আজ থেকে দশ বছর আগে- ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি- সব যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে এক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত জেনোসাইডে যে বাঙালি কুলাঙ্গাররা প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিল, ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল বাংলার নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে; তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতেই এক যূথবদ্ধ দ্রোহী বাংলাদেশ জেগে উঠেছিল সেদিন। যে দাবি নিয়ে ১৯৭২ সালে শহীদ পরিবারের সদস্যরা সোচ্চার হয়েছিলেন, ১৯৭৯ সালে আন্দোলন শুরু করেছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ১৯৮৮ সালে ডা. এমএ হাসানের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মঞ্চ, ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি; তারই ধারাবাহিকতার সূর্যমুখী উদ্বোধন ছিল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিসংগ্রামের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে গড়ে ওঠা এসব আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়- প্রতিটি আন্দোলনই একেকটি প্রজন্মকে তৈরি করেছে ভবিষ্যতের লড়াইকে সুসংহত করার লক্ষ্যে। সেই অর্থে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনও একটি প্রজন্মের মাঝে সঞ্চার করেছে মুক্তিসংগ্রামের ঐশ্বর্যমণ্ডিত চেতনা; তাদের সামনে মেলে ধরেছে বাংলার ইতিহাসের দার্ঢ্য আকাশ। এই প্রজন্ম কোথায় কীভাবে তৈরি হচ্ছে, সে খবর আমাদের কাছে নেই; যেমন শহীদ জননী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছেও ছিল না আমাদের বেড়ে ওঠার পথে তাঁদের অনন্য অবদানের খতিয়ান। কিন্তু জাতির প্রয়োজনে, ইতিহাসের দায় শোধ করতে, ন্যায্যতার দাবিতে আমরা পথে নেমেছিলাম। এ কারণেই শাহবাগ থেকে বারবার এই সত্য উচ্চারিত হয়েছিল- আমরা শহীদ জননীর সন্তান।
২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার মোঃ আবদুল হামিদের কাছে সুনির্দিষ্ট ছয় দফাসংবলিত যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের সুস্পষ্ট গতিপথ।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার। কারণ বাংলাদেশ শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না-পারার ব্যর্থতাতেই রক্তাক্ত ছিল না; বরং এই ক্ষত আরও বেদনাদায়ক হয়েছিল ২০০১ সালে খোদ যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় পতাকা। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীরা ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। আর ২০০১ সালের পরের বাংলাদেশে আমাদের জন্য হতাশা ছাড়া কোনো দৃশ্যকল্প ছিল না; বিলাপ ও আর্তনাদ ছাড়া কোনো উচ্চারণ ছিল না।
ফলে পঁচাত্তর-পরবর্তী বিপর্যস্ত ও পথ হারানো বাংলাদেশকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবিনামা। কেবল আইনের মাধ্যমে সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তিই নয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ছিল সুস্পষ্ট। শাহবাগ থেকে যে কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছিল- বাংলাদেশের রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনীতি- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে ঐতিহাসিক সত্য ও অমোঘ আদর্শ, তার বেদিমূলে দাঁড়িয়েই যে কোনো দলকে রাজনীতি করতে হবে বাংলাদেশে। দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে- এ বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না কোনো দল।
সুনির্দিষ্ট আদর্শকে প্রেক্ষণে রেখে ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর যে রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করেছে, কোথাও কি সেই সংগ্রামের পরিপন্থি আদর্শ রাজনীতিতে সক্রিয়? জেনোসাইডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল কি কোনো দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখে? পৃথিবীর কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কি স্বাধীনতার স্থপতিকে অপমান করে রাজনীতি করা যায়?
ক্ষমতার জোরে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করার নজির সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। এই ধ্রুব সত্যকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দলের উত্থান আমরা দেখেছি, এখনও দেখি। ইতিহাসের হিসাব মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের আদর্শবিরোধী এ দলগুলো মুখে যা-ই বলুক না কেন, তাদের উৎস এক ও অভিন্ন। এ চক্রবূহ্যটি ভাঙা প্রয়োজন এবং এ পরিপ্রেক্ষিতেই শাহবাগের উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট- আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রারম্ভিকা। তাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার কোনো দল বা ব্যক্তির নেই; থাকতে পারে না।
একটি গণআন্দোলনের সার্বিক ইতিহাস বা তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্নেষণের জন্য এক দশক তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সময় নয়। ভিন্ন অর্থে কিন্তু একই মর্মে শাহবাগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা যেমন আজও বহমান, তেমনি গত এক দশকে এই আন্দোলনের গতিপথও পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে আমরা অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি; আমাদের অনেক সহযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন হিংস্র মৌলবাদী অপশক্তির নৃশংসতায়। সব হত্যাকাণ্ডের বিচারও আমরা পাইনি।
শাহবাগ থেকে যে স্লোগান উচ্চারিত হতো- শাহবাগ জেগে থাকে, শাহবাগ ঘুমায় না- বেদনাবিধুর হাজার দৃশ্যপটের পরও স্লোগানটি প্রাসঙ্গিক। ২০১৩ সালে যে স্কুলশিক্ষার্থীরা শাহবাগ এসেছিলেন দলবেঁধে, তাঁদের অনেকেই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন কিন্তু দলছুট হননি। শাহবাগে শহীদ জননীর ছবির সামনে যে মোমবাতিটি সেদিন জ্বালিয়েছিলেন তাঁরা, তার আলো ছড়িয়ে গেছে তাঁদের ব্যক্তিজীবন-কর্মজীবন সবখানে। শাহবাগ তো এটিই চেয়েছিল।
ছয় দফার একটি উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল- জনমানসিকতায় মুক্তিসংগ্রামের চেতনার চর্চা, প্রতিদিনের যাপনে আমার ইতিহাস আর আদর্শকে অনুসরণ করা। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সলতেটা তো পাকাতে হবে নিজের জীবন থেকে, নিজের চর্চাতেই তো আদর্শের স্বচ্ছ স্ম্ফুরণ। এ সত্যের বীজমন্ত্রটি শাহবাগ সেদিন ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। দশ বছর আগে শাহবাগে জড়ো হয়েছিল বাংলাদেশ; আজ বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে শাহবাগ। ২০১৩ সালে মায়ের হাত ধরে যে সন্তান এসেছিল শাহবাগে, শহীদ মিনারের কসম- সেই মায়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে শাহবাগ তার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে।