স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বাঙালি জাতির চেতনায় স্বাধীনতার যে বীজ উপ্ত হয়েছিলো তার মহীরুহ রূপান্তর ঘটে ১৯৭১ সালে, নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে, দেশকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হিংস্র কবল থেকে রক্ষা করার জন্য; সেদিন ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলেছিলো বাঙালি; অস্ত্র হাতে গেয়েছিলো শিকল ভাঙার গান। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দুর্জেয় মুক্তিযোদ্বা আর অমর বীরাঙ্গনারা অন্ধকারের বৃন্ত থেকে আমাদের জন্য ছিনিয়ে আনলেন আলোক-উজ্জ্বল স্বাধীনতা, রক্তের অক্ষরে রচনা করে গেলেন মুক্তির মহাকাব্য।
আমরা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। ৭১ কে তাই আমরা জেনেছি বিভিন্ন বইপত্র এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৩৫ বছর পর আমরা যখন স্বপ্ন আর প্রাপ্তির হিসেব মিলাতে যাই তখন হোঁচট খেতে হয়। যুদ্ধের মাত্র কয়েক বছর পরেই হত্যা করা হয় জাতির পিতাকে, কিন্তু আজও তার কোনো বিচার হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে আমাদের রাজনীতিতে আসে স্বৈরশাসক। ফলে অচিরেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন তার সমাধি রচনা করতে হয়।
মহান স্বাধীনতার অম্লান ইতিহাসও রক্ষা পায়নি অশুভ শক্তির কালো থাবা থেকে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ইতিহাসকে কেবল বিকৃত-ই করেনি, তাকে সত্য বলে চালানোর অপচেষ্টাও করছে। সৎ, নির্ভীক সাংবাদিকদের হত্যা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গ্রাস করার মাধ্যমে এ অশুভ শক্তি ধ্বংস করছে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সরকার তার ইচ্ছেমতো নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে মননশীল লেখক, চলচ্চিত্রকার আর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিকর্ম। কেবল নিষিদ্ধ করছে না স্বাধীনতা যুদ্ধের বিকৃত দলিল, ভুলে ভরা নিন্মমানের পাঠ্যপুস্তক আর মিথ্যাচারে লিপ্ত সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমটিকে। তাই আজ প্রশ্ন জাগে যাঁরা নতুন একটি গানের জন্য, কবিতার জন্য, একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার কি আমাদের নেই?
বুকের রক্ত দিয়ে একদিন যে দেশ স্বাধীন করেছিলো বীর বাঙালি; সেই বাঙলাদেশ আজ ভয়ের মেঘমালার নিচে, বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ধর্মের নামে সন্ত্রাস করছে একাত্তরের পরাজিত ঘাতক দালালরা। আমাদের দায়িত্বহীনতা তাদেরকে কেবল ক্ষমতাতেই আনেনি, আজ তারা এতোটাই শক্তিশালী যে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিকেও তারা হুমকি দেয়। সংগঠিত এ কালো চক্র ৭১-এ হত্যা করেছিলো দেশের বরেণ্য সন্তানদের, আজ আবার তারা সক্রিয় হয়েছে দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যার পরিকল্পনায়। মনুষ্যত্ব, শিল্প-সংস্কৃতি বিবর্জিত এ সকল ঘাতকেরা বাঙলার চিরায়ত ঐতিহ্য ধ্বংসের নীলনকশা এঁকে চলছে। এর বাস্তব প্রমাণ মেলে যাত্রা শিল্পে বর্তমান সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায়।
আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যাঁদের রয়েছে অসামান্য অবদান সেই অমর সন্তানরা আজ জীর্ণ জীবনযাপনে ক্লান্ত। দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য তাঁদের অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি। বীরাঙ্গনাদের অবদানের কথাতো অনেকে মনেই করতে চান না। মুক্তিযুদ্ধের নানা আলোচনাতেও উপেক্ষা করা হয় বীরাঙ্গনাদের অবদান। স্বাধীনতার ৩৫ বছরেও বীরাঙ্গনাদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মান করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বই এবং সাময়িকী পড়ে যখন আজকের বাঙলাদেশের দিকে তাকাই, তখন খুব কষ্ট হয়।
ঘুষ আর দুর্নীতির চক্রে এখন বন্দি বাঙলাদেশ। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, ভোটার তালিকা তৈরির নামে সরকার জনগণের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে; সরকারি তহবিলের অর্থ খরচ করে বিদেশ ভ্রমণ করে অথচ এদেশের শিক্ষক সমাজ-যাঁদের হাতে গড়ে ওঠে দেশের ভবিষ্যত-সে-ই শিক্ষকেরা নামমাত্র বেতনে যাপন করেন দুর্বিষহ জীবন। বেতন বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে অনশন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই যদি হয় একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র; তবে তার ভবিষ্যত নিয়ে কতোটা আশাবাদী হওয়া যায়?
তারপরও আমাদের ঘিরে ধরা ভয়ঙ্কর মেঘমালা থেকে এক চিলতে সাহসী রোদ উঁকি দেয়, আলোকিত করে আমাদের। গণিত অলিম্পিয়াডে বাঙলাদেশের কৃতিত্ব, ভাষা প্রতিযোগিতায় সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, যুক্তি আর সত্যের খোঁজে প্রাণবন্ত বিতর্ক আমাদের এখনো স্বপ্ন দেখায়। তাই নতুন একটি জাতি আত্মপ্রকাশের প্রসব বেদনার যে ইতিহাস তার ধারক ও বাহক হয়ে আজ আবার বলতে ইচ্ছে করে, “আমায় একটা ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস নে আর মা”।