১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বপ্ন আর প্রত্যাশার ভিত্তিতে বাঙলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছিলো, আজ স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি, উপরন্তু এ অপ্রাপ্তির সমীকরণে যোগ হয়েছে কিছু ন্যাক্কারজনক চলক, যা কিনা এখন আমাদের সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই উপহাস করে চলেছে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন কেবল নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধই নয়, বরং দীর্ঘ এক সংগ্রামের ইতিহাস যার চূড়ান্ত পর্যায় ছিলো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রাপ্তি। কিন্তু দীর্ঘ ইতিহাসকে নানাবিধ প্রশ্নে বিদ্ধ করে আজ উপস্থাপন করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সামনে। ইতিহাসকে বারবার বিকৃত করা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে। আর এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপটি পরিগৃহীত হয়েছে গত ১১ জুলাই নগরীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটে, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম সমর্থিত ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’ এর একটি সম্মেলনে। সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিগৃহীত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের বিচার দাবি করায়, আর তাকে অপমান করেছে জামাতের নষ্ট পুঁজ থেকে জন্ম নেয়া ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীরা। এই বর্বরতার দায়ভার বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপরই বর্তায়।
পুরো ঘটনাটির দুইটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এ ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’ গঠন এবং দ্বিতীয়ত ঘটনাটি ঘটার পরবর্তী সময়ের বিশ্লেষণ। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন যারা হত্যা-ধর্ষণ আর লুটতরাজের মাধ্যমে বাঙলাদেশ জন্মের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলো; সেইসব রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস-এর সমন্বয়েই গঠিত এ পরিষদটি। উক্ত সম্মেলনটিতে যারা এসেছিলো, বক্তব্য রেখেছিলো তাদের সকলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিরোধীতাকারী। তাদের বক্তব্যেও তাদের অবস্থান পরিস্কার হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীন বাঙলাদেশে, যেখানে এখনো মুক্তিযোদ্ধারা এখনও জীবিত, এখনো যে দেশের মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে সচেতন, সেখানে কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মেলন হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে, ইতিহাস অন্বেষণ করতে হবে।
বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও গণহত্যার প্রতীক, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর রাজাকার গোলাম আযমের নাগরিকত্ব স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাতিল করা হয় এবং জামায়াতে ইসলামীর সকল কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া এ নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে এক বিতর্কিত রায়ে আদালত তার নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করে। তৎকালীন সময়ে এ ঘটনাটি জনগণের মনে কী প্রভাব ফেলেছিলো, তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ইতিহাস পড়লে। কিন্তুেএ কথা সত্য যে, সে ঘটনাটির মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়ার শুরু করে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী প্রতিষ্ঠাকরণ প্রক্রিয়াটির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে, যার হিংস্র থাবার শিকার হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুধু তাই নয়, বাঙলাদেশের যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলো, যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধ চেতনাপন্থী বলে দাবি করেন, তারাও তাদের শাসনামলে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে পারেননি, ফিরিয়ে আনতে পারেননি ১৯৭২ সালের সেই সংবিধানকে। আর তাই বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বিএনপি নামক আদর্শহীন দলের ঘাড়ে চেপে, তাদের প্রত্যক্ষ মদদে বাঙলাদেশবিরোধীতার এবং নতুন ষড়যন্ত্রের সুযোগটি নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো। বিএনপির সহযোগিতায় এ দলগুলো এখন তাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্তিকরণের প্রচেষ্টায় রয়েছে। শকুনেরা বারবার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অপমান করছে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থী দাবি করা দলগুলো কেবল সংবাদ সম্মেলন আর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকছে। আর তীব্র দহন যন্ত্রণাতে দগ্ধ হচ্ছি আমরা, যারা নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ, বীরাঙ্গনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ফসল ভোগ করছি।
গত ১১ জুলাই ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে সরকারের যা যা করা কর্তব্য ছিলো, সবকিছু করতেই সরকার চরম ব্যর্থতা আর ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে। ঘটনার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, পরিস্কার ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও দোষী ব্যক্তি গ্রেফতার হয়নি; এমনকি বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা আছে বলেও মনে হয় না। তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো দেশ চালাচ্ছে। কেবল বিষয়টি যাদের পীড়া দিয়েছে, অর্থাৎ যাদের এখনো অপমানবোধ রয়েছে, তারাই বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, প্রজন্ম একাত্তর কিছু আন্দোলনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
তবে বাঙালি নতজানু হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক হয়ে একটি অনবদ্য আন্দোলন রচনা করবে নিশ্চয়ই। আর সে আন্দোলনে সমগ্র বাঙলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আহবান জানাই। এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ হবে।