প্রশ্নটি হচ্ছে— ধর্ম কার জন্য? একজন ব্যক্তির ধর্ম কী হবে, তা অনেকটাই জন্মসূত্রে কোনো দেশের নাগরিক হবার মতোন। যে ধর্মাবলম্বী পরিবারে যার জন্ম সাধারণত তিনি সে ধর্মেরই অনুসারী হয়ে থাকেন। আবার ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে একেক পরিবার একেক ধরনের নীতি পালন করে। পরিবার থেকে শেখা সে প্রভাব ব্যক্তির ওপরও পড়ে। ফলে বোঝা যাচ্ছে ধর্ম সংক্রান্ত আমাদের প্রায় সকল আচার-বিশ্বাস-প্রথাই অনেকটা পরিবারের সদস্য হিসেবে আত্তীকরণের মতো। বরং সংকট বা সংশয় যাই বলি, সেটা দেখা দেয় জ্ঞান হবার পর— যখন মানুষ প্রশ্ন করতে শেখেন, বিবেচনা বা বোধ দিয়ে যুক্তির আলোকে একটি বিধান (সেটা ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক যা-ই হোক না কেনো) সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখেন। ছোটোবেলায় পড়েছি ‘ধর্ম’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকে— অর্থ ধারণ করা। যে বৈশিষ্ট্য ধৃত হয়, তা-ই ধর্ম। কেবল মানবজাতির ধর্ম নয় আমরা মহাবিশ্বের নানা সৃষ্টির ধর্ম নিয়েও আলোচনা করি। অতি-পারমানবিক কণার অন্যতম ধর্ম হচ্ছে ঘূর্ণন। কিন্তু আমার মনে হয় মহাবিশ্বের অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক যতোটা বৈজ্ঞানিকভাবে বিকশিত হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ মানুষ ধর্মকে কেবল তার ধৃত বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখেনি, দেখেছে তার আত্মপরিচয়ের মূলবিন্দু হিসেবে। ফলে তার মনুষ্যত্বের পরিচয়টি ক্রমেই ফিকে হয়ে এসেছে, সেখানে স্থান করে নিয়েছে তার ধর্মগত পরিচয়। মানুষ যেদিন থেকে ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইলো— সম্ভবত সংকটের শুরুটাও সেদিন থেকেই দৃশ্যমান হলো। মানুষের ধর্ম হয়ে গেলো ‘আমার ধর্ম’, মানুষের পৃথিবী হয়ে গেলো ‘আমাদের’ বা ‘ওদের’ পৃথিবী। জগতে এই ‘আমরা’ ‘ওরার’ পার্থক্য এতটাই প্রকট হয়ে উঠলো যে, স্বয়ং কার্ল মার্কস হ্যাভ আর হ্যাভ নটের কথা বলেও মানুষের সুমতি ফেরাতে পারলেন না। ফলে ক্রমেই পৃথিবীতে মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্বকে পাশ কাটিয়ে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটতে লাগলো। ‘আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ’— সম্ভবত এটাই পৃথিবীর সামগ্রিক বৈষম্যের আদি কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মের সঙ্গে স্রষ্টার সম্পর্ক কী? আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু বুঝি ধর্মের সঙ্গে স্রষ্টার কোনো সম্পর্ক নেই; স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তার সৃষ্টির। সৃষ্টি যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকারও করে— তবুও স্রষ্টা-সৃষ্টির সম্পর্কে কোনো রকমফের ঘটে না। ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে স্রষ্টাকে পাওয়া যায়— এ কথা আমি অন্তত যৌক্তিক মনে করি না। তবুও গোটা পৃথিবী আজ ধর্মের নামে বিভক্ত, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন। ধর্মের নামে যুদ্ধ চলে, যুদ্ধের প্রয়োজনে অস্ত্র বিক্রি হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে মানুষ মরে— ধর্ম তার কোনো প্রতিবিধান করতে পারে না। এসব নানা কারণেই আমার মনে হয়, ধর্মের সঙ্গে মানুষের অভিযোজিত হবার বিবর্তন প্রক্রিয়াটি বৈজ্ঞানিক নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক যে কোনো কিছুর একটি স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকে, কিন্তু অবৈজ্ঞানিক প্রায় সব কিছুর মধ্যেই থাকে পারস্পরিক সাদৃশ্য। এ কারণেই প্রায় সব ধর্মেই চিকিৎসার নামে কিছু অবৈজ্ঞানিক প্রথা চালু আছে। কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবার পর এর বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল ধর্মের ধ্বজাধারীরাই বক্তব্য দিয়েছে— সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর খ্রিস্টানই হোক, আর বাংলার কাঠমোল্লাই হোক।
বাংলায় ধর্মের, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিকাশ নিয়ে কতোখানি চর্চা হয়েছে আমার সঠিক জানা নেই। কিন্তু নদীবিধৌত এই অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল নদীর সূত্রে, ক্ষুধার সূত্রে, শাসক শ্রেণির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সূত্রে— সর্বোপরি বাঙলার মানুষ হিসেবে তাঁর আত্মপরিচয়ের সূত্রে। সে পরিচয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ওরাং বা বাঙালি মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল তার শ্রেণি। জমিতে সে ফসল ফলায় কিন্তু ফসলের হিস্যা যায় জমিদারের ঘরে। পদ্মা নদীর মাঝি কুবের নদীতে মাছ ধরে কিন্তু কুবেরেরই ধরা মাছ বিক্রির পয়সায় ময়নামতি দ্বীপের স্বপ্ন দেখে হোসেন মিয়া। অথচ কুবেরের ঘরের অন্ধকার দূর হয় না। এই শোষক আর শোষিত শ্রেণির যে সমস্যা, তার প্রকৃত সমাধান কিন্তু ধর্ম করতে পারে না। ধর্ম একটি সমাধান দেয় বটে কিন্তু আজ পর্যন্ত তার ফসল কোনোদিন শোষিতের গোলায় ওঠেনি; বরং ধর্মকে ব্যবহার করে বারবার শোষকের হাতই শক্তিশালী হয়েছে।
ধর্মের এই একমাত্রিক ব্যবহারটিকে প্রেক্ষণে রেখে বাংলায়, বিশেষত এক সময়ের পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিকাশ দেখার একটি সুযোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে ‘ভালো পড়াশুনা’ বা ‘ভালো চাকুরির’ সূত্রে— অর্থাৎ এক কথায় তার অর্থনৈতিক স্তর তাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিসেবে গড়ে তুলেছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডি রোজারিও থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র— উনিশ শতকের শেষাংশ থেকে গোটা বিশ শতক এই ধারায় পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনের প্রক্রিয়াটিও অনেকটা এরকম। অর্থাৎ আগে একজন মানুষকে শিক্ষা-চাকুরি-অর্থ ইত্যাদির বিনিময়ে সমাজের ওপরতলায় উঠতে হয়েছে, তারপর তিনি রাজনীতি সচেতন হয়েছেন। এক কথায় বললে— বাঙালি আগে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত হয়েছেন, তারপর বিদেশি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক বোধ তৈরি হয়েছে। এখন এই পরোক্ষভাবে প্রোথিত রাজনৈতিক বোধ কিছুটা সংশয়পূর্ণ বলেই আমার ধারণা। এই ধারণা আমি ইতিহাস পাঠ থেকেই লাভ করেছি। কারণ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হবার পর যে বাঙালি মধ্যবিত্ত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে তা রদ করতে বাধ্য করলো ১৯১১ সালে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই কিন্তু তিন দশক পরে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নিলো— কেবল মেনেই নিলো না, এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এই মর্মন্তুদ দেশভাগকে অনিবার্য করে তুললো। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে নবগঠিত পাকিস্তান যখন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অন্যায় হস্তক্ষেপ শুরু করলো, তখন এই মধ্যবিত্তের টনক নড়লো। কারণ উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তো তার চাকুরিতে সমস্যা হবে, সে তো উর্দু ভাষা জানে না। বিপদ আরও খাড়া হলো যখন স্বয় মুসলিম লীগের নেতারাই উর্দুর পক্ষে জবরদস্তি ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করলো।
ঠিক এ জায়গাটিতে দাঁড়ালে বাংলার ধর্মভিত্তিক মানচিত্রের একটি সম-সাময়িক চিত্র পাওয়া যায়। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে যতো মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কলম ধরেছিলেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু পাকিস্তান হবার পর একবারও ভাবলেন না ভারতে বসবাসরত মুসলিমদের কী হবে। একই কথা হিন্দু নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শ্যামাপ্রসাদ ‘হিন্দু রাষ্ট্র ভারত’ বানাতে চাইলেন, কিন্তু পূর্ববঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কী হবে— তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। বাঙালি মুসলিম ‘লড়কে লেয়েঙ্গা পাকিস্তান’ স্লোগান তুলে উদ্ভট পাকিস্তান বানালেন বটে, কিন্তু তার নেতৃত্বে রইলো অবাঙালি মুসলিমরা। ফলে কপালের ফের আর কাটলো না।
ফলে আমার মতে, বাঙলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে আমাদের গবেষকগণ যে শিক্ষিত শ্রেণিটিকে চিহ্নিত করেছেন— প্রকৃত প্রস্তাবে সেটি আসলে অন্তবর্তী শ্রেণি, যার মূল বৈশিষ্ট্য সনদনির্ভর শিক্ষা, অর্থাৎ চাকুরি বা ব্যাবসা বা পৈতৃক সম্পত্তি, অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। এই অন্তবর্তী শ্রেণি তরল পদার্থের মতো— যে পাত্রে রাখা হয়, সে পাত্রের আকারই ধারণ করে। সে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনও করেছে, ভাষা আন্দোলনও করেছে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য মুক্তিসংগ্রামও করেছে, বাহাত্তরের সংবিধানকে স্বাগত জানিয়েছে আবার পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ যখন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু হলো, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলো— তখন সে স্রোতের সঙ্গেও মিশে গেছে। এ কারণেই কী অখণ্ড ভারত, কী পাকিস্তান, কী স্বাধীন বাংলাদেশ— কোনো সময়েই মৌলবাদী অপগোষ্ঠী এই শ্রেণিকে নিয়ে বিব্রত ছিল না। কারণ তারা জানতো এই ছদ্ম-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আদর্শের চেয়ে নিজেদের অস্তিত্বকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
কিন্তু বাংলার প্রকৃত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যাঁরা, তাঁরাই আদর্শের প্রশ্নে আপোসহীন থেকে গেছেন— নির্মাণ করেছেন নিজেদের ভাষ্য এবং এটাই শাশ্বত বাংলার মূল বুদ্ধিবৃত্তিক মানচিত্র। এই শ্রেণি তৈরি হয়েছে পূর্ববঙ্গের কৃষক আন্দোলন থেকে। তার কাছে অধিকারের রাজনৈতিক বাস্তবায়ন জরুরি এবং এই জরুরি কাজটি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন একতা। ফলে তার যূথবদ্ধতায় শ্রেণি আছে, ধর্ম নেই; ক্ষমতায় অংশগ্রহণ আছে কিন্তু ক্ষমতা দখল নেই। কারণ তাঁরা তো শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হননি, সংঘটিত হয়েছিলেন নিজস্ব শ্রেণির (অর্থাৎ শোষিতের) রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের জন্য। এ কারণেই ধর্মকে সে ব্যক্তিগত চৌহদ্দির বাইরে বের হতে দেয়নি। বাংলার এই শ্রেণিটিকে প্রকৃত অর্থে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কারণেই গত শতাব্দীর উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বলতে পেরেছিলেন— “আমি শোষিতের গণতন্ত্র চাই। আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই”। ভারতের প্রশ্নে পণ্ডিত নেহেরু গণতন্ত্র চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটি কার গণতন্ত্র সেটা তিনি পরিস্কার করেননি।
বাংলার এই প্রকৃত মধ্যবিত্ত শ্রেণি শিক্ষিত, কিন্তু সেটি কাগুজে শিক্ষা নয়। তার শিখন প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক। এ কারণেই ধর্মের বিকাশ এই বাংলায় মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডাভিত্তিক নয়— নদীভিত্তিক, আখড়াভিত্তিক, খানিকটা স্মৃতিচিহ্নভিত্তিকও। বাংলার বাউল, ফকির, সন্ন্যাসী ও সূফী সাধকগণের জীবনী থেকে দেখা যায়— কোনো একটি জায়গায় তাঁরা থিতু হননি। তাঁরা হেঁটে বেড়িয়েছেন, পরিভ্রমণ করেছেন, মানুষের সাথে মিশেছেন এবং সেখান থেকেই তাঁদের দর্শনাশ্রিত বাণীর বিকাশ ঘটেছে। তাঁরা শাস্ত্র আঁঁকড়ে পড়ে থাকেননি, বরং স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝখানে শাস্ত্রের বাঁধনকে তাঁরা মুক্ত করেছেন। অধ্যাপক আহমদ শরীফ লিখেছিলেন— “শাস্ত্র ছাড়ো, ধরতে হলে স্রষ্টা ধরো”। একজন নিরীশ্বরবাদী মানুষ কেনো এমন কথা বললেন, সেটা খুঁজতে গেলে বোঝা যায়— গোটা পৃথিবীতে ধর্মকে প্রতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটিই শাস্ত্রের। লালনের আখড়া থেকে শাহজালাল বা শাহপরানের মাজার— কোথাও শাস্ত্রের তালা পড়েনি। কিন্তু মসজিদে শাস্ত্রের তালা আছে, মন্দিরে শাস্ত্রের খিল দেয়া। মসজিদ কি মন্দিরে ঢুকতে হলে মানুষকে মুসলমান কি হিন্দু হতে হবে— মানুষ পরিচয় সেখানে যথেষ্ট নয়। কিন্তু বিজয় সরকার থেকে শাহ আবদুল করিম কিংবা রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে আবু আলী আক্তার উদ্দিন শাহ— তাঁদের ভুবনে কোনো দুয়ার নেই, কেবলই আকাশ, মানুষের আকাশ। সে আকাশের তলে আমরা মানুষ হয়েই দাঁড়াতে পারি। সে মানুষ ভালো কী মন্দ, আস্তিক কী নাস্তিক, আলেম কী মূর্খ— সেটি বিবেচ্য নয়। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসামান্য শক্তি! এবং এই শক্তি নিষ্ক্রিয় থাকেনি কখনোই। বাংলার কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায়— প্রতিটি ক্ষেত্রে বাউল-ফকির-সাধক-সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ছিল। বাংলার মুক্তিসংগ্রামের কথাই যদি ধরি— নগরকেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন ছিল, বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিল মুক্তিসংগ্রাম। কিন্তু শাহ আবদুল করিম যখন বলেন— “বাংলার নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান…”— তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে আমাদের শব্দগত ভুলটি আবিষ্কার করি। মুক্তিসংগ্রাম কেবল বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য ছিল না, ছিল বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। সাতই মার্চের অমর ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন— সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না…”— এই সাতকোটির মধ্যে তো বাঙালি, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, চাকমা সকলেই ছিলেন। এই সকলের একটি মাত্র পরিচয় ছিল— তাঁরা শোষিত। এই শোষণ ছিল মুখ্যত অর্থনৈতিক, মূলত রাজনৈতিক এবং এই শোষণ জারি রাখা হয়েছিল ধর্মের নামে, জাতের নামে, বর্ণের নামে।
এই নাতিদীর্ঘ আলোচনাটি আমি করেছি, এটুকু বোঝার জন্য যে— ধর্ম আসলে কার? শোষিত কৃষকের নাকি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ওই কাঠমোল্লাদের। ধর্ম কার— সত্তর বছর ধরে ধর্মেরই নামে উদ্বাস্তু হওয়া জনগোষ্ঠীর নাকি ওইসব স্খলিত রাজনীতিবিদদের, যারা ‘ইনশাল্লাহ, মাশাল্লাহ’ আওড়ে নিজেদের পাপ ঢাকেন। এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি প্রশ্নও চলে আসে— বাংলার মুসলমান কবে থেকে নিজেদের ধর্মকে মসজিদের ইমামের কাছে বর্গা দিলো? কেনোই বা দিলো? এগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই লালনের আজব কারখানা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
জিয়াউর রহমানের মতো খুনি, অবৈধ সামরিক শাসক নিজের পাপ ঢাকতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সংবিধানে অনুমোদন দেয়, সকল রাজনৈতিক পাপকে বৈধ করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ যোগের মাধ্যমে। আপাদমস্তক ইতর এরশাদ তার ছাত্র হত্যা, অপশাসন আর দুর্নীতি ঢাকতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। আর আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও সাংবাদিকগণ ‘মৃদু প্রতিবাদ সারিয়া সকল কিছু মানিয়া লইলাম’ জাতীয় বুলি আওড়ান। এই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামওয়ালাদের দেশে ব্যাংকের টাকা লুট হয়, দুর্নীতিবাজ ধরা পড়লে দেখা যায় তার দাড়ি-টুপি-আলখাল্লাসহ একাধিকবার হজ্ব পালনের সনদও আছে, যখনই কোনো রাজনীতিবিদের সম্পত্তির হিসাব তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন, তখনই মসজিদ মাদ্রাসায় তার টাকা দেবার হিড়িক পড়ে যায়। এই কদিন আগেও এক শীর্ষ ব্যবসায়ি যখন ধর্ষণ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় ফেঁসে গেল, অমনি তার নিয়ন্ত্রণাধীন পত্রিকাগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হতে লাগলো— কতগুলো মসজিদ মাদ্রাসায় সে অনুদান দেয়, রোজার মাসে ইফতার দেয়। সারাজীবন অন্যের জমির আইল কেটে বাঁকা পথে জমি দখলকারী ব্যক্তিও মসজিদে গিয়ে বলে— কাতার সোজা করেন। এগুলো কিন্তু কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয় না। ওই বিশেষ সংবেদনশীলতা নির্ধারিত থাকে কেবল শরীয়ত বয়াতির জন্য, কেবল বাউল রণেশ ঠাকুরের জন্য।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এগুলো নিয়ে আমাদের হা-হুতাশ আছে কিন্তু কর্ম নাই। এই রাষ্ট্রধর্মকেন্দ্রীক রাজনৈতিক হতাশা, মৌলবাদের উত্থান সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা এগুলো নিয়ে আমরা যখন মানিকগঞ্জের বাউল সাইদুর রহমান বয়াতির মুখোমুখি হই, তিনি দীর্ঘ নীরবতার পর বলেন— “বাজান স্বদেশ মানে কী? সাধক না হইলে স্বদেশ পাইবেন না”।
তাই তো! স্বদেশ থাকে সাধকের। সাধনার সংগ্রামেই না স্বদেশ মেলে। সেই সাধনার সংগ্রাম তো আমাদের ছিল, ছিল স্বদেশও— হাতছাড়া হলো কোন পাপে? আজ আমাদের সাধনা কোথায়? পকেট ভর্তি ধর্মের জোচ্চুরি আর মাথাভর্তি ধান্ধা। বাউল বলতে আমরা বুঝি ফোক ফেস্ট, ধর্ম বলতে বুঝি বায়তুল মোকাররম। বঙ্গবন্ধু বললে বুঝি কোটি কোটি টাকার মুজিববর্ষ। বাংলার মানুষের ধর্ম এখন বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত। অদ্ভুত এই দ্বিচারী বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাস। সে টাকা চুরি করে বাংলাদেশ থেকে, ফ্যাশন নকল করে বলিউডের, নিকটাত্মীয় ভাবে পাকিস্তানকে কিন্তু পাসপোর্ট চায় ইউরোপ-আমেরিকার, ধারণ করে তালেবানি আদর্শ কিন্তু মরতে চায় আবার মক্কায়। কী আশ্চর্য তার ধার্মিক সত্তা! আগে লোকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতো, এখন কলার দাম কম— বাঙালি মুসলমান আজকাল ধর্মগাছ হচ্ছে।
তাহলে আমাদের মুক্তি কী সে— যে কোনো আলোচনার শেষ কথা তো এই। কিন্তু আমরা তো উত্তর খুঁজতে পারি না। “সত্য মানুষ হন— দেশ ও জাতির কল্যাণ হবেই হবে”— আপাত সরল এ কথাটির অর্থ উদ্ধারে যখন ‘সত্য’, ‘মানুষ’, ‘দেশ’ ও ‘জাতি’ সংক্রান্ত নিবিড় তাত্ত্বিক ভাবনায় ডুবে ডুবে ক্লান্ত হই, তখন মনে পড়ে— “ভাতের নিচে কৈ মাছ, আমি কৈ মাছ তালাশ করে বেড়াই”। ভাত মানে তো মাটি— স্বদেশের মাটি, পৃথিবীর মাটি।