বনে আছে দ্বন্দ্বের বিন্যাস, নাগরিকতার সঙ্গে লৌকিক জীবনের। কোনো মানুষই ঠিক সে-অর্থে অখণ্ড নয়, প্রত্যেকের মধ্যেই আছে অপূর্ণতা। এ অপূর্ণতাকে প্রেক্ষণবিন্দুতে রেখেই শিল্পসৃষ্টি আর সেই সৃষ্টিকে ধারণ করা। বৃহৎ অর্থে শিল্পের এ বিশাল আকাশ জুড়ে থাকা রঙধনুর সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙটি হয়তো চিহ্নিত করা যাবে না, কিন্তু ভাবনার পরিসীমাটা যদি বাঙালি সমাজ আর বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসপট হয়, তবে চলচ্চিত্রের নামটি অনায়াসেই চলে আসতে পারে, যেখানে যুগ যুগ ধরে হাসি-কান্না-বেদনায় ঘেরা আমাদের আটপৌরে দৈনন্দিন জীবন প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সেলুলয়েডে। এ চলচ্চিত্র আমাদের প্রেরণা; বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। এরপর সময় বদলেছে, চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়ে গেছে।
যারা বলে থাকেন এ সময়টা আর সৃজনের নয়, বিনাশের হাতে বন্দি; এ প্রজন্ম এখন মাতৃভাষার আলোয় স্নাত হয় না- তাদের জন্য উদার আমন্ত্রণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। প্রতি বছরের মতো এবারো একুশের চেতনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজন করেছে আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪১৬ শীর্ষক সাতদিনব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসব। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ বিকেল ৫টায় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সম্মানিত সঞ্চালক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। যে ফাল্গুনে মায়ের ভাষার জন্য জীবন বাজি রেখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন বীর ভাষা সৈনিকেরা আর প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহিদরা, সেই ফাল্গুনেই মায়ের ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে অবিরাম পরিশ্রম করে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের কর্মীরা। এ যেনো নতুন এক আন্দোলন- ভাষা বিকৃতির বিরুদ্ধে, সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা খেঙড়ার নোংরামির বিরুদ্ধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবারের উৎসবে প্রদর্শন করছে বাঙলাদেশ ও ভারতের মোট ২৮টি চলচ্চিত্র। বাঙলাদেশের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে নয়নের আলো (পরিচালনা: বেলাল আহমেদ), দুই জীবন (পরিচালনা: আব্দুল্লাহ আল মামুন), পীচ ঢালা পথ (পরিচালনা: এহতেশাম), আলোর মিছিল (পরিচালনা: নারায়ণ ঘোষ মিতা), কাঁচের দেয়াল (পরিচালনা: জহির রায়হান) ইত্যাদি। এছাড়াও ভারত থেকে থাকছে আবার অরণ্যে (পরিচালনা: গৌতম ঘোষ), মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (পরিচালনা: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত), সব চরিত্র কাল্পনিক (ঋতুপর্ণ ঘোষ), চলো, Let’s Go (পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত), সপ্তপদী (পরিচালনা: অজয় কর), সুবর্ণরেখা (পরিচালনা: ঋত্বিক ঘটক) সহ আরো বেশ কয়েকটি পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র। প্রতিদিন চারটি সেশনে প্রদর্শিত হচ্ছে চলচ্চিত্রগুলো। সকাল ১০ টা, দুপুর ১ টা, বিকেল ৪ টা ও সন্ধ্যা ৬.৩০ এ সেশনগুলো শুরু হয়। প্রদর্শনী চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১০- বইমেলার শেষদিন পর্যন্ত।
আজকের নাগরিক সভ্যতায় আমরা যারা নিজেদের খুব মানবিক বলে মনে করি, এলিট বলে মনে করি, শহরে থাকার কারণে বেশ মেট্রোপলিটন হয়ে গেছি বলে মনে করি- তাদের কিন্তু ভেতরে ভেতরে এখনও রয়ে গেছে একটা গ্রামীণ মন। তুলসীমঞ্চে জল দেয়া, বৈশাখ মাসে জলের ঝারি তৈরি করা- অনেক প্রচ্ছন্ন গ্রামীণ সংস্কৃতি আমাদের নাগরিক জীবনেও রয়ে যায়। আমার ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর টিকেট ঘরটিও ঠিক যেনো সেই আবহেরই বহিঃপ্রকাশ। আর পোস্টারটি যেনো সেই চিরন্তন সুরকে বেঁধে রেখেছে আর্কেস্ট্রার মতো। সব্যসাচী হাজরার করা এ পোস্টারে অনন্য হয়ে ফুটে উঠেছে প্রদর্শনীর আত্মজ কথোপকথোন।
চলচ্চিত্রের মতো এমন বহুধাবিস্তৃত শিল্পের আপন অস্তিত্ব প্রকাশ পায় দুই সত্তায়। প্রথমটি শিল্পসত্তা, আর দ্বিতীয়টি বাণিজ্য তথা পণ্যসত্তা। আজকাল চলচ্চিত্রের পণ্যসত্তা এতোই প্রবল যে, একে এখন ‘বাণিজ্যশিল্প’ বলেও আখ্যায়িত করেন কেউ কেউ। এ দলে যারা আছেন তারা জেনে রাখুন, আমার ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করার জন্য প্রবেশমূল্য রাখা হয়েছে মাত্র পনেরো টাকা।