“বাংলাদেশের কাছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা (৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন পাকিস্তান রুপি) দাবি করতে যাচ্ছে পাকিস্তান”— শীর্ষক সংবাদটি পড়ার পর এ বিষয়ে কিছু খোঁজ-খবর করার চেষ্টা করি। চেষ্টার অংশ হিশেবেই আমার এক প্রবাসী বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। পাকিস্তান ইস্যুতে ওর সঙ্গে কথা বলাটা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ কেননা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ও প্রায়ই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতো— “এই পাকিস্তান আর সেই পাকিস্তান এক নয়”। “কেনো নয়”— জানতে চাইলেই ও নানা রকম পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীর নাম বলতো যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক নৃশংস গণহত্যার জন্যে ‘দুঃখিত’। তো সেরকম কিছু বুদ্ধিজীবীর প্রবন্ধ-নিবন্ধ সম্প্রতি পড়ার সুযোগ হয়েছে। তাদের লেখার মধ্যে গবেষণার নামে যে রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেন্দ্রীক ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ধারায় এক অশনি সংকেত বলেই আমার মোনে হয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানাভাবে গবেষণা হচ্ছে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে সেগুলো খুঁজে পেতেও আমাদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। সুতরাং ইতিহাসচর্চার মাঝেও যে রাজনৈতিক একটি দর্শনের প্রভাব আছে, এবং তারও আধিপত্য বিরাজের সুযোগ আছে— সেটি আমাদের গবেষকগণ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ইতিহাসচর্চা এবং বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের পক্ষে বাঙলাদেশের অবস্থান আগামি কী হবে, কেমন হবে— তার অনেক কিছুই নির্ভর করছে বর্তমানে ইতিহাসের কী পরিমাণ রসদ আমরা রেখে যাচ্ছি আগামি প্রজন্মের জন্যে। না হলে এইসব পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের বয়ানেই আগামি প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিখতে হবে আর সেটাই হবে বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান পাকিস্তানপন্থীদের চূড়ান্ত বিজয়। সে লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে।
আমাদের পাওনা না মিটিয়ে পাকিস্তানিদের এই যে উল্টো পাওনা দাবি করা— এর পেছনে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দুর্বলতা একটি সক্রিয ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এখানেই বিশ্লেষণ শেষ করলে হবে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা বর্বর গণহত্যা, বিভৎস নারী নির্যাতন চালিয়েছে; কিন্তু তারা একই সঙ্গে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে হত্যা করেছে আমাদের বুদ্ধিজীবী সূর্য সন্তানদের। মেধার দিক থেকে বাঙলাদেশকে পঙ্গু করার বিভৎসতা তারা চালিয়ে গেছে পুরো মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এর বাইরেও, বাঙলাদেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির কীট-পতঙ্গের চাষ তারা করে গেছে। ফলে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির ইতিহাসেও পাকিস্তানি চরদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বলাই বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভাতেই পাকিস্তানি চর খন্দকার মোশতাক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে তাহেরউদ্দীন ঠাকুরদের অবস্থান ছিলো। ফলে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ট্র্যাজিক পরিণতি বাঙালিকে বরণ করতে হয়েছে এবং এই শূন্যস্থানে কার্যত এখনও আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পাকিস্তানের কাছে পাওনা দাবির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পঁচাত্তরের পর এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। কেনো হয়নি, সে প্রসঙ্গে আমার বন্ধুর উল্লিখিত পাকিস্তানের ‘দুঃখিত’ বুদ্ধিজীবীদের দু চারটে লেখার অবতারণা করা যেতে পারে। ইসলামাবাদের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাদাফ ফারুক, ড. আমেনা মাহমুদ এবং নাদিয়া আওয়ানের একটি জার্নাল গত বছরের এপ্রিল মাসে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিলো— ‘বাঙলাদেশ পাকিস্তান রিলেশনস: অ্য হোস্টেজ টু হিস্ট্রি’। প্রায় আশি পাতা জুড়ে লেখা সেই জার্নালে অনেক ভালো ভালো কথার ফাঁকে তারা খুব কৌশলে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ পরিবর্তে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বদলে ‘স্যাসেশনিস্ট বা বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ভারতের সহযোগিতাকে ‘ষড়যন্ত্র’, পাকিস্তানিদের চালানো গণহত্যাকে ‘প্রোপাগান্ডা’ হিশেবে চালানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা আইয়ুব খান বা জানোয়ার ইয়াহিয়ার সমালোচনা করছে কিন্তু ভুট্টোকে ‘রেগুলার পলিটিক্যাল ফোর্স’ হিশেবে উল্লেখ করে তার সাফাই গাইছে। তারা বলার চেষ্টা করছে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিযাত্রাকে ইয়াহিয়ার বন্দুক দিয়ে ঠেকানোর সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো এবং কথাটির সমর্থনে ফুটনোটে যে কয়টি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছে, সবগুলোতেই আমাদের জাতির জনককে একজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিশেবে দেখানো হয়েছে। এরকম বইগুলোর নাম উল্লেখ করলে লেখার পরিধি ছাপিয়ে যাবে। তবে একটি বইয়ের নাম বলতেই হচ্ছে, ১৯৯৫ সালে যেটি প্রকাশিত হয়েছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে, নাম: ওয়ার্কিং উইথ জিয়া: পাকিস্তানস পাওয়ার পলিটিক্স, ১৯৭৭-৭৮। কে. এম.আরিফের লেখা এই বইটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘সংগ্রাম’ পত্রিকার কাটিংগুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এই বইটি থেকে জানা যায় কীভাবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙলাদেশে পাকিস্তানি আজ্ঞাবহ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেছে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এবং জিয়াউর রহমানের সহযোগিতায় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দরোজাগুলো একে একে প্রসারিত করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জিয়ার শাসনামলে আইএসআই’র দেয়া দিক-নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ‘ফরগেট অব্যাউট দ্যা ডিউস’ এবং এর সত্যতা পাওয়া যায় ১৯৮০ সালে অবসরে যাওয়া আইএসআই’র প্রধান লে. জেনারেল মোহাম্মদ রিয়াজের একটি উক্তি থেকে, যা ১৯৮৪ সালের ১৪ আগস্ট ডন ওভারসিস উইকলিকে দেয়া এক তার এক সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। সেখানে তার দেয়া বক্তব্যের সারমর্ম হলো— বাঙলাদেশ এখনও তাদের ‘আন্ডার দ্য থাম্ব’। সুতরাং পাকিস্তানের ভয় নেই। বাঙলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি পাকিস্তানের অনুকূলেই থাকবে। এই পাকিস্তানি আনুকূল্যের রাজনৈতিক শক্তি কারা, তার প্রমাণ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেমন আছে, তেমনি পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের লেখা বইপত্রেও আছে। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর গণজাগরণ মঞ্চ যখন প্রথম পাকিস্তানের কাছে বাঙলাদেশে পাওনা আদায়ে সরকারকে সোচ্চার হবার দাবি জানায় তখন পাকিস্তানের পেশওয়ারভিত্তিক গণমাধ্যম ফ্রন্টেয়ার পোস্ট তাদের এক রিপোর্টে গণজাগরণ মঞ্চকে ‘দ্য গ্রুপ অব হকস’ উল্লেখ করে জানায় যে, আওয়ামী লীগের মতো ‘প্রো ইন্ডিয়ান লবি’ ক্ষমতায় থাকলে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। আওয়ামী লীগের শাসনামলকে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরাও ‘ফেভারব্যাল পলিটিক্যাল সিচুয়েশন ফর আপরাইজিং দ্য ন্যাশনালিস্ট ফোর্স’ বলে উল্লেখ করেছে বারবার। অন্যদিকে বিএনপি-জামাতের শাসনামলকে উল্লেখ করেছে ‘ব্রাদারলি সাইড অব পাকিস্তান’। বিএনপি-জামাতের ‘প্রো পাকিস্তান ফরেন পলিসি’ বারবার হাততালি পেয়েছে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের কাছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই আওয়ামী লীগের শাসনামলেও কী আমরা উল্লেখ করার মতো শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করতে পারছি? অবস্থাদৃষ্টে মোনে হয়, যতোটা শক্ত হওয়া উচিৎ ছিলো, ততোটা পারিনি। গণজাগরণ মঞ্চ ২০১৩ সাল থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানায়। একই সঙ্গে পাকিস্তানের কাছে বাঙলাদেশের পাওনা টাকা উদ্ধারের জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর দাবি জানায়। কিন্তু প্রতিবারই গণজাগরণ মঞ্চের এই দাবিকে সরকার পাশ কাটিয়ে গেছে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি, পাকিস্তানি হাইকমিশন কীভাবে কূটনৈতিক পাড়ায় থেকে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্যে অর্থায়ন করে যাচ্ছিলো। এতোকিছুর পরও আমরা বাঙলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উল্লেখ করার মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখিনি। আজকে পাকিস্তান যে অন্যায্য দাবি তুলেছে, তার কারণ হলো আমাদের কূটনৈতিক দুর্বলতা। আমরা আমাদের পাওনা আদায়ে যেহেতু জোর তৎপর হতে পারিনি, সেহেতু তারা সুযোগ নিচ্ছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে তারা একটি ‘গিমিক’ তোলার চেষ্টা করছে, যা ভবিষ্যতের জন্যে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। কারণ, অদূর ভবিষ্যতে এই পাওনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের মতো বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও ‘মানবতা’ দেখানোর তরিকা টেনে আনবেন (যেটা ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা খুব ভালো পারেন)। সুতরাং, এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়ে আমাদের পাওনা আদায়ে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক পাওনার দাবি-দাওয়াগুলো নিয়ে আমাদের গবেষণামূলক লেখা তৈরি করতে হবে। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে পাওনা আদায়ের এবং পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের দাঁতভাঙা জবাব দেবার প্রভাবকগুলো রেখে যেতে পারবো।
দুই
বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস পাঠ করলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার হেরফের ঘটেছে। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু সরকার পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা আদায়ে নানা রকম কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটি যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিষয়টি অতো সহজ ছিলো না। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা অর্থের বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা কেবল থেমেই যায়নি বরং উল্টো পথে চলেছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরও বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কেননা, বর্তমানে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনে পাকিস্তানের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণসহ আমাদের পাওনা আদায়ের পথ অনেকটা সহজ । এ বিষয়ে শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন কূটনৈতিক নীতি অবলম্বন জরুরি, যা বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কাছে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা
পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনার বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সে আলোচনাগুলো আন্তর্জাতিকমহলে খুব বেশি উত্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া পাওনার ক্ষেত্রে কেবল বৈদেশিক ঋণ, যেগুলো ১৯৪৭-১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তান লাভ করেছে, মোটা দাগে সেগুলো পাওনা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের তেইশ বছরের নির্মম শোষণের সময় বাঙলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিভিন্ন পর্যায়ে যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে, সে বিষয়ক আলোচনা খুব বেশি হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাঙলাদেশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত করেছে। এসব বৈষম্য নিরসনে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী কোনো উদ্যোগ তো গ্রহণ করেইনি, উল্টো বৈষম্য নিরসনে বাঙালির দাবি-দাওয়াকে পিষে ফেলতে নির্মম আক্রমণ করেছে— গণহত্যা চালিয়েছে।
তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য, তা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ‘চূড়ান্ত’ ও ‘আপেক্ষিকভাবে’ বেড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে দুই অঞ্চলের ব্যবধান যেখানে ছিলো ৬৩ টাকা, অর্থাৎ ২১.৯%, তা কুড়ি বছরের ব্যবধানে ১৯৬৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২০২ টাকায় বা ৬১.০৫%১।
১৯৪৭-৭০ পর্যন্ত পাকিস্তান যে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পায় (৭৬৪০ মিলিয়ন ডলার), তার ৮৪.২৮% (৬৪৩৯ মিলিয়ন ডলার) পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন কাজে ব্যয় করে। এর মাত্র ৩০% পায় পূর্ব পাকিস্তান (১৯৩১.৭ মিলিয়ন ডলার)। অথচ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৫৬% বা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০% ঋণ সুবিধা আমাদের পাবার কথা ছিলো। বাণিজ্যনীতির ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ আগ্রাসী জোচ্চুরি করেছে পাকিস্তান, তা সম্ভবত তৎকালীন ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৪৭-৭০ সালের মধ্যে মোট রপ্তানিতে পূর্ব পাকিস্তানের আয় ছিলো ২৫,৫৫৯ মিলিয়ন টাকা (৫৩৭০ মিলিয়ন ডলার); অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান আয় করেছে ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা (৪,৪৪০ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু এই উপার্জিত অর্থ যখন আমদানির জন্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তখন হিশেব উল্টে ফেলেছে শোষক পাকিস্তান সরকার। মোট রপ্তানি আয় ৪৬,৬৯৬ মিলিয়ন টাকার (৯৮১০ মিলিয়ন ডলার) মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ১৭,০৬৭ মিলিয়ন টাকা (৩৫৮৫.৪৭ মিলিয়ন ডলার)। বাকি অর্থ (২৯,৬২৯ মিলিয়ন টাকা বা ৬২২৪.৫৩ মিলিয়ন ডলার) পশ্চিম পাকিস্তানের কাজে ব্যয় হয়২।
অর্থাৎ, আমাদের আয়ের উদ্বৃত্ত অর্থ (৮৪৯২ মিলিয়ন টাকা বা ১৭৮৪.৫৩ মিলিয়ন ডলার) ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, রপ্তানি আয় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ২০০০ মিলিয়ন ডলার। আবার দুই অঞ্চলের বাণিজ্যতেও পাকিস্তানের শোষকরা আমাদের রক্ত চুষে মুনাফার পাহাড় গড়ে। ১৯৪৭-৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয় ১৭৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতে হয় ৩৩০৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ১৯৭৪ সালের ০৪ এপ্রিল দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন মতে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাঙলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই আলোচনাতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী ইতিহাসের যে জঘন্যতম লুটপাট, অগ্নি-সংযোগ, ব্যাংকের টাকা পাচারসহ নানাবিধ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার বিষয়ে কেবল ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালনা কর্তৃপক্ষের হিশাবটি উপস্থাপনা করছি। তাদের হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং বাঙলাদেশের সরকারের হিশাবে ১২৪৯ কোটি টাকা।
পাওনা দাবির আইনি ভিত্তি
পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা দাবির আইনি ভিত্তি নিয়ে কথা বলার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, ভূ-খণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তনের বেশ কয়েকটি ধারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃত। সেগুলো হলো: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূ-খণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বাঙলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ড অর্জন করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী। বলে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভূ-খণ্ড সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যে দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে ‘রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার’ বলে। এ প্রসঙ্গে ‘ভিয়েনা কনভেনশন’ আইনের আওতায় আমরা আমাদের পাওনা দাবি করতে পারি। ১৯৮৩ সালের কনভেনশনের ৪০-৪১ ধারায় বলা আছে, যখন কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অংশ বিশেষএকাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে একাধিক রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয়, তখন বিভক্ত রাষ্ট্র বা ভূ-খণ্ডের ঋণও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ হবে। সম্পদ বণ্টন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মানুযায়ী, হস্তান্তরিত ভূ-খণ্ডে অবস্থিত বা হস্তান্তরিত ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল স্থাবর ও অস্থাবর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এবং তহবিলের অধিকার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে। এই স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বা বিদেশে অবস্থিত হলেও, তা যদি হস্তান্তরিত ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়, তবে তার অধিকার উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের। এই বিধানে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক আদালত এবং স্থায়ি আন্তর্জাতিক আদালত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এবং অভিমত প্রদান করেছেন। এই বিধান ১৯৭৮ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের আর্টিক্যাল-২ এ উল্লেখ আছে। এই বিধান অনুযায়ী বাঙলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের তহবিল এবং অস্থাবরসহ সব বিষয়ে সম্পত্তিতে হিস্যার দাবিদার। এই আইন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের আগের পাকিস্তানের যে সকল সম্পত্তি বিদেশের মাটিতে ছিলো (যেমন বিভিন্ন দূতাবাসের ভবন বা ভবনস্থলের অস্থাবর সম্পত্তি), সেগুলোতেও আমাদের পাওনা রয়েছে।
এই আইনে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা আছে, যেটি ‘দায় সংক্রান্ত’, অর্থাৎ পূর্ববর্তী বা সাবেক রাষ্ট্রের ঋণের দায় গ্রহণ। পাকিস্তান কিন্তু নিকটবর্তী অতীতেও এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার জল ঘোলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই কতিপয় পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী ভিয়েনা কনভেনশনের এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই আলোচনা ধোপে টিকে না। কারণ, পাকিস্তান আমলে ঋণ হিশেবে নিয়ে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় বাঙলাদেশ গ্রহণ করে। আবার চলমান প্রকল্পের ১৪৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩৬.১২১ মিলিয়ন ডলারের দায়ও বাঙলাদেশ গ্রহণ করে৩। সুতরাং ভিয়েনা আইনের এই ধারটির কথা উল্লেখ করে বৈদেশিক ঋণের এক-তৃতীয়াংশ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যয়ের যে ঘ্যানঘ্যানানি পাকিস্তান করে থাকে, তা অযৌক্তিক কেবল নয়, সর্বৈব মিথ্যা।
পাওনা আদায়ে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতার খতিয়ান
পাকিস্তানের কাছে আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের কূটনৈতিক তৎপরতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের কূটনৈতিক তৎপরতা। দেশ স্বাধীন হাবর পর সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানের কাছে উত্থাপন করা হয়। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পাওনার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তার ঠিক পরের মাসেই জাপান সফরকালে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্পষ্টভাবে সম্পদ বণ্টনসহ অন্যান্য পাওনা আদায়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন। আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায়সংগত প্রাপ্যের দাবি আদায়ের জন্যে বঙ্গবন্ধু যে পাকিস্তানের স্বীকৃতির বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন, সেটা অনুমান করা যায়। কারণ, পাকিস্তান বাঙলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে স্বীকৃতি দিলেই তাকে আমাদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। সুতরাং, এ বিষয়ে প্রথম গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাঙলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদানের পর। শুরু থেকে এ কাজটি কেনো গুরুত্বের সঙ্গে করা যায়নি, তা বিচার করার জন্যে, সে সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিশেবে বিভিন্ন দেশ থেকে স্বীকৃতি আদায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি ছাড়াও বাঙলাদেশকে তখন পাকিস্তান ও তার দোসর বিভিন্ন রাষ্ট্রের তৈরি নানা অপ-প্রচারের জবাব দিতে হচ্ছিলো। এরই মধ্যে পাকিস্তানি ব্যবসায়িরা (স্বাধীনতার আগে যারা বাঙলাদেশে ব্যাবসা করতো) সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলাদেশের কাছে সম্পদ দাবি করতে থাকে। এটা ছিলো পাকিস্তানের আগাম প্রতিষেধক, যাতে বাঙলাদেশ পাওনা আদায় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো জোরালো দাবি করতে না পারে। পাকিস্তানও জানতো, এখনও জানে, আন্তর্জাতিক আইনে বাঙলাদেশের দাবি যতোটা যৌক্তিক, পাকিস্তানের দাবি ততোটাই হাস্যকর এবং বালখিল্য। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে পকিস্তান কার্যত মৌন থেকে বাঙলাদেশকে নিষ্ক্রিয় রাখার কৌশল অবলম্বন করে। তবে ১৯৭৪ সালের ০৫-০৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ভারত ও বাঙলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান আলোচনায় বসে। সে সময় এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দু দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর বিষয়টি সমাধানের কথা বলে। এ সময় বাঙলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। মোনে রাখতে হবে, ঠিক তখনই (১৯৭৪ সালে) পাকিস্তানের গণমাধ্যম ও কোনো কোনো মহল ‘হঠাৎ করে’ বাঙলাদেশের কাছে পাল্টা সম্পদ দাবি করে। এ ঘটনার সঙ্গে এই কিছুদিন আগে পাকিস্তানের অর্থ দাবি করার বিষয়টির পদ্ধতি ও পরিস্থিতিগত মিল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের পূর্বে বাঙলাদেশের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যানকেই বিবেচনায় রেখে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে চারটি নীতি নির্ধারণ করে। এছাড়াও দু দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল হয়, তাতেও সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে রাজি হয়নি, উল্টো জানিয়ে দেয়, নীতিগতভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণে সে প্রস্তুত নয়। সুতরাং সম্পদ বণ্টনের ইস্যুতে ভুট্টোর সফর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলো এবং তাদের বুদ্ধিজীবী-গবেষকরা এ বিষয়ে কোনো গবেষণা তথ্য-তত্ত্ব-উপাত্ত ছাড়াই বাঙলাদেশের দাবির সমালোচনা করতে থাকে। কিন্তু বাঙলাদেশও সাফ জানিয়ে দেয়, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে সম্পদ বণ্টন ও অবাঙালি প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সমাধান করে আসতে হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর সরকার এই ন্যায্য দাবির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করতে সমর্থ হন। ফলে ১৯৭৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকার-প্রধানদের বৈঠকেও বাঙলাদেশের পাওনা ও সম্পদ বণ্টনের দাবিটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। জুলাই মাসে ওআইসি’র সম্মেলনেও বাঙলাদেশের পাওনার দাবিতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে ওআইসি। বিষয়টি নিয়ে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনেও আলোচনা হবার কথা ছিলো আগস্ট মাসে। কিন্তু তার আগেই জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
এ পর্যায়ে দ্বিতীয় ভাগের আলোচনা করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে পূর্ব-নির্ধারিত পাওনার দাবি আর উত্থাপন করেনি বাঙলাদেশ। জিয়াউর রহমান পাওনার দাবি প্রত্যাহারেও রাজি হয় এবং এ শর্তেই বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শুধু তাই নয়, তৎকারীন বাঙলাদেশ সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা দেয়। এতে সবচেয়ে লাভবান হয় পাকিস্তানি ব্যবসায়িরা, কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের মালিকই ছিলো তারা। ব্যাপক প্রতিবাদ হবার পরও বাঙলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু করে। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সরকারের এক আদেশে বাঙলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা দাবি করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এই অধ্যাদেশের ফলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাঙালি মালিকদের অংশ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ফলে পাকিস্তানিরা ঢাকায় এসে জাল নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট তৈরি করে আদালতে রিট করে তাদের সম্পত্তি ফেরৎ পায় এবং তা বিক্রি করে টাকা নিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। এরপর ১৯৭৭, ৭৮ ও ৮০ সালে তিনবার সম্পদ বণ্টনের ইস্যুতে আলোচনা করার জন্যে পরারাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৎসামান্য উদ্যোগ থাকলেও, তার কোনো কিছুই আলোচনার টেবিল পর্যন্ত গড়ায়নি। ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে পুনরায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয় স্বৈরশাসক এরশাদের পাকিস্তান সফরকালে, যেহেতু আলোচনার তালিকায় এটি ছিলো। কিন্তু এরশাদকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়া হলে, এ বিষয়ে সে আর কোনো আলোচনা করেনি। পরবর্তীতে আরেকবার আলোচনার সুযোগ হয় ১৯৯০ সালের মার্চে; কিন্তু তখনও বিহারি সমস্যা নিয়ে আলোচনা শেষ করা হয়।
তৃতীয় ভাগের আলোচনা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাঙলাদেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের কালের আলোচনা। ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া পাকিস্তানে সফর করলেও, জিয়াউর রহমানের মতোই বিষয়টি উপস্থাপনে আপত্তি জানায়। ৫২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে পাকিস্তান গেলেও গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পিকটি নট। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৬ সালে সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। এ বছরের আগস্টে ৯-১১ তারিখ বাঙলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পাকিস্তানে সফরকালে বিষয়টি নিয়ে জোর দাবি তোলেন। ফলে ১৬-১৮ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফরকালে তারা আলোচনা করতে বাধ্য হয়— যদিও সফলভাবে পাশ কাটানো নীতি অবলম্বন করে। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তান সফর করেন বটে, তিনি উল্লেখও করেন যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ যে হয়নি, তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট। এরপর আবার বিষয়টি নিয়ে সামান্য আলোচনা হয় ২০০৬ সালের ১২-১৪ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাকিস্তান সফরকালে। আবারও তিনি বিহারিদের বিষয়ে আলোচনা করে আসেন, কিন্তু সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি ছিলো ফলশূন্য। এরপর সরকার বদল হয়েছে, বাঙলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ও তা কার্যকর হয়ে চলছে, এই বিষয়ে পাকিস্তান কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করছে; কিন্তু বাঙলাদেশ সম্পদ বণ্টন ও পাওনা আদায়ে কোনো জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে না। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর গণজাগরণ মঞ্চ দীর্ঘদিন পর বিষয়টি আবার দাবি হিশেবে উত্থাপন করে। সরকার যে এ বিষয়ে নতজানু পররাষ্ট্র নীতি অবলম্বন করছে, সেটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু অদ্যাবধি এ বিষয়ে সরকারের কোনো হেলদোল নেই।
পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনার বিষয়টি কেবলই অর্থনৈতিক নয়; এর সঙ্গে রাষ্ট্রের ডিগনিটিও জড়িত। একদিকে এই পাওনা আদায় যেমন বাঙলাদেশের জনগণের অধিকার, তেমনি এটি আদায়ের জন্যে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
তথ্যসূত্র
১. সোবহান, রেহমান, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি, পৃ. ৬১৯।
২. Monthly Foreign Trade Statistics, June 1970, Karachi, p1
৩. বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, সংখ্যা ১৪, ০৮ জুন, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা: ৮৫৭-৮৬৩