স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: প্রকৃত মধ্যবিত্তের সন্ধানে

বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রায় ছিয়াশি বছর আগে ব্রিটিশ আমলাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণকে অপ্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নব-প্রতিষ্ঠিত সেই সংগঠনের তরুণ নেতৃত্বের উদ্দেশে ব্রিটিশ আমলা অ্যালেন অক্টেভিয়ান হিউম একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— “এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বুঝতে পারছে না…

মদন তাঁতির মুদ্রাদোষ

খ্রিস্টের রক্ত তখনও করবী ফুলের মতো লাল হয়ে জ্বলে ওঠেনি। মৃত্যু তার ঊরু বিস্তার করেছে লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, কোলকাতা অথবা ঢাকায়। কবিতার কয়েকটি পঙক্তিতে লোরকা নিজের ভবিতব্য দেখতে পেলেন স্পেনে— তখন ১৯৪২ সাল; রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রস্থানের পথে পথে পড়ে আছে সাহিত্যের নৈশবিজ্ঞপ্তি, ইতিহাস প্রবেশ করছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর নিদারুণ মন্তাজে। আর কিছুদিন বাদেই ইউরোপের ভূগোল থেকে মুছে…

বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার দশক

বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গত শতাব্দীর ষাটের দশক এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণের দশক। মূলত এই দশকের আলোতেই রচিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অলোকসামান্য ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সর্বকালের এক অখণ্ড অনুপ্রেরণা। বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের যে বীজ সাংস্কৃতিক ভূমিতে রোপিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে, তার রাজনৈতিক বিকাশ প্রাপ্তির সময় হিসেবে চিহ্নিত…

জীবনাধিক জীবন

ছবিটির দিকে তাকাই এবং আবিষ্কার করি দেবব্রত বিশ্বাসকে। শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্নেহাংশু আচার্য, কনক বিশ্বাস ও অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর এই বসে থাকার ভঙ্গিমাই আমাদের কাছে মেলে ধরে দেবব্রত বিশ্বাসের যাবতীয় ইশতেহার। এই ইশতেহার কারিগরের নয়; বরং দ্রষ্টার বিশৃঙ্খলা ও কিমিতি, মৃত্যু ও শূন্যতা, পাপ ও প্রজ্ঞান একই সুরে নিবেদিত হয়েছে অসীমের…

গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল

চরাচরে অন্ধকার নেমে আসে— সুরের অন্ধকার। আমাদের যাবতীয় উপলব্ধি বলে— সুরের চারপাশ জুড়ে আলো, কেবলই আলো। গানের ঝর্ণাতলায় কেবলই প্রশান্তি, ‘তোমায় গান শোনাবো…’ বললে মনে হয়— এ যেনো বহু দূরের ওপার থেকে আসা এক মায়া, তাতে মিশে থাকে প্রেম-শান্তি আর প্রেরণা। কিন্তু আমাদের এই উপলব্ধি ভেঙে যায়, চরাচরে নেমে আসে সুরের অন্ধকার। আমরা বুঝে ফেলি…

বৃষ্টি নামে যখন, আমরা সত্যিই তখন একা

প্রিয় বর্ষা, এই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটি বদলে দিয়ে তোমাকে লেখা চিঠির শিরোনাম বানালাম—এও কোনো এক দাক্ষিণ্যের জোরে। শহরের উঁচু তলার ঘরগুলোতে আজকাল থাকার জায়গার বড্ডো অভাব। হাজার স্কয়ার ফিটে মানুষ আর আসবাবপত্রের পর তেমন আর কিছু জোটানো যায় না। ফলে কাগজওয়ালার কদর বাড়ে। আমরা যেখানে থাকি, তার ঠিকানা তোমার এড্রেস বুকে নেই। আমাদের…

বাঙলা নববর্ষ: ব্রাত্যজনের ভাবনা

নববর্ষ এলেই আমার মধ্যে এক প্রগাঢ় ভাবনার উদয় হয়। আমি ভাবতে শুরু করি- বাঙালির নববর্ষ আসলে বাঙালির চৌকাঠে কতোটা আপন হয়ে আসে। মানে, কতোটা তা উৎসবের, কতোটা তা উদযাপনের, আর কতোটাই বা তার চর্চার। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি যেটুকু বুঝি, তাতে সংস্কৃতি আমার কাছে একটি বড়ো ধারণা। একই সঙ্গে তার মধ্যে যে গভীর বাঙময়ী প্রত্যয়…

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ও বিষণ্নতা ভাবনা

একটি দীর্ণ সত্তার সাথে রঙিন প্রজাপতির মিহিন কথোপকথন- কখনো মৃদু, কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো বা কোনো এক প্রান্ত ছোঁয়া নদীর মতো একেবারে শান্ত কিন্তু চলিষ্ণু হয়ে চলছে সে। কিন্তু কোথায়? কোনখানে? প্রশ্নগুলো একবারের নয়, বহুবারের- বহুধারার। এই অনন্যবোধের বাতি জ্বালিয়েই জীবন পাড়ি দেয় অনন্তলোকে, কোনো ঠিকানার পানে নয়, নয় কোনো ঐশ্বরিক শক্তি বা অন্য কোনো…

ডেভিড ম্যাকাচ্চন: আমার একাত্তরের সুহৃদ

কিছুদিন ধরে একজন মানুষ আমায় খুব ভাবিয়ে তুলেছেন। আমার চিন্তার ফ্রেমে বারবার একটি প্রশ্ন রেখে গেছেন— ‘আমি কী বলি নাই?’ তিনি বলেছিলেন, বহুদূরের কণ্ঠস্বরের ক্ষীণ সুরের পালে হাওয়া লাগিয়ে তিনি সত্যিই বলেছিলেন; বলেছিলেন— আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তান থাকবে না— এর ভেতরে একটি নূতন রাষ্ট্র নবজাতকের মতো চিত্কারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে কিন্তু এইটুকু…

রবীন্দ্র-উপন্যাসের যাত্রা: বউ ঠাকুরানীর হাট

রবীন্দ্রনাথ কে? এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হলে রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে, তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিসত্তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। এটা এই জন্য যে- রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বিকশিত করেছেন ক্রমে ক্রমে, কুসুমের মতো; তিনি ধীর লয়ে অবগাহনের সঙ্গীত হয়ে উঠেছেন এবং ক্রমান্বয়ে সুরের ধারায় সৃষ্টি করেছেন নবতর তরঙ্গ। তাই, রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বাঙালি, যাঁকে খুঁজে পড়তে হয় এবং পড়তে…

এই লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে না

কারও ভালো লাগার দায় থেকে লেখাটি লিখছি না। ভালো যে লাগবে না, তা তো শিরোনামেই আমি উল্লেখ করেছি। বাঙলা নববর্ষ নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মনে হয়, আমাদের নববর্ষ উদযাপনের ধারটি বদলে যেতে পারতো। বাঙালির ইতিহাস কেবল উদযাপনের নয়, বাঙালির ইতিহাস এক গভীর দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস। বাঙালির সবটুকু মহিমান্বিত ধারায় এক অভূতপূর্ব চিন্তারেখা খেলা করে। সেই…

মেসিময় দিনটি ছিল ওকাম্পোর কবিতার মতোই

এমনটাই যেনো হবার কথা ছিলো! হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ আর্জেন্টিনা থেকে আসবেন মেসি। বাঙালি তাঁকে বরণ করে নেবে তার হাজার বছরের ঐতিহ্যগত আতিথেয়তায়। মেসি তাঁর অনবদ্য জাদুতে মুগ্ধ করবেন বাঙালিকে, সেইসাথে মুগ্ধ হবেন বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা আর মেসির জন্যে তুলে রাখা ভালোবাসার আবির মেখে। মেসি কিংবা আজকের আর্জেন্টিনা বাঙালির এই অসামান্য আয়োজনে যারপরনাই মোহিত।…

আমার রবীন্দ্রনাথ: বিজ্ঞাপনের চোখে দেখা

রবীন্দ্রনাথ আমার পরম আগ্রহের বিষয়। তিনি বিশ্বকবি কিংবা নোবেল বিজয়ী বাঙালি সাহিত্যিক এইজন্য নয়; তিনি আমার আগ্রহের প্রেক্ষণে থাকেন, কারণ তিনি খুব নীরবে বাঙালির অন্তরাত্মার ছবিটি দেখেছিলেন। উন্মোচন করেছিলেন বাঙলা কবিতাকে এবং উন্মোচিতো হয়েছিলেন নিজেও। তিনি আমার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকেন, কারণ তিনি নির্দ্বিধায় সাড়া দিতে জানতেন থরোথরো সৌন্দর্যের ডাকে। কবিরাই একমাত্র সংক্রামকের মতো সাড়া দিতে…

তিনি অর্থবহ: আমার অন্তর্লোকে, আমার কাব্য-পানশালায়

খুব দূর থেকে নন, কাছেই, আবার একেবারে কাছেও নন- যতোটা দূরত্ব থাকলে ‘দূর’টাকে মনে হয় প্রিয় ব্যালকনি আবার ‘কাছে’র অর্থ ধরা পড়ে চেনা অভিধানের চৌকাঠ পেরিয়ে, তিনি ততোটা দূরত্বে থেকেই এক মনে পাশা খেলে যান আমার মধ্যবিত্ত নাগরিক যৌবনের অগোছালো হৃদয় ঘরে; কখনো কবিতার স্নিগ্ধতায় তাঁর অতলস্পর্শী শব্দমাল্য আমাকে আহ্লাদে জড়ায় উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর কাতরতায়, কখনো…