ওই মহামানব আসে… — ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটি রচনা করেছিলেন। খ্রিষ্টিয় পঞ্জিকা অনুযায়ী তারিখটি ছিলো— ১৪ এপ্রিল, ১৯৪১— অর্থাৎ রবীন্দ্র প্রয়াণের ঠিক ১১৬ দিন আগে। বিদায় বেলার জানালায় দাঁড়িয়ে ভৈরবী রাগের এই গানটি তবে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যত-দর্শন? কেননা, গানটি রচনার প্রায় ৩০ বছর পর এর একটি অলৌকিক দৃশ্যায়ন ঘটেছে সদ্য স্বাধীন বাঙলাদেশে। ১৯৭২ সালের দশই জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসেন বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— ফিরে আসেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে। এক যুদ্ধবিধ্বস্ত বিষণ্ন ভূমিতে তাঁর পদচ্ছাপ থেকে ফুটে উঠেছিলো কৃষ্ণচূড়া, সম্পন্ন হয়েছিলো আমাদের বিজয়ে মিছিল।
সেদিন কেমন ছিলো আমাদের গণমাধ্যমের লেখাগুলো? কেমন ছিলো তত্কালীন সংবাদপত্রের শিরোনামসহ অন্যান্য খবরগুলো? একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের গণমাধ্যমগুলোও যেনো সেদিন জেগে উঠেছিলো নতুন শব্দে, নতুন শিরোনামে। একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর বাঙলাদেশের বিজয় এলেও বিজয়ের পূর্ণতা এসেছিলো বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি।
১৯৭২ সালের দশ ও এগারো জানুয়ারির চারটি সংবাদপত্রের সেদিনের নানা আয়োজন লেখাটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দৈনিক ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ— গুরুত্বপূর্ণ এ চারটি পত্রিকাতেই সেদিন নানা আয়োজনে তুলে ধরা হয়েছিলো জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর। এছাড়াও আরও বেশ কিছু পত্রিকা (যেমন: দৈনিক সংবাদ) এ বিষয়ে খবর ও তথ্যাদি প্রকাশ করলেও পত্রিকাগুলোর নির্দিষ্ট দিনের কোনো কপি পাইনি। ফলে এ চারটি পত্রিকা ধরেই আলোচনাটি করা হলো।
বঙ্গবন্ধুময় প্রথম পাতা
দশ ও এগারো জানুয়ারি চারটি পত্রিকার প্রথম পাতাতেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর কোনো খবর নেই। থাকার কথাও নয়। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতাটি ছিলো শাদাকালো; বাকি তিনটি পত্রিকাই শিরোনামের ক্ষেত্রে লাল রঙ ব্যবহার করেছিলো।
মর্নিং নিউজ ও দৈনিক বাংলা — দুটো পত্রিকার প্রথম পাতাতেই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিলো এবং সেই বিজ্ঞাপনেও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। দুটি বিজ্ঞাপনই দিয়েছিলো ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক লিমিটেড — বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বাধীনে পরিচালিত একটি ব্যাঙ্ক। দৈনিক বাংলার বিজ্ঞাপনে রঙ থাকলেও, মর্নিং নিউজের বিজ্ঞাপনটি ছিলো শাদাকালো। দুটো বিজ্ঞাপনেরই ভাষ্য ছিলো এক। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির পিতা সম্বোধন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়েছিলো ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে প্রথম পাতাতেই সেদিন সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিলো দৈনিক ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ।
ইত্তেফাক সম্পাদকীয়র শিরোনাম করেছিলো— এস, বাংলার স্বাপ্নিক, স্বাগতম।
মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয়টির শিরোনাম— Spirit Triumphant.
পূর্বদেশ প্রথম পাতার বাঁ দিকের নিচে বক্সে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলো, যার শিরোনাম— বিশ্বে এলো নতুন বাদ মুজিববাদ।
চারটি পত্রিকার প্রথম পাতাতেই প্রকাশিত আলোকচিত্রের সংখ্যা কম হলেও প্রতিটি আলোকচিত্রই নিজস্ব ভাষা বহন করে। দৈনিক বাংলা বঙ্গবন্ধুর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি এবং পাতার একেবারে নিচের দিকে মুক্তির পর তোলা বঙ্গবন্ধুর প্রথম ছবিটি প্রকাশ করে। ছবিটির ক্যাপশন অনুযায়ী বর্বর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রথম আলোকচিত্র। সঙ্গে ড. কামাল হোসেনকেও দেখা যায় ছবিতে। ক্যাপশন অনুযায়ী— এই ছবির ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। তবে ছবিটি কে তুলেছিলেন, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশ করে দুটো ছবি। একটি বঙ্গবন্ধুর— পাতার উপরে ডানপাশে; অন্যটি কনিষ্ঠ কন্যাসহ বাঙলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের— পাতার একেবারে নিচের দিকে।
পূর্বদেশ পত্রিকাটি যেহেতু ১১ জানুয়ারি তারিখের; সেহেতু তার প্রথম পাতার ছবিটি দশ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। আলোকচিত্রীর নাম— মানু মুন্সী।
পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরগুলোও বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পরের মুহূর্তের। ফলে এই পত্রিকাটি দেখলে জাতির জনকের বক্তব্যের অনেকগুলো দিক পাওয়া যায়। যেমন: গণহত্যার তদন্ত হবে— শিরোনামে তারা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের আলোকে সংবাদ পরিবেশন করেছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হলো— তোমরা বাংলার মানুষ হও। তিনি অবাঙালিদের উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছিলেন এবং এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন— যারা দালালী করেছে, তাদের বিচার হবে। কিন্তু সেই বিচারের বিষয়ে তিনি সরকারের ওপর জনগণকে আস্থা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ছোটোবেলা থেকেই শুনেছি বঙ্গবন্ধু নাকি বাঙলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন— ‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা..’। কোথায়, কোন বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেছিলেন— তার কোনো হদিশ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি।
যদি এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রোপাগান্ডাটি তৈরি করা হয়, তাহলে আমার বক্তব্য হলো— প্রথমত, ‘বাঙালি’ হওয়া আর ‘বাঙলার মানুষ’ হওয়া এক কথা নয়; দ্বিতীয়ত, কথাটি তিনি বলেছিলেন অবাঙালিদের (যাদের চেনা নাম হচ্ছে ‘বিহারি’, যদিও তারা সকলেই বিহার থেকে আসেননি) বলেছিলেন, কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তারা বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এবং পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীকে জেনোসাইডে সমর্থন করেছে। কিন্তু সকলেই নিশ্চয়ই করেনি, ফলে বঙ্গবন্ধুও সকলের কথা বলেননি— তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন—
যারা দালালী করেছে, আমার শত-শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে মা-বোনকে বেইজ্জত করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না।
কবিতা ও শিরোনাম মিলেমিশে একাকার
দশ ও এগারো— এই দু’ দিনের সংবাদপত্রের প্রায় সবগুলো শিরোনামই কবিতার মতো। কোথাও কোথাও সরাসরি কবিতার পঙক্তিকেই গ্রহণ করা হয়েছে শিরোনাম হিশেবে। আজকের দিনে সংবাদপত্রের শিরোনামে আমরা আর সেভাবে কবিতা খুঁজে পাই না। দৈনিক ইত্তেফাক দশ জানুয়ারির পত্রিকায় সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ওই মহামানব আসে… গানের প্রথম দুই কলি শিরোনাম হিশেবে ব্যবহার করেছে।
এগারো তারিখের পত্রিকায় স্বাভাবিকভাবেই দশই জানুয়ারিতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তব্য থেকে শিরোনাম করা হয়েছে। জনসভার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ইত্তেফাক রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙক্তি গ্রহণ করেছে— মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক।
পূর্বদেশও রবীন্দ্রনাথের গানের আশ্রয়ে খুঁজে নিয়েছে নিজেদের ঐতিহাসিক শিরোনাম। কেবল গানের তৃতীয় কলিকে তারা প্রথমে ব্যবহার করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে— রবীন্দ্রনাথের এই গানটিও ভৈরবী রাগের।
প্রথম পাতার আরেকটি শিরোনাম— যদিও কোনো কবিতার পঙক্তি নয়— তবুও কবিতার মতোনই তার উচ্চারণ-অর্ঘ্য—
বাংলার প্রাণ ফিরেছে বাংলায়
দৈনিক বাংলা সরাসরি কোনো কবিতার পঙক্তি গ্রহণ করেনি কিন্তু তার প্রায় প্রতিটি শিরোনামই হয়ে উঠেছিলো কবিতার মতো। প্রথম পাতার মূল শিরোনামটি ছিলো—
জয় বাংলা, জয়তু মুজিব
প্রথম পাতারই আরেকটি শিরোনাম, আমার মতে, যেটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটি অনন্য স্মারক—
পরিবারের নাম বাংলাদেশ, স্বজনের নাম বঙ্গবন্ধু
মর্নিং নিউজের শিরোনামটি আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শাদামাটা; কিন্তু যদি ভেবে দেখি বাহাত্তরের সেই দিনটির কথা— কোটি কোটি মানুষ অপেক্ষা করছেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার জন্য, এই মানুষ রক্ত-ত্যাগ-দীর্ঘশ্বাস পেরিয়ে আসা মানুষ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে— তাঁদের প্রিয় নেতা আসবেন বলে; এই অমিত সাহসী মানুষদের কাছে মর্নিং নিউজের আপাত সাধারণ শিরোনামটিই হয়ে উঠেছিলো প্রাণবার্তা। তাঁরা জানতে পারলেন—
BANGABANDHU ARRIVES TODAY
সম্পাদকীয় জুড়ে কেবলই বঙ্গবন্ধু
আগেই বলেছি— দৈনিক ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয় ছিলো প্রথম পাতায়। তবে মর্নিং নিউজ আরেকটি লেখা ছেপেছিলো Agony And Joy শিরোনামে। লেখাটি ছাপা হয়েছিলো— সাধারণত পত্রিকার সম্পাদকীয় যেখানে ছাপা হয়— সেখানে। পুরো লেখাটি জুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতীক্ষা। বঙ্গবন্ধুর ফেরা নিয়ে রেডিও পাকিস্তান ও ইসলামাবাদের ক্রমাগত মিথ্যাচার আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছল-চাতুরিপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনের দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হয়েছিলো লেখাটি। লেখাটি শেষ করা হয়েছিলো এ উদাত্ত অনুভূতি নিয়ে—
We share our joy with all who wish Bangladesh well, especially our friends who helped us when we are fighting to liberate ourselves.
বরাবরের মতোই সাধু ভাষায় লেখা দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়টি কী অসামান্য কাব্যিকতায় ঋদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ত্যাগ-কষ্ট-সাহস-শৌর্যের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁদের ব্যাকুল প্রতীক্ষার রূপায়ন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের উল্লেখ এমনভাবে করা হয়েছে যেনো পরাধীন বাঙালি ও স্বাধীন বাঙালির মাঝখানের রক্তস্নাত পথের মানচিত্র ছিলো ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ।
পূর্বদেশ এগারোই জানুয়ারিতে তাদের সম্পাদকীয়র শিরোনাম করেছিলো—
নির্দেশ তোমার মাথায় তুলে নিলাম
সম্পাদকীয় হলেও— শেষ অনুচ্ছেদে লেখার ধরনটি বদলে গেছে। জাতির জনকের ভাষণের ধারাবাহিকতার সূত্রে লেখাটি হয়ে উঠেছিলো অনেকটাই আপামর জনগণের ভাষ্য। বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ত্যাগ আর শ্রমের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে জনকের স্বপ্নের সোনার বাঙলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের সংকল্পে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
দৈনিক বাংলা দশ জানুয়ারিতে সম্পাদকীয়র শিরোনাম করেছে—
বীরের শোণিতে তোমায় বরণ করি
এই সম্পাদকীয় ভীষণভাবে জনমানস সম্পৃক্ত— কেননা, মেহনতি কৃষক, সংগ্রামী মজদুর, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ি, বুদ্ধিজীবী— সারা বাঙলার সাতকোটি প্রাণকে একপ্রাণ হবার আহবান এই লেখাটিতে ছিলো স্পষ্ট।
বিশেষ সংখ্যা
চারটি পত্রিকার মধ্যে দুটো পত্রিকা— দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা— বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলো। ইত্তেফাক তার বিশেষ সংখ্যার প্রথম পাতার একেবারে উপরে লিখেছিলো—
মুক্তির সংগ্রাম সেরে/ ফিরে সপ্নময় ঘরে।
‘স্বপ্ন’ বানানটিকে কেনো ‘সপ্ন’ লেখা হয়েছিলো— সেটা জানি না। সম্ভবত ছাপার ভুল হয়েছিলো। ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যার লেখা ও লেখকদের তালিকাটি নিম্নে দেয়া হলো—
মহান নেতার চিন্তারাজ্যের একটি দিক— হাবিবুর রহমান মিলন
শেখ মুজিবুর রহমান: বাঙ্গালীর দ্বিতীয় প্রাণ (একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য)— রাহাত খান
শেখ সাহেব: ব্যক্তিমানস— শফিকুল কবির
অন্যদিকে দৈনিক বাংলার বিশেষ সংখ্যার শিরোনাম ছিলো—
জয়তু বঙ্গবন্ধু
এই সংখ্যার লেখাগুলোর শিরোনাম থাকলেও লেখকদের কোনো নাম নেই। সম্ভবত পত্রিকার সাংবাদিকরা অনেকে মিলেই বিশেষ সংখ্যার লেখাগুলো তৈরি করেছেন, ফলে নির্দিষ্ট কারও নাম দেয়া হয়নি। লেখাগুলোর শিরোনাম—
- বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন
- সংগ্রামের ইতিকথা
- বজ্রকণ্ঠ
দৈনিক বাংলার এই তিনটি লেখা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস বোঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইত্তেফাক যেমন তিনজন নির্দিষ্ট লেখকের চিন্তার আলোকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দর্শনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে, দৈনিক বাংলার আয়োজনটি সেরকম ছিলো না। তারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি মানচিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছে এই তিনটি লেখার মাধ্যমে এবং তার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিশ্লেষণ করেছে।
অন্যান্য সংবাদ
এছাড়াও এই চারটি পত্রিকাতেই আরও নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো— তবে সেগুলোর অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন: দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার নিচের দিকের একটি সংবাদ—
ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ইশতেহার: ইতিহাসের ঘড়ির কাঁটা উল্টাদিকে ঘুরাইবার চেষ্টা করিবেন না।
এই সংবাদের সঙ্গেই বক্স করে আরেকটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিলো—
ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের আহবান
ইত্তেফাকের তৃতীয় পাতায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর একটি বক্তব্যের আলোকে সংবাদ দেয়া হয়েছে, যার শিরোনাম ছিলো—
আমার আনন্দ— বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ফিরিয়াছেন
পূর্বদেশ পত্রিকার ভেতরের পাতায় একটি সংবাদ করা হয়েছিলো—
ইয়াহিয়া গণহত্যার জন্য অপরাধী
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে উদ্দেশ্য করে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজ্জীবন রামের একটি মন্তব্য দিয়ে একই পাতার আরেকটি সংবাদ ছিলো—
নিক্সনের প্রতি রাম: উপমহাদেশের ব্যাপারে নাক গলাবেন না
দৈনিক বাংলার তৃতীয় পাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছিলো—
বাংলাদেশে ডাক, তার ও নৌযান: পাকবাহিনী ১৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার সম্পদ নষ্ট করেছে
০৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে কোলকাতার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগাযোগ দফতরের মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ এই পরিসংখ্যানটি তুলে ধরেছিলেন। এই সংবাদটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী এদেশে কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধই করেনি, তারা এদেশের সম্পদ নষ্ট করেছে পৈশাচিকভাবে। এইসব অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনার সময় এখন এসেছে।
মর্নিং নিউজের পাঁচ নম্বর পাতার একটি খবর দেখার পর আমি ঠিক করেছি— এই পত্রিকার অন্য খবরগুলো নিয়ে আর আলোচনা নাইবা করলাম না। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এই খবরটি আমার কাছে কিছুটা কৌতুকোদ্দীপকও বটে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তানসহ তাদের মিত্র পরাশক্তিগুলো পরাজিত হয়েছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেছেন, তিনি ফিরে আসছেন স্বদেশের জনগণের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি। মর্নিং নিউজ শিরোনাম করেছে—
Ministers call on Mushtaque.
এখানে কেবল জাতীয় চারটি পত্রিকার নির্দিষ্ট দু দিনের প্রকাশিত সংখ্যার সামান্য আলোচনা করা হলো। তত্কালীন আন্তর্জাতিক নানা সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ভীষণ প্রয়োজন। কেননা, প্রতিটি সংবাদভাষ্য, প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয়তে আমাদের ইতিহাসের নানা ছোটো ছোটো বিষয় লুকিয়ে আছে। আমাদের কর্তব্য এগুলো খুঁজে বের করা।
আর এ কথা তো ঐতিহাসিক সত্য যে— আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দিনটি আসলে বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি, আমাদের পূর্ণাঙ্গ বিজয় দিবস।
ঋণ স্বীকার
তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় আর্কাইভের সৌজন্যে প্রাপ্ত।