প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব

প্রায় তিন বছর আগে আমার প্রিয় মানুষদের একজন শিল্পী-সংগ্রামী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের একটি লেখা পড়েছিলাম তাঁর মোবাইলের ড্রাফট-বক্স থেকে। ‘প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কথাটি তাঁর সেই লেখা থেকেই নেয়া। পরবর্তীতে লেখাটি কোনো সংকলনে বেরিয়েছে কিনা জানি না, তবে অনলাইনে দেশভাগ ও দ্বিজাতিতত্ত্ব: একটি আবশ্যিক পুনঃপাঠ শিরোনামে লেখাটি পাওয়া যায়। শুভ দা তাঁর লেখায় ভারতের একজন নাগরিক হিশেবে…

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: প্রকৃত মধ্যবিত্তের সন্ধানে

বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রায় ছিয়াশি বছর আগে ব্রিটিশ আমলাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণকে অপ্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নব-প্রতিষ্ঠিত সেই সংগঠনের তরুণ নেতৃত্বের উদ্দেশে ব্রিটিশ আমলা অ্যালেন অক্টেভিয়ান হিউম একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— “এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বুঝতে পারছে না…

বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার দশক

বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গত শতাব্দীর ষাটের দশক এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণের দশক। মূলত এই দশকের আলোতেই রচিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অলোকসামান্য ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সর্বকালের এক অখণ্ড অনুপ্রেরণা। বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের যে বীজ সাংস্কৃতিক ভূমিতে রোপিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে, তার রাজনৈতিক বিকাশ প্রাপ্তির সময় হিসেবে চিহ্নিত…

আমাদের শৈশবের পাহারাদার

অনেকের মতো আমিও জানি ফরিদুর রেজা সাগর একজন অসামান্য টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিশু সাহিত্যিক এবং দক্ষ সংগঠক। কিন্তু আমি বা আমার মতোন বুকপকেটে শৈশব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের দল যেটা জানে, সেটা অনেকেই জানেন না। ফরিদুর রেজা সাগর একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান। মধ্যবিত্ত স্কুলব্যাগ কাঁধে, মর্নিং শিফটের আধঘুমের ক্লাশে আমরা কতোবার তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গেছি। এজন্য…

বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার লড়াই

মানবসভ্যতার ইতিহাসে পড়েছি— লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, প্রস্তর যুগ, নব্যপ্রস্তর যুগ— গোটা পৃথিবীতে এখন চলছে বিপন্নতার যুগ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ…সব, সবটাই যেন বিপন্নতার কালো স্কার্ফে মুড়িয়ে দিয়েছে কোনো এক অন্ধ জাদুকর। সে নিজে অন্ধকার দেখতে পায় না বলে স্বীকার করে না আলোর অস্তিত্ব। ফলে বিপন্নতার রাত্রি ক্রমাগত গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বিপন্নতার এই…

অনার্য সংগীতগুরুদের প্রতি নিবেদন

আমার জন্ম আজিমপুর ম্যাটার্নিটিতে সুতরাং মৃত্যু যে ভেনিসে হবে না তা বলাই বাহুল্য। এক টুকরো নির্দোষ শৈশবের সুতোয় জীবনের ঘুড়ি আটকে রেখে জীবন পার করার এই বোকামি তাই আমাকে অন্তত মানায়। আমার বা বড়ো করে বললে আমাদের যখন শৈশব তখনও শহরের আকাশ জুড়ে সুউচ্চ দালানের মিছিলগুলো অতো বড়ো ছিলো না। টুকটাক দু একটা চোখে পড়তো;…

বৃষ্টি নামে যখন, আমরা সত্যিই তখন একা

প্রিয় বর্ষা, এই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটি বদলে দিয়ে তোমাকে লেখা চিঠির শিরোনাম বানালাম—এও কোনো এক দাক্ষিণ্যের জোরে। শহরের উঁচু তলার ঘরগুলোতে আজকাল থাকার জায়গার বড্ডো অভাব। হাজার স্কয়ার ফিটে মানুষ আর আসবাবপত্রের পর তেমন আর কিছু জোটানো যায় না। ফলে কাগজওয়ালার কদর বাড়ে। আমরা যেখানে থাকি, তার ঠিকানা তোমার এড্রেস বুকে নেই। আমাদের…

হতে পারে এটিও একটি বিতার্কিক পাঠ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্কের মহাবাদলের সামনে কী তপোক্লিষ্টই না দাঁড়িয়ে থেকেছি আমি। বিতর্ক তখন আমার কাছে এক মুনস্ট্রাক অরণ্য—তাকে দেয়া যায় না কিছুই, কেবল নিয়ে আসা যায় ঢের। আমার বলশেভিক চোখে বিতর্কের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হবার পর আমি জেনে গেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী কিছু সব্বনেশে খশড়া জমা হয়েছে মানব জাতির ভল্টে। অতএব বিতর্ক থেকে বেরোনোর প্রশ্নই…

‘বইয়ের’ বই কই?

ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক— বইয়ের সঙ্গে কিন্তু আমাদের জীবনের অনেকখানি সময় কাটে। কেউ বই পড়তে ভালোবাসেন, কেউ বই বেঁচতে ভালোবাসেন। আজকাল অবশ্য একটি সৌখিন শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা বই সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। বিষয়টি চমকপ্রদ। বই আমাদের চিন্তার সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ঘরেরও সৌন্দর্য বর্ধন করছে। উপযোগিতা বাড়ছে। এটাও তো একটি প্রাপ্তি। স্কুলে পড়ার সময়…

প্রদর্শনী নয়, আমি একটি বিদ্রোহ দেখেছিলাম

এক আশ্চর্য অগ্রহায়নের সন্ধ্যা তার সবটুকু বিষণ্নতাকে ছুটি দিয়ে একান্তই আমাদের হয়ে গিয়েছিলো। নগরীর জ্যাম ঠেলে গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে এসে আমরা দেখলাম জীবনের গায়ে রৌদ্র মাখাতে গেলে কার্যত পেরিয়ে আসতেই হয় স্যাঁতস্যাঁতে উঠোন এবং পুনর্বার তার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু কথাটা যতো সরল তার বাস্তবায়নের ইশতেহার ততোটা কঠিন। কেননা শেষ পর্যন্ত জীবনের সংজ্ঞা, বলা ভালো…

বইমেলা খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন

অমর একুশে বইমেলা বাঙালির এক অলৌকিক পবিত্র আয়োজন। একুশের সূর্যমুখী চেতনাকে ধারণ করে বইমেলা আমাদের মাথা নত না করার এক দৃপ্ত প্রত্যয়। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা উদ্বেল হই বইমেলার তরঙ্গে, আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন বইয়ের প্রতীক্ষা। সারা বছর এই একটি মেলার জন্য কেবল লেখক-প্রকাশকরাই নন; আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন সারাদেশের নানা প্রান্তের মানুষ। গণমাধ্যম…

আড্ডার বই চাই

গতকাল ছিলো বুদ্ধদেব বসুর জন্মবার্ষিকী। এই প্রসঙ্গেই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোনে হলো— বাঙালির কোনো আড্ডা নেই। ছোটোবেলা আমাদের কাছে আড্ডা মানে ছিলো যাচ্ছেতাই ব্যাপার। একেবারে উচ্ছন্নে না গেলে কেউ আড্ডাবাজিতে নাম লেখায় না। খানিক বড়ো হয়ে বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন পড়ে দেখলাম, নাহ— ব্যাপারটা মোটেই খারাপ না যেহেতু ইংরেজি বিভাগের ডাকসাঁইটে ছাত্রও নিয়মিত…

বাঙলা নববর্ষ: ব্রাত্যজনের ভাবনা

নববর্ষ এলেই আমার মধ্যে এক প্রগাঢ় ভাবনার উদয় হয়। আমি ভাবতে শুরু করি- বাঙালির নববর্ষ আসলে বাঙালির চৌকাঠে কতোটা আপন হয়ে আসে। মানে, কতোটা তা উৎসবের, কতোটা তা উদযাপনের, আর কতোটাই বা তার চর্চার। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি যেটুকু বুঝি, তাতে সংস্কৃতি আমার কাছে একটি বড়ো ধারণা। একই সঙ্গে তার মধ্যে যে গভীর বাঙময়ী প্রত্যয়…

এই লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে না

কারও ভালো লাগার দায় থেকে লেখাটি লিখছি না। ভালো যে লাগবে না, তা তো শিরোনামেই আমি উল্লেখ করেছি। বাঙলা নববর্ষ নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মনে হয়, আমাদের নববর্ষ উদযাপনের ধারটি বদলে যেতে পারতো। বাঙালির ইতিহাস কেবল উদযাপনের নয়, বাঙালির ইতিহাস এক গভীর দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস। বাঙালির সবটুকু মহিমান্বিত ধারায় এক অভূতপূর্ব চিন্তারেখা খেলা করে। সেই…

ইতিহাসের আলো আর দায়িত্বহীনতার অন্ধকার

প্রকৃতিতে তখন শরতের ছোঁয়া, চারিদিকে কাশবনের অবাধ্যতা। আমরা চারজন হেঁটে চলছি; গন্তব্য কান্তনগর মন্দির। স্থানীয় লোকজন অবশ্য একে কান্তজির মন্দির নামেই চেনেন। ইটের তৈরি অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দিরের সামনে এস অবশেষে আমরা দাঁড়ালাম। দূরত্ব হিসেবে দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেতুলিয় সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর অপর পাড়ে নিভৃত গ্রামে এ…