১৯৩৮ সালের কথা। তখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য ফিফথ কলাম এন্ড দ্য ফার্স্ট ফরটি নাইন স্টোরিস প্রকাশিত হয়। ফিফথ কলাম হেমিংওয়ের একমাত্র নাটকের নাম যেটি লেখা হয়েছিলো স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলার সময়ে। মাদ্রিদ শহরে তখন বোমা পড়ছে। এ ঘটনারও দু বছর আগে অর্থ্যাৎ ১৯৩৬ সালে স্পেনের জাতীয়তাবাদী সামরিক অধিকর্তা এমিলো মোলা ‘ফিফথ কলাম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যারা গ্রামে শৈশব কাটিয়েছেন, তারাও হয়তো দেখেছেন গ্রামের দোকানে, স্কুলের দেয়ালে এমনকি গাছেও ঝুলানো থাকতো একটি পোস্টার, যাতে লেখা ছিলো- ‘পঞ্চম বাহিনী হইতে সাবধান’। এই পঞ্চম বাহিনীর উদ্ভব সুদূর স্পেনে হলেও, তা বাঙলাদেশেই সফলভাবে বিস্তার লাভ করে, এবং বলাই বাহুল্য যে, এখনও তারা সগর্বেই টিকে আছে তাদের নিজস্ব চরিত্র নিয়ে।
এখনও হয়তো ‘ফিফথ কলামিস্ট’ বা ‘পঞ্চম বাহিনী’ সংক্রান্ত বিষয়টি পরিস্কার হয়নি পাঠকের কাছে। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। মূল বিষয়টিতে যাবার আগে অন্য একটি বিষয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং একই সঙ্গে বিব্রতকর। বিষয়টির নাম- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ।
গুরুত্বপূর্ণ- কারণ, বাঙলাদেশে যে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে, সেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অপশক্তিদের সমূলে ধ্বংস না করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাগজে কলমে থাকা বিষয় মাত্র।
সংবেদনশীল- কারণ, স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরে এই অপশক্তি একটু একটু করে নানা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এখন এক বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের অপ-আদর্শ ধ্বংস করতে না পারলে এক সময় বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আর বিব্রতকর- কারণ, এই প্রশ্নটি এলেই আমাদের সামনে কতোগুলো ‘কিন্তু’, ‘যদি’ ইত্যাদি শব্দ এসে দাঁড়ায়, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শাসনামলেও ‘যে কোনো দিন’- এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি ঝুলছে। আবার সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে এ বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। কোটি কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের অনন্য সৌধ গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও বারবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এবং জামাত-শিবির নিষিদ্ধের প্রশ্নে দাবি তোলা হচ্ছে। এখন গণজাগরণ মঞ্চ তাদের উত্থাপিত সুনির্দিষ্ট ছয়দফা দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করছে।
আরেকটি চিত্র হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত-শিবিরের পশুরা শিক্ষকদের ওপর বোমা হামলা করেছে। এমন জঘন্য ঘটনা ঘটার পরও আমরা দেখছি সবকিছুই সুশীলীয় সুশীতলতায় জমে আছে। গণজাগরণ মঞ্চ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটির প্রতিবাদ করে সমাবেশ করেছে, কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুমে নিমজ্জিত প্রশাসনের সামনে সমাবেশই কী আর সভাই বা কী!
ঠিক এই পর্যন্ত লেখার পর আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কাছে। এই অসামান্য গ্রন্থটি আর তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়রিগুলো আমার অন্ধকার সময়ের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায়, তিনি বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র, নেতৃত্বে থেকে যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্রের, তৎকালীন অন্য নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর মতো অতোটা সাহসী হতে পারেননি। আমার প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধু কোন বাঙলাদেশ চেয়েছিলেন? কোন বাঙলাদেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ লিখে গেছেন তাঁর ডায়রিগুলো? নিঃসন্দেহে সেটি ছিলো যুদ্ধাপরাধীমুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙলাদেশ, যার ভিত্তিমূল হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কারণ, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় এবং বাহাত্তরের সংবিধান স্পষ্টতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবিনাশী স্মারক।
কিন্তু আজ? এ কোন সময়ের চোরাগলি ধরে হেঁটে যাচ্ছি আমরা? সামনে তাকালে দেখি আমাদের শিক্ষকদের রক্তমাখা ছবি, একাত্তরের পরাজিত ঘাতক-দালাল জামাত-শিবিরের আক্রমণে আমাদের শিক্ষকগণ আহত। এ কোন বাঙলাদেশে বাস করি? এই বাঙলাদেশের স্বপ্ন কী দেখেছিলেন জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানগণ- আমাদের হৃদপিণ্ড- বাঙলার মুক্তিযোদ্ধাগণ?
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, পঁচাত্তরের পর বাঙলাদেশ যে অতল অন্ধকারের পথে হারিয়ে যাচ্ছিলো, বর্তমান মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সেখান থেকে টেনে তুলেছে বাঙলাদেশকে। এক সময় সরকারি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযোদ্ধাগণ-মুজিবনগর সরকার সর্বোপরি বাঙলাদেশের মূল যে বিষয়গুলো, এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হতো না। এখন সে অবস্থা বদলেছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষ সত্য ইতিহাস সন্ধানের সুযোগ পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জানতে পারছে আমাদের প্রজন্ম। আমার চোখে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ কালের সন্তানের মতোন। তাঁরা প্রবাদপ্রতিম সাহসিকতা আর তুলনারহিত দেশপ্রেমের অপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন বীরত্বের কবিতা। তাঁদের দৃঢ় চলন, শাণিত চোখ, মায়াবী অতীতের মতো ফিরে তাকানো আমাদের দিকে- এসব কিছুই আমাদের গড়ে তুলেছে। আমি ইতিহাসে যতো বীরত্বের কাহিনি পড়েছি, বাঙলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাগণের বীরত্বের কথা মনে হলে, ওসবই আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। সাহিত্যে যতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর প্রগাঢ় চরিত্র পড়েছি, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মনে হলেই, ওসব আমার কাছে নিতান্ত সাধারণ মনে হয়েছে। কোনো চলচ্চিত্র এতোটা গতিময় নয়, যতোটা গতিময় বাঙলাদেশের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে একটু দাঁড়ানো কিছু মুহূর্ত। কোনো আলোকচিত্রই নয় যুগপৎ এতোটা দার্ঢ্য ও প্রেমময়, যতোটা একজন মুক্তিযোদ্ধার চাহনি বা কণ্ঠস্বর।