাপচারিতাতেই তাঁকে আমার কাছে প্রশ্নকর্তা মনে হয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ যোগ করেছেন মাঝে মাঝে, কিন্তু তা কেবলই মূল প্রশ্নটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে পরিস্কারভাবে উপস্থাপন করার জন্য। দ্বিতীয়ত, একজন ভারতীয় অধ্যাপক হিসেবে বাংলাদেশের শাহাবাগ আন্দোলন কিংবা সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর আলোচনা কোনো সিদ্ধান্ত তৈরি করেনি। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যগুলো ছিলো সিদ্ধান্তকেন্দ্রীক। প্রায় প্রতিটি বক্তব্যেই তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কতোগুলো সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে তাঁর প্রজ্ঞা আর বিশ্লেষণী চিন্তাপ্রসূত। সেগুলো মুগ্ধ করেছে আমাকে। কিন্তু কতোগুলো বিষয়ে তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেই প্রসঙ্গেই এ লেখাটির সূত্রপাত।
পুরো আলাপচারিতায় মোট আটটি প্রশ্ন করেছেন সব্যসাচী বসু রায়। এর মধ্যে প্রথম ও ষষ্ঠ প্রশ্ন দুটি সম্পূর্ণ শাহাবাগ আন্দোলন সংশ্লিষ্ট। পঞ্চম প্রশ্নটি শাহাবাগ আন্দোলন সংক্রান্ত না হলেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরে শাহাবাগের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রথম প্রশ্নেই সব্যসাচী বসু রায় জানতে চেয়েছেন- শাহাবাগ আন্দোলনের পরিণতি কী দাঁড়ালো। প্রশ্নটিই আমার কাছে আপত্তিজনক ঠেকেছে ‘পরিণতি’ শব্দটির কারণে। তিনি ‘বর্তমান অবস্থা’ কিংবা ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতি’ জানতে চাইতে পারতেন; কিন্তু তিনি পরিণতি জানতে চেয়েছেন। ২০১৩ সালের পাঁচই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া একটি আন্দোলনের ঠিক কী পরিণতি ২০১৪ সালের শেষপাদে এসে জানতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক- এটা আমার বোধগম্য নয়। যেমন বোধগম্য হয়নি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের উত্তরের কিছু অংশ। যেমন: তিনি শুরুই করেছেন- ‘শাহাবাগ আন্দোলন ভাঙবার.. ..’ শব্দ তিনটি দিয়ে। তার মানে তিনিও মনে করেন- চেতনা-নির্ভর আন্দোলন আসলে কাঁচের গ্লাস! বলতে দ্বিধা নেই, শাহাবাগ আন্দোলন যে প্রত্যাশা আর সৎ-অনুপ্রেরণার অগ্নিমশাল জ্বেলেছে, তার সেই পূর্ববৎ রূপটি আজকে নেই। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের সুচিন্তিত মতামত হিসেবে এসেছে ‘একাধিক কারণ’- এর কথা এবং তিনি একই সঙ্গে যেমন চিহ্নিত করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের আভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়, তেমনি সরকারের ‘কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা’ পালনের প্রসঙ্গটিও তিনি এনেছেন। প্রতিটি বিষয় সত্য। কিন্তু আমার বিনীত প্রশ্ন- আন্দোলন কী সবক্ষেত্রে একই রূপে থাকে? ২০১৩ সালের পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে যে শাহাবাগ আমরা দেখেছি, সেই একই শাহাবাগ যদি এখনও দেখার প্রত্যাশা করি, তবে সেটা হবে বোকামি। কারণ, এই আন্দোলনের একমাত্র প্রতিপক্ষ যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সংগঠন জামাত-শিবির, আর এটাও সত্য যে, এ আন্দোলনের একটি গূঢ় রূপ হলো তার দার্শনিক সত্তা। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির যে ‘বাংলাদেশ-বিরোধী দর্শন’ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই তাদের হিংস্র ডালপালা প্রসারিত করেছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো অবশ্যই ‘মুক্তিযুদ্ধের দর্শন’টি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের যে গভীর দর্শন- তারই প্রেরণায় জন্ম নিয়েছে শাহাবাগের অহিংস আন্দোলন। এই দর্শনের ভিত্তিভূমেই দাঁড়িয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের ছয়দফা। এখন শাহাবাগ আন্দোলন কেবল আর শাহাবাগেই নেই, তা বাঙলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছেছে। এটাকে কি কেবলই ‘পরিণতি’ শব্দে চিহ্নিত করবেন স্যার? এখনও গণজাগরণ মঞ্চের ‘ঘরে ঘরে গণজাগরণ’ কর্মসূচীটি চলছে। মাসোত্তীর্ণ এই কর্মসূচীটি মাঝখানে রোযা ও ঈদের জন্য সাময়িক স্থগিত করা হলেও আবারও তার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতিটি জেলায় ছয়দফার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে গণজাগরণ মঞ্চ। এগুলো কী আন্দোলন ভেঙে গেছে- এমন কোনো ইঙ্গিত বহন করে?
ষষ্ঠ প্রশ্নের উত্তরে স্যারের শেষ অনুচ্ছেদটি আমাকে সত্যি বিষ্মিত করেছে। আনিসুজ্জামান স্যার লিখেছেন- ‘এখনও শাহাবাগে সভা হয়, কিন্তু লোক আর তেমন হয় না। এটা রাজনৈতিক আন্দোলন বা পরিস্থিতিরই ব্যর্থতা’। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনার এই বক্তব্য আমার তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের মতো মনে হয়েছে, যদিও আমি কল্পনাতেও আপনাকে সে স্থানে বসাই না কোনোদিন। প্রথমত- ‘রাজনৈতিক আন্দোলন বা পরিস্থিতি’ দিয়ে আপনি কী বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, যে প্রচলিত অর্থে রাজনীতির সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ- সে অর্থে কেউই শাহাবাগ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। শাহাবাগ আন্দোলনের প্রকৃতিটাই ছিলো এমন যে, এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়েছে শাহাবাগে। বৃহত্তর পরিচয় নিয়ে এখানে কেউ আসেনি, যেমন এখানে কেউ আসেনি কারও ডাকে। প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী-জামাত-শিবির সম্বন্ধে যে ঘৃণা, তারই একটি অগ্নি-স্ফূলিঙ্গ হলো শাহাবাগের গণ-বিষ্ফোরণ। মানুষ এখানে এসেছেন নিজের তাগিদে। নিজের হতাশা ও ক্ষোভ থেকে আমরা প্রত্যেকেই জড়ো হয়েছি শাহাবাগে। কিন্তু আন্দোলনের কিছু প্রথাগত কাজ থাকে। কাউকে স্লোগান দিতে হয়, কাউকে হারমোনিয়াম তুলে নিতে হয়, কেউ বা গলায় ঝুলিয়ে নেন ক্যামেরা, কেউ স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নেন লিফলেট বিতরণের। এরকম হাজার কাজ আমাদের মাঝে সম্পর্ক তৈরি করেছে। কাজ করতে গিয়ে সহযোদ্ধার স্বপ্ন-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এই আন্দোলনে তো মানুষ কারও অধীন নয় স্যার। এখানে তো কোনো নেতা নেই। আমাদের একের সঙ্গে অপরের একটাই সম্পর্ক- আমরা সহযোদ্ধা। শাহাবাগ আন্দোলন লোকসংখ্যা কতো হলো, তা দিয়ে নির্ণীত হয়নি; শাহাবাগ আন্দোলন চিহ্নিত হয়েছে তার অহিংস অবস্থানের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের জন্য সকলের নিঃস্বার্থ অবস্থানের জন্য এই আন্দোলন মাইলফলক। এই আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যে মা তাঁর সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বপ্নটি, দর্শনটি শৈশব থেকেই বুক পকেটে পুরে দিতে পারবেন, তার শাহাবাগ আসার দরকার নেই। তিনি অনেক বড়ো কাজ ঘরে বসেই করছেন। যে গণমাধ্যমকর্মী তাঁর সবটুকু সততা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গবেষণামূলক উপসম্পাদকীয় লিখছেন- তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই শাহাবাগ আসার। তিনি যেখানেই থাকেন না কেনো- আসলে তিনি শাহাবাগেই আছেন। স্যার, কতোজন লোক হলো, মিছিল বড়ো হলো কী না, সভার জনসংখ্যা কতো- এগুলোই যদি হিসেব করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আপনার চোখে শাহাবাগ আন্দোলন হতাশাব্যঞ্জক হতো না; কিন্তু সিলেটের জগজ্যোতি তালুকদার, ঢাকার রাজীব হায়দার, আরিফ রায়হান দীপের অপূর্ণ স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লক্ষ তরুণের কাছে, লক্ষ মায়ের কাছে শাহাবাগ আন্দোলন হতাশাব্যঞ্জক হয়ে পড়তো। মাফ করবেন স্যার, পাঁচই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ থেকেই শাহাবাগ জানে- অঙ্ক কষে কোনোদিন প্রতিবাদ করা যায় না।
আলাপচারিতার চতুর্থ প্রশ্নটি যদিও গণজাগরণ মঞ্চ সংশ্লিষ্ট ছিলো না, কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যারের উত্তরে প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে গণজাগরণ মঞ্চের বিষয়টি। তবে দুঃখজনক হলো- হয় স্যার বিষয়টা ভুল বুঝেছেন, না হয়ে ক্ষুদ্র সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি বুঝতে ভুল করছি। উত্তরের শেষ বাক্যে স্যার বলেছেন- গণজাগরণ মঞ্চ উদ্দীপনামূলক ছিলো, এখন শুধুই দৈনন্দিনতা। প্রথমেই বলে নেই- উদ্দীপনা তৈরির উদ্দেশ্যে গণজাগরণ মঞ্চ তার আন্দোলন তৈরি করেনি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পর তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে মানুষ, তারপর তৈরি হয় গণজাগরণ মঞ্চ। প্রতিবাদের বিষয়টি যেমন তৎক্ষণাৎ ছিলো, বোঝার বিষয়টি কিন্তু তা ছিলো না, বরং ছিলো উল্টো। আমরা যারা ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীশক্তির নানা অপব্যাখ্যার প্রতিবাদ ও খণ্ডন করেছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন সম্বন্ধে একটি স্বচ্ছ ধারণা আছে; যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শাহাবাগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম, তারা বহুদিন ধরেই এ দাবিগুলো নিয়ে কাজ করছেন, রাজপথে আন্দোলন করছেন; যে ছাত্র সংগঠনগুলো গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে তাদের অবস্থানও পরীক্ষিত। স্যার হয়তো বলবেন, অনেকে তো নেইও। তা ঠিক; অনেকেই নেই, কারণ খোন্দকার মোশতাকরা সত্যের পথে বেশিক্ষণ থাকে না। একমাত্র গুটি কয়েক স্বার্থবাদীরাই অনেক হিসেব-নিকেষ করে শাহাবাগে এসেছিলো, আজ তারা শাহাবাগের সাথে নেই- এটা আমার মতো একজন সাধারণ কর্মীর কাছে শাহাবাগের প্রশ্নে নিরাপদ মনে হয়েছে।
স্যারের বিভিন্ন উত্তরে শাহাবাগ আন্দোলনের প্রসঙ্গে ‘ভেঙে গেছে’ বাক্যাংশটুকুর ব্যবহার দেখে আমি মর্মাহত হয়েছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের মতোন বিদ্বজন যদি একটি ধ্রুব চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত অহিংস আন্দোলন ‘ভেঙে গেছে’ বলে সিদ্ধান্ত দেন, তবে কার কাছে গিয়ে বোঝাবো- চেতনার কোনো মৃত্যু নেই, আন্দোলন কখনও ভাঙে না। চেতনা আর সত্যের রাজপথ থেকে ব্যক্তির পদস্খলন হতে পারে, কিন্তু সমষ্টির কখনও হয় না। যে দুর্বার চেতনা নিয়ে শাহাবাগে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা সবাই- সেই ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখে, যে বিপুল জনসমাগম দেখে যুদ্ধাপরাধীদের সাথে ক্ষমতাসীন সরকারও কিছুটা নড়ে বসেছিলো; স্যার যদি মনে করে থাকেন, তাদের অনুপস্থিতিটা আসলে ভাঙন- তাহলে স্যার আপনি ঠিক বোঝেননি। গণজাগরণ মঞ্চের ছয়দফার মধ্যেই আছে এর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা। কেবল রাজপথে দাঁড়িয়ে সেই ছয়দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। এর জন্য যেমন ঘরেও কাজ করতে হবে, তেমনি বাইরে কাজ করতে হবে। তবে স্যার হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে গণজাগরণ মঞ্চ সম্বন্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা খবরের সূত্রেই বলেছেন- এটা ভেঙে গেছে। এ প্রসঙ্গে গত ২৪ জুন তারিখে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর রায় ঘোষণার দিন (যদিও পরে রায়টি ঘোষণা করা হয়নি ‘নিজামী অসুস্থ’- এই অভিযোগে এবং কবে রায়টি দেয়া হবে, তাও জানানো হয়নি) গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের বক্তব্যের একটি অংশ স্মরণ করছি। শাহাবাগে সেদিন বেশ কয়েকটি ব্যানারের উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের করা এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান এইচ সরকার বলেছিলেন- ‘এটাই শাহাবাগের সৌন্দর্য, কারণ আজ যুদ্ধাপরাধী নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে সবাই শাহাবাগে এসে জড়ো হয়েছেন। যে যার যার মতো করে একই দাবির কথা বলছেন’। শুরু থেকেই শাহাবাগে সকলের নিজস্ব অবস্থান ছিলো স্পষ্ট। আমরা দেখেছি, অনেকেই তখন বড়ো পর্দায় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখিয়েছেন- এটার জন্য তাদের কারও অনুমতি নেবার দরকার পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই অমোঘ বাণী- ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’- মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় গড়ে ওঠা শাহাবাগ আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের সত্যরূপ ফুটে উঠেছে। এখানে কোনো নেতা নেই; এখানে সবাই কর্মী আর সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য আছেন একজন মুখপাত্র। যে যার যার মতো শাহাবাগের আন্দোলনে অংশ নিয়ে চলেছে। এখন আপনার মতো একজন সম্মানিত শিক্ষক যদি বলেন- এটা ভেঙে গেছে, তাহলে সেটা দুঃখজনক স্যার।
একটি আন্দোলনের কোনো ভাঙন, কোনো পরিণতি, কোনো শেষ হয় না। আমি জানি না, শহিদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন সম্বন্ধে, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সম্বন্ধে শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যারের মন্তব্য কী হবে। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ মুক্তিযুদ্ধোত্তর তরুণকে গড়ে তুলেছে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন। আজকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের যে পটভূমি- তাও শহিদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনেরই একটি ধারাবাহিকতা, একটি গর্বিত অংশ। তাই আবারও, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যারের কাছে বলতে চাই- আন্দোলন কখনো ভাঙে না, উদ্দীপনামূলক কিংবা দৈনন্দিন হয় না; আন্দোলন কখনো শেষ হয় না; যেমন শেষ হয় না কোনোদিন জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটির শাশ্বত প্রাসঙ্গিকতা।