দৃষ্টিজুড়ে আলো থাকলেই অন্ধকার ঘুচায় না। আঁধারেরও একটা রঙ আছে, তারও একটা সত্তা আছে। ওইটুকু বাদ দিলে যে নিকষ ভয়ঙ্কর রাত্রির পর্দা নামে, তাতে ভয় ধরে; ভয়ার্ত মনের মধ্যে বাসা বাধে শব্দেরা; শব্দগুলোর কান্না পায়, চিৎকার করে কাঁদে, কেবল কাঁদে আর কাঁদে; ইতিহাসের পনেরো খণ্ডে শব্দগুলো আমার বুলেট হয়ে যায়।
আমি তোমাদের বিস্তীর্ণ ব্যস্ত জীবনে হয়তো সামান্য ভূমিকা রাখি। তোমাদের কিউবিক মগজে আমার ঠাঁই আছে, আমি জেনে প্রীত হই। তিনশত পঁয়ষট্টি দিনের গোলাকার জীবনে বারবার সেই একই ছবি দেখা, সেই একই চেহারা ঘুরে ফিরে আসে। মোমবাতি জ্বালাও, গান গাও প্রাণভরে, ফুল দাও গণ-কবরে; তারপর সব শেষ হলে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তালির খবর জানাও। তালি দাও, তালি পাও- যেমন তালি বাজানো চলে থিয়েটারে, যেনো দেশ আর ইতিহাস- সবই তোমার মঞ্চস্থ হয়।
তারপরও- হে বাঙালি, আরেকবার চোখটাকে মোছো; অশ্রু নয়, পিচুটি পরিস্কার করো। ঘুমভাঙা মধ্যরাতকে শরীরে জড়াও, যেমন জড়াতে মায়ের আঁচল; যদি তোমার প্রেয়সীর চুলে বিনুনি করা থাকে, তবে খুলে দাও সে চুল, মুক্তকেশী দেবী হয়ে সে শুনুক আমার কথা। আমার দীর্ঘ ইতিহাস-কথন।
আমি পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত, আমার জন্ম উনিশশো একাত্তর সনে; আমি পঁচিশে মার্চ; কদর্য বর্বরের উদ্ধত শাসনে আমি এক ভয়াল মৃত্যুর রাত্রি, তোমার ইতিহাস জুড়ে রক্তের বন্যা বইয়ে চলছি। আমি, আমার কথা বলতে এসেছি।
আগেই বলেছি, বড়ো দীর্ঘ আমার ইতিহাস। এ ইতিহাস তোমাকে পড়তে হবে তোমার প্রয়োজনেই, তোমার অস্তিত্বের প্রয়োজনেই। যদি দীর্ঘ ইতিহাস পড়তে না চাও, তুমি চলে যাও- আমি একবারও ফিরে ডাকবো না তোমাকে।
সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ: ভূমিকার আগের অধ্যায়
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ছিলো বাঙালির উপর চাপিয়ে দেয়া পাকিস্তানিদের যুদ্ধ। লক্ষ্য করো বাঙালি, তুমি যুদ্ধ চাওনি, কোনোদিন চাওনি। তুমি কেবল চেয়েছিলে, সত্তরের নির্বাচনে তুমি যে ভোট দিয়েছো, তোমার ভোটাধিকারের মাধ্যমে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তুমি তাঁদের চেয়েছিলে সংসদে দেখতে। তোমার মনে পড়ে বাঙালি, সে-ই নির্বাচনের ফলাফলটি, ধ্রুব কাব্যের মতো যা তোমাকে তোমার অধিকারের প্রশ্নে শিহরিত করেছিলো সেদিন, সে-ই উত্তাল সত্তরে।
কিন্তু হায় বাঙালি! তুমি যে পড়েছিলে অসুরের চক্রে, ইয়াহিয়া ছিলো পৃথিবীর এবং সম্ভবত মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানব-আদলের নরপিশাচ। অতএব তোমার অধিকার ছিলো জেনারেলদের বিলাসী কফির তলানি, তুমি তবুও ছিলে অনন্য, কারণ তোমার ছিলো বঙ্গবন্ধু, ছিলো তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মতো নেতা; ছিলো ইত্তেফাক আর সিরাজুদ্দীন হোসেন, ছিলো ছাত্র রাজনীতির প্রগাঢ় অধ্যায় এবং কী আশ্চর্য, তুমি লড়াই চালিয়ে গেলে, নেমেসিসের বিরুদ্ধে লড়াই, অসুরের বিরুদ্ধে লড়াই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই।
নির্বাচনের বিজয়ের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করে। ফলে সত্তরের নির্বাচনের পর বাঙালির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নির্বাচনের ঠিক দুদিন পরেই বিজয়ী জননেতা বঙ্গবন্ধু এক ঘোষণায় জানান যে-
নির্বাচনে এ বিজয় জনগণের পক্ষে আওয়ামী লীগের ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফা সমর্থনের ভিত্তিতে অর্জিত হয়েছে এবং এই ভিত্তিতেই অর্থাৎ আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসনের ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র রচিত হবে।১
এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে দেরি হয়নি। সম্ভবত আওয়ামী লীগ প্রধানের এ বক্তব্যের জবাব দিতেই ২০ ডিসেম্বর লাহোরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলে-
আমার দলের সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরি করা যাবে না, কিংবা কেন্দ্রে কারো পক্ষে সরকার গঠন বা সরকার পরিচালনা সম্ভব হবে না।২
এই বক্তব্য ছিলো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ এবং সেই সঙ্গে হুমকিও। এর অর্থ স্পষ্ট: তোমরা যতো সংখ্যাগরিষ্ঠই হওনা কেনো পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া কোনো কিছুই চলবে না। আশ্চর্য যে, পশ্চিম পাকিস্তান বলতে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার পিপলস পার্টির সমর্থক দেশই বুঝিয়ে এসেছে। হিসাবে আনেনি নির্বাচনের বাস্তব সংখ্যাতত্ত্ব, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে তার বিরোধী দলগুলোর আসন সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।
নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি এবং প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়ের একটি অনন্য দলিল ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চে টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ, যার শিরোনাম ছিলো- ‘পাকিস্তান: জিন্নাহর বিলীয়মান স্বপ্ন’। নিবন্ধটির বাঙলা অনুবাদ নিচে দেয়া হলো।
সংলাপ আর সংলাপ ভাঙার কারণ: কে দায়ী
এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে- সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি তার মুক্তির ঊষা খুঁজে পেয়েছিলো। কিন্তু ঊষা সন্ধ্যায় অস্তমিত হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তৈরি রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে। সঙ্কটের সূচনালগ্ন থেকেই, পরিস্থিতি যখন জটিল হতে শুরু করেছে তখন থেকেই পূর্ব-পাকিস্তানের গর্ভনর ভাইস-অ্যাডমিরাল আহসান এবং মূলত পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে ইয়াকুব খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে আসছিলো সঙ্কটের রাজনৈতিক ফয়সালা করে নিতে, ঢাকায় এসে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে মওলানা ভাসানী, ওয়ালী খান থেকে আসগর খান সবার মুখে সেই কথা- সদিচ্ছা ও সংলাপ।
শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলো, নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে। প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনাও শুরু করলো। ডেকে পাঠালো পিপিপি-প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। আরও আসলো পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা। কিন্তু সবকিছুই লবডঙ্কা।
সেদিনের খবরগুলো তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি বাঙালি; আমি জানি তুমি ভুলোনি, তোমার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা আমি মনসামঙ্গল কাব্যে পড়েছিলাম। তবুও চোখ বুলিয়ে নাও একবার, পাকিস্তানের চাতুরি আর বেঈমানের তড়িকায় এক দলা থু থু ফেলে যাও।
আমি জানি, এতেই তোমার চলতো। যুদ্ধটা যে তুমি চাওনি, ওটা যে তোমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই যুদ্ধ যে “শ্যাখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার লোভ” থেকে বাঁধেনি, সেটা বুঝতে উপরের তথ্যসূত্রগুলোই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু জানো কি, তোমাকে নিয়ে আমার বিশ্বাস আর আগের সুরে বাজে না। কী করে বাজবে বলো, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীরাই তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চলছে। তাই আমি, পঁচিশে মার্চ, উনিশশো একাত্তর আর বাঙালিকে বিশ্বাস করি না। তাই তোমার কষ্ট হলেও একবার একটু চোখ বুলাও নিচে। ১ মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ ও মর্নিং নিউজ এ উঠে আসা বাঙলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের চিত্র।
পঁচিশে মার্চের সন্ধ্যা, সাল উনিশশো একাত্তর
সেদিনের সন্ধ্যেটা অনেক ঘটনাবহুল ছিলো। আমি কোত্থেকে যে শুরু করবো। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানের রূপসী বাংলা) থেকেই শুরু করি। সেখানে সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন আসে। জনা চল্লিশের মতো বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন সেখানে। তো সেই ক্যাপ্টেন এসে কড়া হুকুম জারি করলো- হোটেলের বাইরে যাওয়া চলবে না কারও। গেলেই গুলি। প্রচ্ছন্ন হুমকি, বোঝাই যাচ্ছিলো। সেদিনের একটা স্মৃতিচারণ পাওয়া যায় তৎকালীন ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং-এর কাছ থেকে। সাইমন ড্রিংকে চিনেছো তো? তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য বন্ধু, যাকে তোমরা দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলে, অপমান করেছিলে। এই বাঙলাদেশের জন্মের সময়ের এক অকৃত্রিম বন্ধুকে তোমরা বের করে দিয়েছিলে, যেখানে তোমরা নাগরিকত্ব দিয়েছিলে গোলাম আযমকে। বাঙালি, মেরুদণ্ডহীন কাকে বলে জানো? আয়নার সামনে দাঁড়াও, দেখতে পাবে। সেই সাইমন ড্রিং বলছিলেন
.. ..দিনের বেলা একবার শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। খুব চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। রাত নয়টার দিকে খবর পেলাম সেনাবাহিনীর একটি কলাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে শহরে প্রবেশ করেছে। কি ঘটছে? জানার জন্যে মন ছটফট করলেও উপায় ছিল না। সৈন্য চলাচলের খবর দিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফোন করলাম শেখ মুজিবের বাসায়। তিনি জানালেন, বোধ হয় ওরা আমাকে ধরতে আসছে। বললাম, আপনি আত্মগোপন করছেন না কেন? স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, আমাকে খুঁজে না পেলে ওরা সারা শহর জ্বালিয়ে দেবে।
এরপর আরও আছে, আরও অনেক বলেছেন সাইমন ড্রিং; সবটুকু তুলে দিতে পারলাম না, তুমি অনুভব করো বাঙালি- পঁচিশে মার্চ কেমন করে তোমার ইতিহাসে রক্ত বইয়ে দিয়ে গেলো।
পঁচিশে মার্চ, রাত: অপারেশন সার্চ লাইট
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর কথা অনেক শুনেছো। নূতন করে বলবার কিছুই নেই। তবুও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ এর প্রথম খণ্ড থেকে খানিক উদ্বৃত করছি।
২৫ মার্চ ১৯৭১। তেজগাঁও এয়ারপোর্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বিশেষ বিমানে আরোহনের ঠিক আগে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল টিক্কা খানের দিকে তাকান। তারপর বলেন- ‘ওদের শায়েস্তা কর’। দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর কাছ থেকে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ চালাবার নির্দেশ আসে। এরপর মধ্যরাতেই ঢাকার বাঙালিদের ‘শায়েস্তা করার’ অভিযান শুরু হয়। এই অতর্কিত সামরিক অভিযানে হাজার হাজার নিরীহ, অসহায় বাঙালির জীবন প্রদীপ নিভে যায়।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর রাত্রি সংযুক্ত পাকিস্তানের শেষ রাত্রি। মুসলিম জাতিতত্ত্বের ধারণা সমাধিস্থ হয় এই রাত্রেই। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচণ্ড এক ধাক্কায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় সে রাতে। এ অভিযান থেকেই উদগত হয় বাঙালির ব্যাপক গণযুদ্ধর এবং শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ সম্বন্ধে পাকিস্তানি পরিকল্পনার কথা জানা যায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক লিখিত উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থ থেকে। সেখান থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্বৃত হলো-
মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ২৫ মার্চ রাজনৈতিক আলোচনার ফলাফল জানার জন্যে উদগ্রীব হয়েছিলেন, সকাল প্রায় ১১ টার সময় তার সবুজ টেলিফোন বেজে উঠলো, লে. জেনারেল টিক্কা খান লাইনে ছিলেন, তিনি বললেন, “খাদিম এটা আজ রাতে”। এ খবর খাদিমের মনে কোনো উন্মাদনার সৃষ্টি করলো না, তিনি হাতুড়ির আঘাত পড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। খাদিম তার অধীনস্থ মহলে আদেশটি বাস্তবায়নের জন্যে নির্দেশ দিলেন। খবর যতোই নিচের দিকে যাচ্ছিলো, ততোই উত্তেজনা বাড়ছিলো। আমি দেখলাম, কয়েকজন জুনিয়র অফিসার কয়েকটি অতিরিক্ত রিকয়েলেস রাইফেল (ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী) ও অতিরিক্ত গোলাবারুদ সংগ্রহ এবং একটি ত্রুটিপূর্ণ মর্টার বদলানোর চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে আনীত ‘২৯ নং ক্যাভালরি’র ৬টি এম-২৪ ট্যাঙ্কে রাতে ব্যবহারের জন্যে জ্বালানি বোঝাই করা হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় ভীতি প্রদর্শনের জন্যে ওই ট্যাঙ্কগুলোই যথেষ্ট। ১৪শ ডিভিশনের সদর দপ্তর থেকে ঢাকার বাইরে অবস্থিত সব গ্যারিসনে আক্রমণের সময় বা ‘এইচ আওয়ার’ এর কথা জানিয়ে দেয়া হয় একটি গোপন সংকেতের মাধ্যমে, যাতে সব গ্যারিসন একসাথে অভিযান শুরু করতে পারে। ‘এইচ আওয়ার’ নির্ধারিত হয়েছিলো ২৬০১০০ ঘণ্টা, অর্থাৎ রাত ১টা, ২৬ মার্চ। অনুমান করা হয়েছিলো, পঁচিশ মার্চ রাত বারোটার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ইয়াহিয়া খান করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন।… …
জেনারেল টিক্কা খান সিদ্ধান্ত দিলেন, ব্রিগেড (বিশেষ করে ব্রিগিডিয়ার আরবারের ব্রিগেড) নিম্নরূপ অ্যাকশনে যাবে।
ক. ১৩ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকবে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে এবং প্রয়োজনবোধে ক্যান্টনমেন্ট রক্ষা করবে।
খ. ৪৩ নং লাইট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় মোতায়েন এবং দায়িত্বে থাকবেন।
গ. ২২ নং বেলুচ রেজিমেন্ট ইতোমধ্যে পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে মোতায়েন রয়েছে, তারা পাঁচ হাজার ইপিআর জোয়ানকে নিরস্ত্র করবে এবং ওয়ারলেস অ্যাক্সচেঞ্জ দখল করে নেবে।
ঘ. ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ১ হাজার দৃঢ়চেতা পুলিশকে নিরস্ত্র করবে। এই পুলিশরা আওয়ামী লীগের সশস্ত্র বাহিনীর মূল শক্তি।
ঙ. ১৮ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট নবাবপুর ও পুরোনো ঢাকায় অভিযান চালাবে, যেখানে অনেক হিন্দু বাড়ি অস্ত্র ভাণ্ডারে রূপান্তরিত হয়েছে বলে জানা যায়।
চ. ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বালুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী করে গঠিত একটি সমন্বিত বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল এলাকায় অভিযান চালাবে, যেগুলো আওয়ামী বিদ্রোহীদের শক্ত কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
ছ. স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (কমান্ডো) বাহিনীর একটি প্লাটুন মুজিবের বাড়ি আক্রমণ এবং তাকে জীবন্ত ধরে আনবে।
জ. এক স্কোয়াড্রন এম-২৪ ট্যাঙ্ক সকালের আগে শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় দেখা দেবে এবং প্রয়োজনে গোলাবর্ষণ করবে।
অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনাটা নিচে দেয়া হলো। দেখো বাঙালি, যাদের জন্যে তোমরা ‘মুসলমান ভাই-ভাই’ তত্ত্বে ডিম পাড়ো, ডিমে তা দাও, তারপর মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের বাচ্চা ফুটাও, তারা কেমন নৃশংস পরিকল্পনা করেছিলো, তোমাকে শেষ করে দেবার জন্যে। দেখো বাঙালি-, দেখো; স্বাধীনতার পর একচল্লিশ বছরে এসে ঠেকলো তোমার বাঙলাদেশ, এবার একটু বুঝতে চেষ্টা করো।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা ‘জেনোসাইড বাঙলাদেশ’ অভিযান পরিকল্পনার যতোটুকু সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে ‘আইএসআই’ বা ‘ইন্টার সার্ভিস ইন্টিলিজেন্স’- এর দ্বারা অনুমোদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর এবং রাজাবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। পাকিস্তানি জেনোসাইড, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘ম্যাসাকার’ নিয়ে বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা অবমোচনের জন্যেই সত্য-মিথ্যামিশ্রিত তথ্যে ভরপুর মেজর সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সেরেন্ডার গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছিলো। এই গ্রন্থ ছিলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা বা বাঙালি নিধনযজ্ঞের সাফাই গাওয়ার প্রয়াস।
সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে বলেছে, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের অভিযানের ফলাফল পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার দেওয়া বিবরণী সংক্ষেপে বাঙলায় উদ্ধৃত করছি-
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাকবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে। রাস্তার পাশের এলাকা পুরনো গাড়ি এবং স্টিমরোলার দিয়ে বন্ধ করা ছিলো। ব্যারিকেডের শহরের দিক থেকে কয়েকশ আওয়ামী লীগার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিলো। আমি জেনারেল টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই উচ্চকিত স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে রাইফেলের কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনলাম। একটু পর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গর্জন বাতাসে ভেসে এলো। তারপর গোলাবর্ষণ এবং স্লোগানের মিশ্র শব্দ শোনা গেলো। মাঝে মাঝে এলএমজির গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। ১৫ মিনিট পর শব্দ কমে এলো এবং স্লোগান মিলিয়ে গেলো। সেনাবাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। অস্ত্রের জয় হলো। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অভিযান শুরু হয়ে যায়। এখন আর ‘এইচ আওয়ার’-এর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। কারণ ইতোমধ্যেই নরকের দরজা খুলে গেছে। … মুজিব যখন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আদমজী স্কুলে বন্দি অবস্থায়, তখন ঢাকা মহানগরী গৃহযুদ্ধের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। আমি টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চার ঘণ্টা যাবত সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো- গোলাবর্ষণের ফলে আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা, একেক সময় আগুনের হল্কা এবং ধোঁয়া তারার দিকে সমপ্রসারিত আকাশের মেঘকে গ্রাস করে ফেলছিলো।
২৬ মার্চ সকালে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শেষ হওয়ার খবর জানায়। জেনারেল টিক্কা খান ভোর পাঁচটায় তার সোফা ছেড়ে অফিসে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর চশমা সাফ করতে করতে বেরিয়ে আসেন। সমগ্র অঞ্চল পর্যবেক্ষণের পর তিনি বলেন, ‘না কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই’। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি ওই কথা শুনতে পাই এবং চারদিকে তাকিয়ে আমি কেবল একটি নেড়ি কুকুরকে লেজ গুটিয়ে শহরের দিকে চলে যেতে দেখি। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে সেনাবাহিনী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল [বর্তমান রূপসী বাংলা] থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলো। প্লেনে ওঠার আগে তিনি গত রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তার ‘এসকর্ট’ ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বলেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান বেঁচে গেছে’। করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছে তিনি তার ওই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন ওই মন্তব্য করেছিলেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণ-কবরগুলো জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিলো। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিলো না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইকবাল হলে ২টি এবং জগন্নাথ হলে ৪টি রকেটের আঘাত লাগে, ঘরগুলো জ্বলে গেলেও অটুট ছিলো, কয়েক ডজন আধপোড়া রাইফেল এবং কিছু কাগজপত্র তখনও জ্বলছিলো। ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ভয়াবহ; কিন্তু জেনারেল টিক্কার সদর দফতরের বারান্দা থেকে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলাম, ঠিক ততটা নয়। বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হাজার খানেক লোককে হত্যর কথা লেখা হলেও অফিসাররা সেই সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিলো, তবে স্বীকার করা হয়েছিলো ৪০ জনকে হত্যা করার কথা।
মেজর সিদ্দিক সালিকের সত্য, অর্ধসত্য ও অসত্যমিশ্রিত ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের উপর্যুক্ত বিবরণী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আগ্রাসনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি এলাকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিদের বিবরণী মিলিয়ে দেখলেই মেজর সিদ্দিক সালিকের প্রচারণার ফাঁক-ফোকর ও সাফাই ধরা পড়ে। প্রথমেই বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেন কর্তৃক টেপে ধারণকৃত অ্যাকশনরত পাকিস্তানি বাহিনীর ইউনিটগুলোর ওয়্যারলেস সংলাপগুলো শোনা যায়৩।
লেখক ড. মোজাম্মেল হোসেন একজন বিজ্ঞানী। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানি সেনারা যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো তখন পাকসেনাদের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে কথোপকথন তিনি রেডিওতে শোনেন ও তার অংশবিশেষ টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখেন। ওই টেপের বিশেষ বিশেষ অংশ কপি করে বন্ধুর সাহায্যে কোলকাতায় পাঠান। ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি আকাশবাণী কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ বিচিত্রায়’ তা শোনানো হয়।
এ ছাড়া কথোপকথনের সময় পাকসেনারা যেসব সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেছিলো সেগুলোও যথাসাধ্য অনুবাদ করে অপর এক ব্যক্তির মাধ্যমে পাঠান। মে মাসে আকাশবাণী কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় তা শোনানো হয়। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বাংলাদেশ অবজারভার-এ এই বার্তা ছাপা হয়েছিলো।
রেডিও খুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলাম। ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। হানাদার বাহিনীর দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা। ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমান্ডারের গলা। জানাচ্ছে, ‘দি বিগ ফিশ হ্যাজ বিন কট’।
কার কথা বলেছে, তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়েছেন। হঠাৎ কানে এলো আবার কন্ট্রোলের গলা ‘দেয়ার ইজ নো কোশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং অ্যাট ইউ, সো ওয়াইপ দেম অব’।
ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার এতোটুকু উত্তেজনা ছিলো না কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম, ওই গলা ছিলো ব্রিগেডিয়ার আরবাব খানের। ওই গলায় তিনি আনন্দে বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন। সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে, দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রাতেই ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে শহীদ মিনারের নিচের ঘরে। ওদের কথায় চার ছাত্র লুকিয়ে ছিলো, তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে। একজন পালিয়ে গেছে। … দেখলাম ভাঙা কাচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংস করেছিলো পাক বর্বররা। ২৫ মার্চের সেই কালোরাত যখন শেষ হয়ে আসছিলো, হুকুম এলো কন্ট্রোলের যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো ‘বাঙালিদের’। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিলো ওই কাজে, শেষে তাদেরও হত্যা করেছিলো ওই নরপশুরা। মৃতদেহের হিসাব রেখেছিলো ২৬ নং ইউনিট।
কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিলো, ২৬ নং ইউনিটকে রাজারবাগ পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল গোনা শেষ হয়নি। ২৬ মার্চ সারাদিন রেখে দেওয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমান্ডার গিয়ে দেখবেন, ছাত্রনেতা কেউ আছেন কি-না সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তা-ই হয়েছিলো। ২৭ মার্চ সকালে দেখেছিলাম ইকবাল হলের পেছনের পুকুরপাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখানোর জন্য ওখানে রাখা হয়েছিলো কিছু মৃতদেহ। যাতে বাঙালিরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলাম জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে দেওয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু-একজন বিদেশি সাংবাদিককে আসার অনুমতি দিয়েছিলো পাক সরকার, তখন এক রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্ট তুলে নিয়ে যায় পাকসেনারা।
বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেনের ধারণকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর ওই ওয়্যারলেস সংলাপের চাইতেও তাৎপর্যপূর্ণ জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি, আমার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছি শিরোনামে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ডে মুদ্রিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের তদানীন্তন অধ্যাপক ড. নূরুলউল্লার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি।
প্রফেসর নূরুলউল্লার ধারণকৃত জগন্নাথ হল গণহত্যার প্রামাণ্য তথ্যচিত্রটি স্বাধীনতার পর দেশে-বিদেশে বহুবার প্রদর্শিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বা ‘জেনোসাইড ঢাকা ইউনিভার্সিটি’র একমাত্র প্রামাণ্য দলিল, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার পরিচয় উদঘাটিত হয়।
এরপর দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম দুর্গ ইকবাল হল প্রবন্ধ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ উদ্ধৃত করছি, যা পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার প্রামাণ্য দলিল।
রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে লুটে নিয়ে গেছে, আর যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এর ফাঁকে ফাঁকে দু-একজন বেঁচে গেছে নানা কৌশলে। ২৬ মার্চ ভোরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ছে, সেখানেই দেখা গেছে লাশ আর লাশ। স্বদেশের সোনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ।
জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় তিনটি [২৩, ২৪ ও ২৫নং] আবাসনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিঁড়িতে, ছাদে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, আশ্রয়গ্রহণকারী বস্তিবাসী, প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরনো গণভবন) প্রহরারত নিরস্ত্রীকৃত ইপিআর জওয়ান, যারা ২৩ নং বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের হত্যা করে। শিক্ষকদের বাড়ি ঘরে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করবে, এমন ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত। তাই জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার শিক্ষকরা কেউ ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি।
নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। জহুরুল হক সংলগ্ন শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আর পুরনো রেল লাইনের ওপর গড়ে ওঠা বস্তি এলাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুণ্ঠন চালায় তা শুধু চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, চরম যুদ্ধাপরাধও বটে।
বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়। সেগুলো হলো: কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিব মন্দির আর রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটি পুরনো কালী মন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাক সেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড মোড়ের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিব মন্দির ও কালী মন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে।
জগন্নাথ হলের সাবেক প্রভোস্ট ড. অজয় রায় এবং ড. রঙ্গলাল সেনের উদ্যোগে ড. রতন লাল চক্রবর্তী সংকলিত-সম্পাদিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা : ১৯৭১ জগন্নাথ হল গ্রন্থে অপারেশন সার্চলাইটে জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিলো, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতি:
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় কী ঘটেছিল, তা একটু আলোচনা প্রয়োজন …. রাত বারোটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এরপর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কাণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিম দিকের টিনশেড অর্থাৎ পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পালিয়ে ছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমেই আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাসভবন। পাক বাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দ দেবকে এবং তার পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূদন দে’র [মধুদা] বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়াকে, যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন। শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবলচণ্ডী ও জনৈক রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের লাশের পাশের সজনে গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ৩ জন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চ শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সবার পরিচিত মধুদা [মধুসূদন দে] জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে- তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো উপাচার্যবিহীন। তখনকার উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি তিন বছরের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সপরিবারে জেনেভা যান। জেনেভার একটি পত্রিকায় ঢাকায় দু’জন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন:
তোমরা নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম৪।
১৯৭১ সালের ২৫ থেকে ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীলক্ষেত, ফুলার রোড, ঈশা খাঁ রোড, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, ঢাকা হল ও ফজলুল হক হল এলাকার আবাসিক এলাকাগুলো পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে ও জনমানবহীন বিরানভূমিতে পরিণত হয়। ১৯২১ সাল থেকে গড়ে ওঠা রমনার মনোরম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার বা রক্তাক্ত করেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ক্যাম্পাস থেকে সব মানুষকে উচ্ছেদ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আকাশে তখন শুধু চিল, শকুন আর মাটিতে মাংস-লোলুপ কুকুর আর বিহারি-রাজাকারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
এই আমি, পঁচিশে মার্চ, উনিশশো একাত্তর। এই আমার ইতিহাসের কথা, এই আমার রক্ত নেবার দিনের কথা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়; আরও আছে, আরও অনেক অনেক ইতিহাসের সপ্তসুরে ঠেকানো এই আমি পঁচিশে মার্চ। তোমরা তো আর আমায় খুঁজে বের করোনি কোনোদিন, তোমাদের ইন্টারনেটের বুকমার্কে থাকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের (যারা জাতিগতভাবে সেইসব বর্বর, হত্যাকারী, বাঙালি নারী-নির্যাতনকারী সেনাবাহিনীর রক্তে তৈরি) ফ্যান পেইজের ঠিকানা, তোমাদের চোখ পড়ে থাকে বেঈমান ও কুৎসিত চাঁন-তারা মার্কা পতাকার দিকে।
আমি পঁচিশে মার্চ, উনিশশো একাত্তর বলছি। বিগত চল্লিশ বছর আমি নিজেকে তুলে আনিনি তোমাদের সামনে, ভেবেছি তোমরাই খুঁজবে আমায়, কারণ আমি যে তোমাদের অস্তিত্ব। এখন দেখি- হায়! এ কার উপরে ভরসা করলাম, এ জাতি তো নিজের ইতিহাস কেবল ভোলেই না, অন্য কেউ যেনো সত্য জানতে না পারে, তাই বিকৃতও করে। আমি আর বিশ্বাস করতে পারলাম না তোমাদের, হে বাঙালি জাতি।
আমি পঁচিশে মার্চ, উনিশশো একাত্তর; আমি ফিরে এসেছি রক্তস্নাত জগন্নাথ হলের গণ-কবর থেকে, আমি উঠে এসেছি, শরীরে আমার লেগে আছে ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দীর্ঘশ্বাস, তাঁর স্বামীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি অসুরের বাহিনী, আমি জোয়ান বায়েজের সুরের মতো নিটোল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো তীক্ষ্ম।
এই আমি শেষবারের মতো বলছি তোমায় বাঙালি- ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কসম, তারামন বিবির ক্ষিপ্রতার কসম, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বর্ণমালার মতোন চোখের কসম- আমি পঁচিশে মার্চ, কেবল পঞ্জিকার একটি পাতা নই, আমি তোমার পরিচয় বাঙালি, আমি-ই তোমার ইতিহাস। আমি-ই তোমার শাশ্বত বঙ্গের নিটোল রূপকল্প। তুমি আমাতে ধ্যানস্থ হও, তুমি আমার ইতিহাস অন্বেষণ করো, অতীত খুঁড়ে খুঁজে ফেরো স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি।
আর যদি না পারো, তবে ফিরে যাও। ফিরে যাও, ফিরে যাও যেখানে খুশি। এমন বাঙালির জন্যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য রচিত হয়নি।
তথ্যসূত্র
১. পাকিস্তান অবজারভার; ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭০
২. পাকিস্তান টাইমস; ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭০ থেকে অনূদিত
৩. দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
৪. স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালী, আবদুল মতিন, রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন, লন্ডন, এপ্রিল, ১৯৮৯।